ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক

বিএনপির সংহতিকে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ প্রচার-প্রচারণা দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি এতে সংহতি জানিয়েছে বিএনপি। বিষয়টি এখন সরকারদলীয় ও বিরোধী পক্ষের রাজনীতিবিদদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য হলো রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এ প্রচারে সংহতি জানিয়েছে বিএনপি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ প্রচার-প্রচারণা দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি এতে সংহতি জানিয়েছে বিএনপি। বিষয়টি এখন সরকারদলীয় ও বিরোধী পক্ষের রাজনীতিবিদদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য হলো রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এ প্রচারে সংহতি জানিয়েছে বিএনপি। 

আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা মনে করেন, তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই সরকার গঠন করেছেন। নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে চাপে রাখার মতো কোনো কর্মসূচি বিএনপি দিতে পারেনি। এ কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারে সমর্থন জানিয়েছে দলটি। তবে তাদের এ অবস্থান সরকারকে তেমন একটা চাপে ফেলতে পারবে না। 

দুই দেশের সম্পর্কেও বিষয়টির কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি (ভারতীয় পণ্য বর্জন) হঠকারী সিদ্ধান্ত। মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার জন্যই এ কর্মসূচি। এটা যারা করছে, তারা সবসময়ই ভারতের বিরুদ্ধে থাকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক পরাজয়ের পর বিএনপি এখন এসব কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে উসকে দিতে চাইছে। ‌বৈশ্বিক পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব আমাদের দেশেও আছে। এ মুহূর্তে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে বিএনপির সংহতিকে বাজার পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তোলার ষড়যন্ত্র বলেই মনে হচ্ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশে আমদানি পণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ভারত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে ৯৪ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি হয়, যা ডলারের হিসাবে প্রায় ৯৪৯ কোটি ২৪ লাখ। এ ধারা বজায় রয়েছে চলতি অর্থবছরেও। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ভারত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। ডলারের হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৪২৮ কোটি।

ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা সব দেশের সঙ্গে ব্যবসা করি, ফলে সব দেশেরই মঙ্গল হয়। যদি ব্যবসা-বাণিজ্যে মঙ্গল হয়, তাহলে আমরা কেন অমঙ্গল ডেকে আনব? বর্তমান বিশ্বে বয়কটের মতো নীতিগুলো খুব সুখকর হয় না। যারা এটা করছে, তারা এক ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে করছে। এটা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল হবে বলে মনে হয় না।’ 

বাংলাদেশে ভারত থেকে আমদানীকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুলা, খাদ্যপণ্য, খাদ্যশস্য, পাথর, কফি, চা, বিভিন্ন ধরনের মসলা, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, খনিজ পণ্য, লোহা ও ইস্পাত, অর্গানিক কেমিক্যাল ইত্যাদি। এছাড়া কিছু শিল্পের কাঁচামালও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। 

ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার সম্পর্কে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এগুলোর মাধ্যমে বিএনপি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ করার চেষ্টা করছে। আমাদের মনে রাখা উচিত ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। আমাদের বাধ্য হয়েই ভারতীয় পণ্য কিনতে হয়। চাল হোক আর পেঁয়াজ হোক, এগুলো তাদের কাছ থেকে আমদানি করতে হয়, না হলে ঝামেলা হয়।’

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘‌ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারতবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়। এর মধ্যে গত বুধবার (২০ মার্চ) এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভারতের সহযোগিতায় নির্বাচনের নামে তামাশা করেছে। এটি বুঝতে পেরে বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় পণ্য বর্জন করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ ভারতীয় পণ্য বর্জনকে আমরা যৌক্তিক মনে করি।’

বিএনপির এ সংহতিকে ‘ভারতবিরোধী পুরনো অবস্থানের’ অংশ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিএনপি কখনো ভারতবিরোধী রাজনীতি করে, আবার কখনো তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক করতে চায়, এটা তাদের নিজেদের রাজনীতি, তাদের স্ট্র্যাটেজি। আমি মনে করি না যে এটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার কিছু আছে। আমি মনে করি এটা তাদের পুরনো ভারতবিরোধী রাজনীতির একটা অংশ। রাজনীতিতে এখন তারা অনেকটা দেউলিয়া। আর আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। আর বিভিন্ন সময়ে আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু ভারত। এ রকম একটা দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। দুই দেশের সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। এ ধরনের সস্তা রাজনীতি দিয়ে একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চিন্তা অবান্তর, এটা সম্ভব নয়।’

দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে এ প্রচার কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি জানানো বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। যখন তারা রাজনীতিতে ইস্যুবিহীন হয়ে পড়ে, তখনই তারা এগুলো করে। শুরু থেকেই তারা এটা করে আসছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে তারা মানুষের দৃষ্টি ভিন্নদিকে নিতে চেয়েছে, জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। এ ধরনের প্রচারণা দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।’ রাজধানীর ধানমন্ডিতে গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় বিএনপি দেশের বাজার ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি করতে চায় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার দুরভিসন্ধি বিএনপির মানসিক বৈকল্যেরই বহিঃপ্রকাশ। তাদের ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দুদেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না। যারা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে দেশের জনগণ তাদেরই বয়কট করবে।’

আরও