দেশের সব সংরক্ষিত বনসহ পাহাড়ের গাছ কাটা ও কাঠ পাচার নিষিদ্ধ। কিন্তু সরকারের এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মাতামুহুরী ও রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বনসহ পাহাড়ি প্রাকৃতিক বন নিধন ও কাঠ পাচার করে চলেছে চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। এজন্য পাহাড় কেটে ঝিরি ভরাট করে কাঁচা সড়কও করা হয়েছে। এতে উজাড় হচ্ছে চাঁপা, বৈলাম, গর্জন, কড়ইসহ দুর্লভ প্রজাতির শতবর্ষী বৃক্ষ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বনের সবুজ আচ্ছাদন।
স্থানীয়রা
জানায়, গত বছরের অক্টোবরে থানচি-আলীকদম সড়কের ২১ কিলোমিটার অংশ থেকে থানচি উপজেলার তিন্দু সড়ক হয়ে আলীকদম উপজেলার তৈনফা ও চাইম্প্রা মৌজায় দুটি কাঁচা সড়ক নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে তিন্দু সড়কের শুরুতে করা একটি সড়ক ব্যবহার করে আলীকদমে নেয়া হচ্ছে তৈনফা মৌজার দিরিপাড়ার প্রাকৃতিক বন থেকে কাটা নানা প্রজাতির কাঠ। এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলীকদমের জনৈক মোহাম্মদ আলী। একইভাবে তিন্দু পৌঁছার আগে সড়কটির ডান পাশে আরো একটি সড়ক করা হয়। এটি চাইম্প্রা মৌজার বড়ইপাড়া-মঙ্গল কমান্ডারপাড়া-মেনয়াংপাড়া-কাংচংপাড়া-খ্রিস্তং ঝরনা-পারাউপাড়া-তন্ময়পাড়া পর্যন্ত আনুমানিক ১৮ কিলোমিটার রয়েছে। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে করা সড়কটি ব্যবহার করে তিন মাস ধরে কর্তন করা শতবর্ষী চাঁপা, বৈলাম, গর্জন, কড়ই, গোদা, চাপালিশসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষের কাঠ আলীকদমে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব কাজ পরিচালনা করছেন আলীদমের বিএনপি নেতা বলে পরিচিত আনোয়ার জিহাদ চৌধুরী, ইউনুছ মিয়া, ইউসুফ আলী সিন্ডিকেট। এছাড়া আলীকদমের দোছড়ি বাজারের উজানে তৈন খালের গহিনে মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে পাচার করারও অভিযোগ রয়েছে।
জেলার
রুমা উপজেলার সদর ইউনিয়নের রোমানাপাড়া এলাকার একটি পাহাড়ের শিরাকে কেন্দ্র করে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলা ভাগ হয়। রোমানাপাড়ার অদূরে রাঙ্গামাটি জেলার শুরুতেই রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বনের অংশ। গত বছর সরেজমিনে ওই এলাকায় গেলে জেলার সীমানাসহ রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বনের শুরুর অংশটি দেখিয়ে দেয় পাড়াবাসী। সে সময় রাঙ্গামাটির অংশে রাইক্ষ্যং বনে শতবর্ষী নানা প্রজাতির বৃক্ষ দেখা গেছে। সম্প্রতি রোমানাপাড়া হতে এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বনের ভেতর পর্যন্ত রাস্তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ কেওক্রাডং পেরিয়ে পাহাড়টির দার্জিলিংপাড়া থেকে নিউ রোমানাপাড়া পর্যন্ত সড়ক নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করতে একটি এক্সক্যাভেটর আনা হয়। চালক মাসুদ জানিয়েছেন, এক্সক্যাভেটরটি এলজিইডির। এ এক্সক্যাভেটর দিয়ে রোমানাপাড়া থেকে শুরু করে লংথাক্সি পাড়া হয়ে রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বনের ভেতর পর্যন্ত পাহাড় কেটে রাস্তা করা হয়েছে। এক্সক্যাভেটরের ভাড়া বহন করছেন বান্দরবানের কাঠ ব্যবসায়ী আফজাল। রাস্তাটি ব্যবহার করে কাঠ পাচার করেন আফজাল সওদাগর নামের এক ব্যক্তি। গত বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর কয়েক দফায় শ্রমিকরা রাইক্ষ্যং বনে ঢুকে বড় বড় গাছ কেটে কাঠে পরিণত করেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ পুরান রোমানাপাড়া কারবারির (পাড়াপ্রধান) বাসায় থাকতেন। স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আফজাল জেলার সীমান্ত থেকে পাহাড়ি কাঠ নিয়ে আসেন। তবে তার আনা কাঠগুলো চট্টগ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন তালুকদারকে বুঝিয়ে দেন আফজাল।
গত
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, থানচি-আলীকদম সড়কের ২১ কিলোমিটার অংশ থেকে থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নে যাওয়ার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের করা ইট বিছানো সড়কটির শুরু। তিন্দু সড়কের প্রায় ২০০ গজ ভেতরে ডান পাশে একটি কাঁচা রাস্তা রয়েছে। উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা রাস্তাটির কমবেশি ২০০ ফুট ভেতরে কাঁচা রাস্তাটি তিন ভাগ হয়ে গেছে। ভাগ হওয়া অংশ থেকে একটির পর আরেকটি করে দুটি রাস্তায় হেঁটে দেখা গেছে চারদিকে বন নিধনের চিহ্ন। এসব এলাকায় সদ্য কাটা পড়া গাছের গোড়া দেখা যায়। নিধন করা বৃক্ষের পড়ে থাকা ডালপালা নিশ্চিহ্ন করতে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এতে প্রতিবেশগত সংকটসহ পরিবেশের বহুমাত্রিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
এসব
বিষয়ে জানতে সেলফোনে বারবার কল করা হলেও কোনো সাড়া দেননি আলীকদমের মোহাম্মদ আলী, ইউসুফ আলী, ইউনুছ মিয়া ও রাইক্ষ্যং সংরক্ষিত বনের কাঠ পাচারে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী আফজাল।
তবে
আনোয়ার জিহাদ চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তিনি আলীকদম কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য বলে জানান। কাঠের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন দাবি করে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক বছর আগের থানচি-আলীকদম সড়কের তৈনফা ও চাইম্প্রা মৌজায় কোনো ধরনের কাঠ কাটা ও পাচার হতো না। এসব কাজের মূল হোতা মোহাম্মদ আলী। এদিকে আফজাল তার কাছে কাঠ বুঝিয়ে দেন বলে স্বীকার করেছেন গিয়াস উদ্দিন তালুকদার।
চাইম্প্রা
মৌজায় কোনো জোট পারমিট নেই বলে জানিয়েছেন লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনসহ পাহাড়ে কাঠ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাইক্ষ্যং
রিজার্ভ থেকে কোনো কাঠ বান্দরবান হয়ে পাচার হওয়ার সুযোগ নাই বলে জানিয়েছেন বান্দরবান পাল্পউড প্লান্টেশন ডিভিশনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি রোমানাপাড়া এলাকা থেকে ১০ লটের ৩২০ টুকরোর ৭৪৪ ঘনফুট কাঠসহ দুটি ট্রাক জব্দ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কঠোর নজরদারি রয়েছে।
আলীকদম ও রুমার বিষয়ে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না বলে জানিয়েছেন বন বিভাগ চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, লামা ও বান্দরবান পাল্পউড প্লান্টেশন বিভাগের ডিএফওদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হবে।