নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি হাটে জমে উঠেছে বোরো ধানের চারা বেচাকেনা। প্রতি মৌসুমে মাত্র আড়াই মাসে অন্তত ৪ কোটি টাকার বোরো ধানের চারা বিক্রি করেন স্থানীয় কৃষক। এলাকার অন্তত দুই হাজার কৃষক এ চারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।চারা বিক্রি করে বাড়তি রোজগার করায় তাদের সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর জেলার ২ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের বীজতলা করা হয়েছে।
প্রায় তিন দশক ধরে চাচুড়ি হাটে ধানের চারা বিক্রি হচ্ছে। এসব চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন নড়াইলের বিভিন্ন উপজেলাসহ পাশের জেলা গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বাগেরহাটের কৃষক-ব্যবসায়ীরা। আর এ হাটকে ঘিরে এলাকার অন্তত পাঁচ হাজার কৃষক, ব্যবসায়ী, পরিবহন চালকসহ হাট সংশ্লিষ্টদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। কৃষকরা জানান, বীজতলায় চারা ধানের চারা উৎপাদন করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। ফলে তাদের তিন ফসলি জমিতে এ নিয়ে চার ফসল হচ্ছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, নড়াইল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি গ্রাম। নড়াইল-কালিয়া সড়কের পাশে এ গ্রামের খেলার মাঠে বসেছে বোরো ধানের চারার হাট। চারা বেচাকেনায় ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। কথা হয় এলাকার প্রান্তিক কৃষক মন্নু শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এখানে প্রতি রোববার ও বৃহষ্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চারা বেচাকেনা হয়। নড়াইলের বিভিন্ন উপজেলাসহ পাশের জেলা গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাটের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এখানে চারা কিনতে আসেন।
চারা বিক্রেতা আসলাম ফকির বলেন, ‘৫০-৭০টি চারা দিয়ে এক মুঠো (আটি) করা হয়, ৮০ মুঠো চারায় এক পণ হয়। এক পণ চারা আকার ভেদে ২৫০-৪০০ টাকা বিক্রি হয়।’
উপজেলার ফুলদাহ গ্রামের কৃষক সাদ্দাম শেখ বলেন, ‘প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আড়াই মাস এখানে চারা কেনাবেচার ধুম পড়ে। এ হাটে অন্তত ১০ ধরনের ধানের চারা বেচাকেনা হয়।’
লোহাগড়া উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের কৃষক তজিবার শেখ বলেন, ‘প্রতি বছর তিনি এ হাটে চারা কিনতে আসেন গত বছর থেকে প্রতি পণ চারা অন্তত ২০-৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।’
পুরুলিয়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মরফু শেখ জানান, পাঁচ-ছয় বছর ধরে নিজের জমিতে চারা উপাদন করে এ হাটে বিক্রি করেন। এ বছর ৩০ শতক জমিতে চারা উৎপাদন করেছেন। খরচ হয়েছে ২২-২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকার চারা বিক্রির আশা করছেন তিনি।
আরেক কৃষক রিপন মোল্লা বলেন, ‘এক থেকে দেড় মাসের ফসল এটি। যে জমিতে চারা দেয়া হয় সে জমির চারা তুলে ধানের আবাদ করতে কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে তিন ফসলি এসব জমি থেকে এখন বছরে চারবার ফসল ফলানো যাচ্ছে। আর যে জমিতে বছরে দুবার ফসল ফলানো যেত সেখানে তিনবার ফসল ফলানো যাচ্ছে।’
চারা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছর তিনি স্থানীয় কৃষকদের জমি থেকে চারা কিনে এ হাটে বিক্রি করেন। চলতি মৌসুমে চারার চাহিদা একটু বেশি। সেজন্য দামও কিছুটা বেশি।’
ব্যবসায়ী লিটন কাজী জানান, প্রতি হাটে এখানে যে পরিমাণ চারা বিক্রি হয় সে চারা পরিবহন করতে ৩০০-৩৫০টি ভ্যান লাগে। ৮-১০ হাজার টাকায় যে চারা পাওয়া যায় সেই চারা একটি ভ্যানে বহন করা যায়।
বাগেরহাট থেকে চারা কিনতে আসা কৃষক জসিম শেখ জানান, গত বছরও তিনি এ হাট থেকে চারা কিনে জমিতে রোপণ করেছেন। ফলন ভালো হওয়ায় এ বছরও তিনি চারা কিনতে এসেছেন।
হাট সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি হাটে ২০-২৫ লাখ টাকার চারা বেচাকেনা হয়। সে হিসাবে প্রতি মৌসুমে ২০-২২টি হাটে অন্তত ৪ কোটি টাকার চারা বেচাকেনা হয়।
হাটের ইজারাদার মিজান শেখ জানান, কৃষকের কথা বিবেচনা করে যারা এখানে চারা বিক্রি করতে আসেন তাদের কাছ থেকে কোনো খাজনা নেয়া হয় না। যারা চারা কিনে নিয়ে যান তাদের কাছ থেকে প্রতি ভ্যানে ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত খাজনা নেয়া হয়।
স্থানীয় চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম (মনি) বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পাশে এ হাটে যারা চারা কেনাবেচা করেন তাদের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। এ হাটকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের মৌসুমি আয়ের সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে এলাকার কয়েক হাজার কৃষক বেশি উপকৃত হচ্ছে। পরিষদের পক্ষ থেকে হাট সার্বক্ষণিক তদারক করা হয় যাতে কোনো কৃষক ও ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত না হন। দিন দিন এ হাটের পরিধি বাড়ছে।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, কালিয়ার চাচুড়ি ও বড়দিয়া হাটসহ জেলার আরো কয়েকটি হাটে বোরো মৌসুমে চারা বেচাকেনা হয়। জেলার মধ্যে চাচুড়ি চারার হাট সবচেয়ে বড়। অল্প সময়ের মধ্যে এটি একটি লাভজনক ফসল। দিন দিন কৃষক এ চারার ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন।’