কাপ্তাই পাল্পউড বিভাগের আওতাধীন বান্দরবান নোয়াপতং ইউনিয়নে বাঘমারা রেঞ্জের একটি জোত পারমিট (ব্যক্তিমালিকাধীন জমিতে গাছ কাটার অনুমতিপত্র) ব্যবহার করে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার ছয় মৌজার কাঠ পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে বিধি ভঙ্গ করে ওই জোত পারমিটের কাঠ বান্দরবান সদরের একটি ডিপোতে মজুদ করা হয়। পরে সেসব কাঠ কোনো না কোনো জোত পারমিটের অন্তরালে বিভিন্ন জেলায় পাচার করা হয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বৈধ পারমিটের অন্তরালে অবৈধ কাঠ পাচার করে আসছে অসাধু কাঠ ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে বন বিভাগ ও কাঠ ব্যবসায়ীর বক্তব্যে জোত পারমিটে ইস্যু করা কাঠের ঘনফুটের পরিমাণের অমিল পাওয়া গেছে।
বাঘমারা রেঞ্জ অফিস সূত্র জানায়, বন বিভাগের রাঙ্গামাটি অঞ্চলের কাপ্তাই পাল্পউড বিভাগের বাঘমারা রেঞ্জের আওতাধীন বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়ন। প্রায় এক বছর আগে কাপ্তাই পাল্পউড বিভাগ ইউনিয়নটির ৩৪৬ নং ম্রক্ষ্যং মৌজাধীন কালাধন তঞ্চঙ্গ্যা নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন পাঁচ একর বনজ বাগানের অনুকূলে একটি জোত পারমিট ইস্যু করা হয়। এতে সেগুন, গামারি ও কড়ই প্রজাতি মিলে সাত হাজারের কিছু বেশি ঘনফুটের পারমিট দেয়া হয়। কালাধনের নামে হলেও পারমিট পরিচালনা করছে মো. কাশেম নামের চকরিয়ার এক কাঠ ব্যবসায়ী। পারমিটের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ঘনফুট কাঠের ট্রান্সমিট পাস (টিপি) দেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বান্দরবান সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে রাজবিলা ইউনিয়নের (নতুন অনুমোদিত জামছড়ি ইউনিয়নের অংশ) বাঘমারা বাজার। এটি নোয়াপতং ইউনিয়ন ও রাজবিলা ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডের মানুষের প্রধান বাজার। এ বাজার থেকে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার একমাত্র সড়কের কমবেশি নয় কিলোমিটার দূরে একটি পাহাড়ের চূড়াকে কেন্দ্র করে ভাগ হয় বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির জেলার সীমানা। দুই জেলার সীমানাস্থল থেকে কাঁচা সড়কে হাঁটাপথে আনুমানিক এক কিলোমিটার দূরে রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দ্য ইউনিয়নের চিংক্ষ্যংপাড়া। এর কিছুদূরে একই উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের অংশ শুরু হয়। বাঘমার বাজার হতে এ পর্যন্ত (ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের অংশ) সড়কের উভয় পাশে পরিমাণে কমবেশি হলেও অন্তত ১২-১৫টি কাঠের মজুদস্থল দেখা গেছে। এছাড়া সড়ক ঘেঁষা ম্রক্ষ্যংপাড়ার মুখে একটি কাঠের ডিপো দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটি মো. কাসেম নামের এক কাঠ ব্যবসায়ীর ডিপো।
রাঙ্গামাটির গাইন্দ্যা, ঘিলাছড়ি ও বান্দরবানের নোয়াপতং ইউনিয়নের স্থানীয়রা জানায়, রাঙ্গামটির দুই ইউনিয়নের তিন মৌজার বিভিন্ন পাড়া থেকে সংগ্রহ করা গুটগুটিয়া, সেগুন, গামারি, শীল, কড়ইসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ কেটে নিচ্ছে বান্দরবানের বাঘমারার কাঠ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এদিকে বান্দরবানের নোয়াপতং ইউনিয়নের ৩৪৬ নং ম্রক্ষ্যং মৌজার গুংক্ষ্য, সোনাই সেপ্রু, ছকপৌছোওয়ে, ৩৪৫ নং নোয়াপতং মৌজার ক্রংলাই, ফ্লংক্ষ্যং, বাওয়া, তায়ম্রংমুখ, মনিরামপাড়া এবং ম্রক্ষ্যং মৌজা ঘেঁষা বান্দরবান সদর উপজেলার ৩৩০ নং হ্নারা মৌজার মঞ্জইপাড়াসহ বেশ কয়েকটি পাড়া হতে একইভাবে বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ এনে বাঘমারার কয়েকটি ডিপোতে মজুদ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব কাঠ বান্দরবানে পাঠানো হয় বলে জানায় স্থানীয়রা।
এসব বিষয়ে কথা হলে অভিযোগ অস্বীকার করেন কাঠ ব্যবসায়ী মো. কাশেম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বাঘমারায় কাঠ ব্যবসা তো আমি একা করি না। স্থানীয় হান্নান, আব্দুল্লাহ, হারুন মেম্বার, বাইশধন তঞ্চঙ্গ্যা, সেমপ্রু মেম্বারসহ আরো কয়েকজন আছে। ম্রক্ষ্যং মৌজায় সেগুন, গামারি ও কড়ই মিলে আমার ১০ হাজার ঘনফুটের পারমিট আছে। এ পর্যন্ত টিপি অনুযায়ী পারমিটের প্রায় তিন হাজার ঘনফুট কাঠ নেয়া হয়েছে। কাঠগুলো বান্দরবানের নতুন ব্রিজ এলাকার হারুন সওদাগরের ডিপোতে মজুদ করা হয়। এখনো সেখানে আমার কাঠ মজুদ রাখা আছে। সেখান থেকে টিপি ব্যবহার করে ঢাকায় পাঠানো হয়। কাপ্তাই বিভাগের কাঠ বান্দরবানে মজুদ করার সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বান্দরবান পাল্পউড বিভাগের তারাছা রেঞ্জেও আমার সাত হাজার ঘনফুটের একটা পারমিট আছে। এজন্য অসুবিধা হয় না।
এসব বিষয়ে বাঘমারা রেঞ্জের কর্মকর্তা ফরেস্টার মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমার রেঞ্জে তিনটা অস্থায়ী ডিপো আছে। পারমিটের বাগানের বাইরে অন্য কোথাও থেকে কাঠ সংগ্রহ করে কিনা তা জানা নেই।
এক বিভাগের পারমিটের কাঠ টিপির গন্তব্যস্থল ব্যতীত অন্য কোথাও মজুদ হলে তা আইন লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন পাল্পউড প্লান্টেশন বিভাগ বান্দরবানের সহকারী বন সংরক্ষক মো. আনোয়ার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ধরনের কোনো তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেসব কাঠ জব্দ করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কাপ্তাই বিভাগের টিপির কাঠ বান্দরবানে মজুদ করার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন কাপ্তাই পাল্পউড বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, টিপিতে উল্লেখ থাকে কোন কাঠ কোন স্থান থেকে কোথায় যাবে। বান্দরবানে একাধিক চেক স্টেশন রয়েছে। যদি বান্দরবানে মজুদ হয়, তাহলে সেখানকার সংশ্লিষ্টরা সেসব কাঠ জব্দ করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিভিন্ন মৌজা থেকে কাঠ নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চেষ্টা করব যাতে জোত পারমিটের বাইরে কোনো কাঠ পাচার না হয়।