খাদ্য সংকটের শঙ্কায় পাহাড়িরা

জুম ধান গিলছে বুনো ইঁদুর

জুমচাষীদের জন্য বছরের এ সময়টি ফসল ঘরে তোলার মৌসুম। আর এ ফসলই জুমিয়া পরিবারের জন্য জোগান দেয় বছরের খোরাক।

জুমচাষীদের জন্য বছরের সময়টি ফসল ঘরে তোলার মৌসুম। আর ফসলই জুমিয়া পরিবারের জন্য জোগান দেয় বছরের খোরাক। কিন্তু গত এক সপ্তাহে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা থানচি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার বেশির ভাগ জুম খেতে বুনো ইঁদুরের তাণ্ডব বেড়েই চলেছে। রাতের আঁধারে পাকা ধান, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া প্রভৃতি শস্য সাবাড় করছে ইঁদুরের ঝাঁক। ফলে খাদ্য সংকটের শঙ্কায় পড়েছেন পাহাড়ি উঁচু ভূমির চাষীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অবশ্য বলছে, ব্যাপারে তারা সজাগ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় বছর হাজার ৭৯৭ হেক্টর ভূমিতে জুম চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে পর্যন্ত দশমিক শতাংশ ফসল কাটা হয়েছে। বেশির ভাগ অঞ্চলে অনাবৃষ্টির কারণে ধানের ফলন কম হলেও নাইক্ষ্যংছড়ি লামা উপজেলায় বৃষ্টির পরিমাণ তুলনামূলক ভালো ছিল। তাই ওই দুই উপজেলায় জুমের ফলনও ভালো হয়েছে।

জুমচাষীরা জানান, অনাবৃষ্টির কারণে গত বছরের তুলনায় এবার সব ফসলই এক-তৃতীয়াংশ কম ফলন হয়েছে। বুনো ইঁদুর তাও সাবাড় করে দিচ্ছে। পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সহযোগিতা  চেয়েছেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক। বন বিভাগ বলছে, দেশে ২৯ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ে বছর মিতিঙ্গা বাড়ীওয়ালা প্রজাতির বাঁশে পুষ্পায়ন হচ্ছে। আর সময় ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

সংশ্লিষ্ট উপজেলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ইঁদুরের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত জুমচাষীদের তালিকা করার নির্দেশনা দিয়েছে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ। রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহ্লাঅং মারমা বণিক বার্তাকে বলেন, গত শুক্রবার পর্যন্ত রনিনপাড়া, পাইক্ষ্যংপাড়া, ব্যাঙছড়িপাড়া, অংজাইপাড়া, শঙ্খমণিসহ প্রায় ১০টি পাড়ায় বুনো ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। পাড়াগুলোয় প্রায় সাড়ে ৭০০ পরিবারের বসবাস। সেখানকার বেশির ভাগ পরিবারের জুম খেত সাবাড় করে দিয়েছে ইঁদুরের ঝাঁক।

একই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার রনিনপাড়ার বাসিন্দা লালদোসাং বম বণিক বার্তাকে জানান, তার পাড়ায় ১৫২ পরিবারের মধ্যে বেশির ভাগই জুমচাষী। গত শুক্রবার পর্যন্ত ৪৬ পরিবারের জুম খেতের ফসল বুনো ইঁদুরের পেটে গেছে।

থানচির কুংলাপাড়ার চিংক্লাং ম্রো বলেন, ছয় হারি জুম থেকে গত বছর ২০০ হারি ধান পেয়েছিলাম। সেগুলো দিয়ে আট সদস্যের যৌথ পরিবারে আট মাসের খোরাকি হয়েছিল। বছর বৃষ্টি খুব কম। তাই ধান গাছ রোদে জ্বলে যাচ্ছে। একইভাবে জ্বলে যাচ্ছে হলুদ, মরিচ, তিল শাকসবজিও। কোনো ফলদ, বনজ বাগানও নেই। এর মধ্যে ইঁদুরের উপদ্রব। ধান না পেলে কী হবে বুঝতে পারছি না।

রুমা উপজেলার রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের বাসিরামপাড়ার বিশাই ত্রিপুরা বণিক বার্তাকে বলেন, বছর পাঁচ হারি জুম চাষ করেছি। জুমে ধান ছাড়াও ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, তিলসহ বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ বুনেছি। দেড় সপ্তাহ আগে ধান মিষ্টি কুমড়া পাকতে শুরু করে। সোম-মঙ্গলবারের দিকে ধান কাটব বলে স্থির করেছিলাম। কিন্তু তার আগে শনিবার রাতে ইঁদুরের ঝাঁক তিন হারির বেশি ধান খেয়ে ফেলে। সঙ্গে অল্প অল্প খেয়ে মিষ্টি কুমড়াগুলোও নষ্ট করেছে। বুঝতে পারছি না সামনে খাব কী, কীভাবে বাঁচব!

এদিকে চাষীরা জানান, ঝাঁকে ইঁদুর আকারে কাঠবিড়ালির চেয়ে বড় আছে, ছোটও রয়েছে। বুনো ইঁদুরগুলো দেখতে হালকা লালচে, পেটের অংশ সাদাটে ঘরের আশপাশে দেখা ইঁদুরের তুলনায় কিছুটা লম্বা। দ্রুত দৌড়াতে পারে। পাহাড়ের প্রচলিত বাস্তবতা অনুযায়ী বাঁশের পুষ্পায়ন হলে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়ে বলে জানিয়েছেন রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চহাইমং মারমা। জুমচাষীদের বরাত দিয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বছর অনাবৃষ্টির কারণে জুমে ফলন কম হয়েছে। এর পরও যা হয়েছে তা সাবাড় করে দিচ্ছে ইঁদুরের ঝাঁক। দুর্গম রেমাক্রি ইউনিয়নের বেশির ভাগ জুমচাষীর বাস্তবতাও একই রকম বলে জানান পরিষদের চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা।

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বৃষ্টিপাত কম হলে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। রুমা উপজেলা পরিদর্শনকালে জুম খেতে ইঁদুরের আক্রমণের চিত্র দেখেছি। ইঁদুর নিধনের পরামর্শও দিয়েছি। তবে গত কয়েকদিনে বান্দরবানে বৃষ্টি বেড়েছে। এতে প্রাকৃতিকভাবেই ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব কমে যাবে। তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত জুমচাষীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শেষ হলে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রতিবেদন দেয়া হবে। জুমিয়াদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সজাগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরও