হয়রানি-নির্যাতন

বিএমইটিতে অভিযোগ করেও প্রতিকার পান না ৬১% প্রবাসী

পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে আট মাস আগে মালয়েশিয়া যান কিশোরগঞ্জের গণনপুরা গ্রামের সাইফুল ইসলাম। কথা ছিল দেশটিতে যাওয়ার পর পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ পাবেন। বেতন মিলবে দেড় হাজার রিঙ্গিত, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা ৩৫ হাজার টাকা। এজন্য তিনি ধারদেনা করে ‘পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি এজেন্সিকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বুঝতে পারেন তিনি

পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে আট মাস আগে মালয়েশিয়া যান কিশোরগঞ্জের গণনপুরা গ্রামের সাইফুল ইসলাম। কথা ছিল দেশটিতে যাওয়ার পর পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ পাবেন। বেতন মিলবে দেড় হাজার রিঙ্গিত, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা ৩৫ হাজার টাকা। এজন্য তিনি ধারদেনা করে ‘পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি এজেন্সিকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

কেবল সাইফুলই নন, তার মতো অনেকেই বিদেশে গিয়ে কর্মস্থলে নানা ধরনের হয়রানি, মানবেতর জীবন, এমনকি প্রাণও হারাচ্ছেন। এসব বিষয়ে ভুক্তভোগী কিংবা দেশে থাকা স্বজনরা প্রতিকার চেয়ে জনশক্তি কমর্সংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোয় (বিএমইটি) প্রতিনিয়তই অভিযোগ করছেন। তবে বছরে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পড়লেও তা নিষ্পত্তির হার অর্ধেকেরও কম। বিএমইটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে হয়রানি-নির্যাতন নিয়ে সংস্থাটির কার্যালয়ে যত অভিযোগ জমা পড়েছে, তার ৬১ শতাংশ প্রবাসীই কোনো প্রতিকার পাননি। এমনকি যারা প্রতিকার পাচ্ছেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার পরিমাণও যৎসামান্য বলে জানান ভুক্তভোগীরা। 

প্রবাসীরা বিএমইটিতে প্রধানত চার ধরনের অভিযোগ করেন। এর মধ্যে বিদেশে গিয়ে চাকরি না পাওয়া, আকামা জটিলতা, বেতন ও চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পাওয়া। এসব বিষয়ে সরকারের দপ্তরটিতে অভিযোগ জানালে তা তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে নিষ্পত্তি করে বিএমইটি। 

বিএমইটির গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রবাসে হয়রানি ও নির্যাতনের বিষয়ে যত অভিযোগ পড়েছে তার নিষ্পত্তির হার সবচেয়ে কম। এর মধ্যে গত বছর অভিযোগ জমা পড়ে মোট ২ হাজার ৩৮০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৬৫টির। সে হিসাবে অভিযোগ নিষ্পত্তির হার ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ অভিযোগেরই কোনো সুরাহা হয়নি। আর যেসব নিষ্পত্তি হয়েছে তার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় হয় ৪ কোটি ৮৭ লাখ ৯১ হাজার টাকা। 

পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় ২০২২ সালে। হয়রানি, নির্যাতনসহ নানা বিষয়ে ওই বছর বিএমইটিতে ১ হাজার ২৪০টি অভিযোগ করেন বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী ও তাদের স্বজনরা। এর মধ্যে ৫৬৭টিই ছিল নারী প্রবাসী কর্মীদের। ওই বছর নিষ্পত্তি হয় ৩৩৯টি অভিযোগ। এসব খতিয়ে দেখে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২১ সালে অভিযোগ পড়ে ৫২৮টি, নিষ্পত্তি হয় ২৪০টি আর ক্ষতিপূরণ আদায় হয় ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০২০ সালে অভিযোগ পড়ে ৯০৫টি, নিষ্পত্তি হয় ৪২৪টি, ক্ষতিপূরণ আদায় হয় ২ কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে অভিযোগ পড়ে ৭৩২টি, নিষ্পত্তি হয় ৩৭৫টি এবং ২ কোটি ৫৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় হয়। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বাদল মিয়া। ভাগ্যবদলের আশায় সউল অ্যাসোসিয়েট নামে এক এজেন্সির মাধ্যমে গত বছরের মে মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে যান। বিনিময়ে উচ্চ সুদে ঋণ ওই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছিলেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ভালো কাজ, বেতন ও আকামা ছিল। কিন্তু এসবের কোনোটিই তিনি পাননি। বরং তাকে সেখানে নিয়ে দিনের পর দিন খাবার না দিয়ে আটকে রাখা হয়। চলে নির্যাতনও। পরে কোনোমতে ছাড়া পেলেও এখনো কাজ জোগাড় করতে পারেননি। বর্তমানে বাড়ি থেকে টাকা নিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন বাদল। এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাননি। 

এ অবস্থায় বাদলের স্ত্রী পারভীন গত বছরের ১৩ জুলাই বিএমইটিতে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে বিএমইটি থেকে চিঠি দেয়া হলেও সউল অ্যাসোসিয়েট নামে ওই এজেন্সি তার জবাব দেয়নি। ফলে বাদল মিয়াও কোনো সমাধান পাননি এখনো।

একইভাবে মালয়েশিয়ায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন কিশোরগঞ্জের প্রবাসী সাইফুল ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে উল্টো তাকেই জেলে পাঠানোর হুমকি দেয়া হয়। কোনো উপায় না পেয়ে সাইফুলের বাবা ছেলের জীবনের নিরাপত্তা ও মালয়েশিয়ায় ভালো কাজ পাওয়ার প্রত্যাশা জানিয়ে বিএমইটিতে লিখিত অভিযোগ দেন। চার মাস আগে জমা দেয়া ওই অভিযোগের বিষয়ে সরকারের সংস্থাটির কাছ থেকে ইতিবাচক আশ্বাস পেলেও এখনো সুরাহা হয়নি। 

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের পর্যবেক্ষণ বলছে, বিদেশে যেতে অনেক প্রবাসী জমি বিক্রি, ধার-দেনা এমনকি ঋণ করে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এসব নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেখানে গিয়ে কাজ না পাওয়া, বেতন ঠিকমতো না হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেই সঙ্গে কর্মস্থলে হয়রানি-নির্যাতন এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনাও বেড়ে চলেছে। 

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রবাসে হয়রানি-নির্যাতন বন্ধে আগে যেভাবে মনিটরিং করা হতো, এখন ওই কাজগুলো সেভাবে করা হচ্ছে না। ফলে নিষ্পত্তির হার আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে এটিও ঠিক, যেহেতু অভিযোগ আগের তুলনায় বেশি আসছে, ফলে নিষ্পত্তির হারটা আনুপাতিক হারে কম হচ্ছে। এ জায়গায় মনিটরিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা হয়নি। এটি করা দরকার ছিল।’ 

উদাহরণ দিয়ে রামরুর চেয়ারপারসন জানান, বিদেশে শ্রমিক হিসেবে একজন কর্মীর সরকারিভাবে খরচ ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হলেও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নিচ্ছে ৪-৫ লাখ টাকা। বিদেশে যাওয়ার জন্য কর্মীরা যে এজেন্সির কাছে টাকা দিচ্ছেন, এর তো কোনো লিখিত কাগজপত্র থাকছে না। ফলে কর্মীরা অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিদেশে গিয়ে কোনো বিপদে পড়লে এবং বিএমইটিতে অভিযোগ করে ক্ষতিপূরণ চাইলে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায় হয় না। এদিক থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেমন পার পেয়ে যায়, তেমনি সরকার নির্ধারিত খরচও কাগজে-কলমে থেকে যাচ্ছে। এ কারণে এসব অভিযোগ বছরের পর বছর ঝুলে যাচ্ছে। 

বিএমইটির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ কোনো প্রবাসী সংস্থাটির কাছে হয়রানি কিংবা নির্যাতনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করলে সেটি নিষ্পত্তি হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই সঙ্গে তা এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা জানান বিএমইটির কর্মকর্তারা। যদিও অভিযোগ পড়লে সেটি বছরের পর বছর নিষ্পত্তি না হওয়ার অনেক নজির রয়েছে। এমনকি সুরাহা চেয়ে অনেকদিন ধরে সংস্থাটির দ্বারে দ্বারেও ঘুরছেন অনেক ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা। 

বিদেশে গিয়ে প্রতারিত ও কর্মস্থলে হয়রানি ও জীবননাশের হুমকির মতো গুরুতর বিষয়গুলো নিয়ে বিএমইটির শীর্ষ পর্যায়ে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। বরং এসব বিষয় নিয়ে সংস্থাটি ধীরগতির পন্থা অভিযোগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে। এমনকি দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতায় প্রবাসে থাকা কর্মীদের হয়রানি-নির্যাতন বছরের পর বছর বেড়েই চলেছে।

জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌৬৪ জেলায় কর্মসংস্থান ও জনশক্তির কার্যালয় রয়েছে। এসব আঞ্চলিক কার্যালয় ভুক্তভোগী প্রবাসীদের অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত করবে। এ লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। দুই ব্যাচে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছে। যারা অভিযোগ করেন তারা অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন। তাদের পক্ষে পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন অভিযোগ করেন। অভিযোগ তদন্তের জন্য এজেন্সি ও ভুক্তভোগী দুই পক্ষেরই বক্তব্যের প্রয়োজন রয়েছে। অনলাইন ও অফলাইন দুই মাধ্যমেই যাতে অভিযোগগুলো দ্রুত সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে কাজ চলছে।’

আরও