দেশে মূলত চার ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে—সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও ইংরেজি মাধ্যম। এর মধ্যে কো-এডুকেশন বা সহশিক্ষার (ছেলে মেয়ে একই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান) ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। মাদ্রাসার ক্ষেত্রে মাধ্যমিক পর্যায়কে দাখিল,উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়কে আলিম, স্নাতক পর্যায়কে ফাজিল এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়কে কামিল বলা হয়। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের বয়সসীমা সাধারণত ১১ থেকে ২৭। এ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৮৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে সবচেয়ে কম রয়েছে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানে; প্রায় ৮০ শতাংশ।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, সহশিক্ষা বা ছেলে-মেয়েকে একসঙ্গে পাঠদানের ব্যবস্থা তুলনামূলক বেশি কার্যকর। ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা, অর্থাৎ বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় সহশিক্ষা ব্যবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে তুলনামূলক এগিয়ে থাকে। এছাড়া কো-এডুকেশন ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও নেতৃত্বের জায়গা থেকেও এগিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২৩ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক স্কুল থেকে কলেজ (স্নাতকোত্তর থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্তর্ভুক্ত) পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ৮০ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এ হার ৮৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অন্যদিকে মাদ্রাসায় ৮৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহশিক্ষার বিষয়ে ব্যানবেইসের পরিসংখ্যানে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যে সমাজে বসবাস করি, সেখানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নারী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগের প্রয়োজন পড়ে। একজন শিক্ষার্থী যখন শুধু ছেলে বা মেয়েদের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে পড়ে, তখন অনেক সময় এ ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাকে পিছিয়ে পড়তে দেখা যায়। একটি বিশেষায়িত পরিবেশে শিক্ষাজীবন পার করায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তার মধ্যে একধরনের আড়ষ্টতা কাজ করে। এর প্রভাব তার ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনেও পড়ে। কিন্তু কো-এডুকেশন ব্যবস্থার শিক্ষার্থীরা সাধারণত এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একসঙ্গে শিক্ষা নিতে গিয়ে তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। তারা সমাজের বাস্তবতা সম্পর্কেও শিক্ষা পায়। নারী-পুরুষের প্রতি যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত, তা শিক্ষাজীবনেই তারা শিখতে কিংবা চর্চা করা সুযোগ পায়। বিষয়টি তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে মানিয়ে নিতে ও সফল হতে সহযোগিতা করে। এছাড়া নারী-পুরুষসহ সবার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করায় তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয়াও সহজ হয়।’
ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশে বর্তমানে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২০ হাজার ৪৪৮টি। এর মধ্যে শুধু মেয়েদের জন্য রয়েছে ৩ হাজার ২৮৫টি বিদ্যালয় আর ছেলেদের জন্য রয়েছে ৩০৫টি। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৬ হাজার ৪১৫টি বিদ্যালয়ে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে, যা মোট বিদ্যালয়ের ৮০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এছাড়া ৪৪৩টি বিদ্যালয়ে ‘সেপারেট কো-এডুকেশন’ ব্যবস্থা (ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যাম্পাস) রয়েছে।
ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, মাদ্রাসার দাখিল পর্যায়ে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬ হাজার ৫১১টি। এর মধ্যে শুধু মেয়েদের জন্য ৯৭৬টি ও ছেলেদের জন্য ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে ৫ হাজার ৫১২টি প্রতিষ্ঠানে, যা মোট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া ‘সেপারেট কো-এডুকেশন’ রয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ‘আমাদের সমাজ শুধু নারী বা শুধু পুরুষের নয়। একজন শিশু যখন কো-এডুকেশন সিস্টেমে শিক্ষা নেয় তখন সে এ বৈচিত্র্যকে সহজে গ্রহণ করতে শেখে। সবার সঙ্গে বেড় ওঠার ফলে তার মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের বাস্তবিক চর্চা থাকে। এছাড়া কো-এডুকেশনের মাধ্যমে এ অনুধাবনও জন্মায় যে সমাজে প্রতিটি মানুষেরই সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সমাজে বৈচিত্র্য থাকা উচিত। ব্যক্তিভেদে পছন্দ ও চাহিদা আলাদা হয়। এ বৈচিত্র্যের কারণেই কো-এডুকেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন প্রয়োজন তেমনি ছেলে ও মেয়েদের বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও থাকা প্রয়োজন।’
স্কুল পর্যায়ের মতো কলেজ পর্যায়েও কো-এডুকেশনে এগিয়ে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত দেশে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪ হাজার ৮২১। এর মধ্যে মেয়েদের জন্য ৭৮১টি ও ছেলেদের জন্য ৩৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর ৩ হাজার ৮৬৪টি প্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে, যা মোট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ দশমিক ১৮ শতাংশ। এছাড়া ১৪২টি প্রতিষ্ঠানে ‘সেপারেট কো-এডুকেশন’ ব্যবস্থা রয়েছে। মাদ্রাসার ক্ষেত্রে আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৭৪৮। এর মধ্যে মেয়েদের জন্য ১৪৯টি ও ছেলেদের জন্য ২৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে ২ হাজার ৫৫০টি প্রতিষ্ঠানে, যা মোট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯২ দশমিক ৮০ শতাংশ। এছাড়া ২৬টি প্রতিষ্ঠানে ‘সেপারেট কো-এডুকেশন’ ব্যবস্থা রয়েছে।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, ‘ইসলাম নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছে। আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোয় বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী রয়েছে। শহরাঞ্চলে সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক ক্যাম্পাস থাকে। মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে একই সঙ্গে ক্লাস নেয়া হয়। তবে মাদ্রাসাগুলোয় ইসলামের বিধানের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং ইসলামের বিধান অনুসরণ করেই মাদ্রাসাগুলোয় এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে।’