দেশের অর্থনীতিতে দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ। নিত্যনতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে চলেছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। যদিও ব্যবসাকে টেকসই করার পাশাপাশি নিত্যনতুন পণ্য ও সেবার উদ্ভাবন-রূপান্তরের জন্য গবেষণা-উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) খাতে বিনিয়োগ করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তুলনামূলক কম। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) এক পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এরই মধ্যে বেশ পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে ওইসিডির ট্রান্সফরমেশন পলিসি রিভিউ (পিটিপিআর) শীর্ষক এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে আসে, নতুন পণ্য ও সেবা উদ্ভাবনে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের নতুন কোনো পণ্য বা সেবা উদ্ভাবনের তথ্য পাওয়া যায় না। যদিও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ভারতের ২ দশমিক ৯ শতাংশ, মরক্কোর ৪ দশমিক ৩, তুরস্কের ১১ দশমিক ৭ ও ভিয়েতনামের ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আরঅ্যান্ডডি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন পণ্য ও সেবা উদ্ভাবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
আরঅ্যান্ডডিতে বিনিয়োগের দিক থেকেও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে বেসরকারি খাত। এ খাতে বিনিয়োগ করেছে ভিয়েতনামের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ, তুরস্কের ২২ দশমিক ৩ ও মরক্কোর ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কোম্পানি। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশে হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ।
বাজারে সুষ্ঠু ও সুষম প্রতিযোগিতার অভাবকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে অনাগ্রহের জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হলে গবেষণা ও উন্নয়নে কোম্পানিগুলো আগ্রহী হবে বলে অভিমত তাদের।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের বাজারে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মুনাফার জন্য কোম্পানিগুলোকে খুব বেশি প্রতিযোগিতা করতে হয় না। এজন্য তারা আর গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতার জায়গা তৈরি করে দিলে তারা টিকে থাকার জন্যই গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।’
বিশ্বব্যাপী বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বড় একটি অংকের অর্থ নিয়মিতভাবে ব্যয় করছে। মাইক্রোসফট, গুগলের মতো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মোটরযান নির্মাণ, ওষুধ, লৌহ ও ইস্পাত এমনকি পর্যটন খাতেরও বৃহৎ কোম্পানিগুলো আরঅ্যান্ডডিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে চলেছে। এসব কোম্পানির অগ্রযাত্রায় এ বিনিয়োগ বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে গবেষণায় অনাগ্রহী হওয়ার পেছনে কাঠামোগত সংকটকে দায়ী করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আগে গবেষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি খাতকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নিয়ম ছিল, যার অন্যতম ছিল কর অব্যাহতি। এছাড়া আরো অনেক বিষয় ছিল। কিন্তু অপব্যবহারের অভিযোগে এগুলো তুলে নেয়া হয়। এটিও গবেষণা ও উদ্ভাবনে বেসরকারি খাত থেকে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বড় কারণ। বিষয়টি নিয়ে আমাদের চেম্বারগুলো কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোও দায়িত্ব নিতে চায় না। গবেষণা প্রণোদনার জন্য সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে কাঠামোগত সম্পর্ক থাকার দরকার, সে সম্পর্কও এখানে নেই। ফলে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ এখানে আসে না। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও এ দায়িত্ব নিতে চান না।’
বাংলাদেশে আরঅ্যান্ডডিতে বিনিয়োগ বাড়ানো এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে ওইসিডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতকে উদ্ভাবনে মনোযোগ দিতে হবে। এ উদ্ভাবন দেশের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট সব খাতেই শুরু করতে হবে। শুধু টেকসইভাবে চলমান কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়া বা অন্তর্ভুক্তিমূলক করা নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে রফতানি বৈচিত্র্যকরণ ও প্রবৃদ্ধির নতুন উৎসেরও খোঁজ নিতে হবে। বিষয়টি নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, উৎপাদনের আধুনিকায়ন, রফতানি বৈচিত্র্যকরণ ও স্থানীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত কার্যক্রম নেই। রফতানির মধ্যে পোশাক আমাদের বড় উৎস। পোশাকের সঙ্গে গবেষণার খুব বেশি সংযোগ নেই। এখানে সৃষ্টিশীলতার সুযোগ আছে শুধু ডিজাইনে। পোশাকের বাইরে অন্য কোনো পণ্য খুব বেশি রফতানি হয় না। আমাদের দেশীয় বাজার এখনো মূল্য প্রতিযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানে গবেষণা ও উদ্ভাবনের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। এজন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এ খাতে বিনিয়োগ করছেন না। যদি প্রয়োজন হতো তাহলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হতেন।’
শুধু বিনিয়োগ নয়, গবেষণা-উন্নয়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের দিক থেকেও পিছিয়ে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা। ওইসিডির তথ্য অনুযায়ী, বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে নতুন প্রযুক্তির লাইসেন্স গ্রহণের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ কোম্পানি বিদেশী কোম্পানির লাইসেন্স নেয়। যেখানে ভারতের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, মরক্কোর ২৬, তুরস্কের ১৪ দশমিক ৪ ও ভিয়েতনামের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কোম্পানি বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে প্রযুক্তি সনদ নেয়।
জানতে চাইলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনার সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি। আমরা অন্য দেশ, শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে অনুসরণের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করি। জাপানে আমি দেখেছি, সেখানে ৫০-৬০ বছরের কোম্পানিকে নতুন কোম্পানি বলা হয়। ১৫০ থেকে ৩০০ বছরের কোম্পানিকে পুরনো কোম্পানি বলে। আমাদের এখানকার ব্যবসায় প্রথম প্রজন্ম, দ্বিতীয় প্রজন্ম চলে গেছে। এখন তৃতীয় প্রজন্মের সময়। নতুন প্রজন্ম শিল্পে গবেষণার হাল ধরবে বলে বিশ্বাস করি। এর জন্য সরকারেরও সহায়তা প্রয়োজন। আবার একই সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও সমন্বয় করা দরকার। তাহলেই গবেষণা-উদ্ভাবনে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসতে পারবে।’
দেশে শিল্প ও গবেষণার সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। প্রতিষ্ঠানটি শিল্প-কারখানাগুলোয় বিভিন্ন কারিগরি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সেবা দেয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আরঅ্যান্ডডিতে বিনিয়োগ না করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হওয়ার পাশাপাশি আমাদের সরাসরি উৎপাদননির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান কম থাকায় এখানকার উদ্যোক্তারা গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে চান না। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য উদ্ভাবনের তুলনায় আমদানীকৃত প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ বেশি লক্ষ করা যায়। এর মাধ্যমে লাভবান হওয়াও সহজ। তাই উদ্যোক্তারা উদ্ভাবনে অর্থ ব্যয় করতে চান না।’