বন্যায় বাস্তুহারা হালুয়াঘাটের শতাধিক পরিবার, মেলেনি সরকারি সহায়তা

ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে ৩ অক্টোবর বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলা।

ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে ৩ অক্টোবর বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলা। এর মধ্যে নেমে গেছে বন্যার পানি। তবে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে বন্যার ক্ষত। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হালুয়াঘাট উপজেলা। সেখানে বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। কেউ কেউ ভাঙা ঘরের মেঝেতে, কেউ আবার অন্যের বাড়িতে থাকছেন। তবে ঘরবাড়ি হারালেও সরকারি কোনো সহায়তা পাননি বলে দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

হালুয়াঘাট পৌরসভার দক্ষিণ মনিকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সীমা ঋষি (৪০)। তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে বছরখানেক আগে মারা গেছেন তার স্বামী। অভাবের সংসারে স্বামীর রেখে যাওয়া মাটির ঘরটিই ছিল তার শেষ আশ্রয়স্থল। রোজগার না থাকায় পাঁচ মাস আগে সন্তানদের নিয়ে পাড়ি দেন ঢাকায়। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করনে। যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে কোনো রকম চলে তার। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন। সংসারের জন্য কিছু জিনিসপত্র ক্রয় করে আবারো চলে যেতেন ঢাকায়। ৪ অক্টোবর টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সীমার মাটির ঘরটি ভেঙে যায়। ঘরের সবকিছুই মাটির নিচে চাপা রয়েছে। আত্মীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঢাকা থেকে সেদিন রাতেই ছুটে যান বাড়িতে।

সীমা ঋষি বলেন, ‘স্বামীর রেখে যাওয়া সম্বলটুকু এভাবে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। চার সন্তান নিয়ে এখন বাস্তুহারা। ঘরটিতে ৪০ হাজার টাকা মূল্যের আসবাব ছিল। তবে সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা তো দূরের কথা, কেউ দেখতেও আসেননি। পাশেই ভাঙ টিনের ঘরে মেঝেতে দিন পার করছি। নতুন করে ঘর তৈরি করবে, সে সামর্থ্যও নেই।’

একই গ্রামে বাড়ি পলাশ ঋষির (২৮)। সেলুনে কাজ করেন তিনি। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। বন্যায় তার মাটির ঘরটি ভেঙে গেছে। ৫ অক্টোবর রাতে ঘরটি মাটিতে মিশে যায়। তিনি ও তার পরিবার রক্ষা পেলেও ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। সন্তানদের তিনিও এক বড় ভাইয়ের বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন।

পলাশের স্ত্রী খুকি ঋষি বলেন, ‘আমার সন্তান রাতে অন্যের বাড়ির বারান্দায় ঘুমাতে চায় না। তাকে কীভাবে বোঝাব আমাদের সংসারের সবকিছুই যে শেষ হয়ে গেছে। বন্যার পর থেকে সেলুনে কাজ নেই বললেই চলে। এখন আমাদের আত্মীয়রা কিছু খাবার দিলে খাই, না হলে না খেয়ে থাকি। ঘর যে নির্মাণ করব তার কোনো অর্থ আমাদের কাছে নেই। এভাবে আর কতদিন চলবে জানি না। সরকারের তরফ থেকে এক প্যাকেট মুড়িও পাইনি।’

শুধু সীমা ও পলাশ ঋষি নন, বন্যা হালুয়াঘাটের অনেক পরিবারই নিঃস্ব হয়েছে। উপজেলার জুগলী ও কৈচাপুর ইউনিয়নে বেশি ক্ষতি হয়েছে। সেখানে কমপক্ষে ১০০টির বেশি ঘর বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে।

জুগলী ইউনিয়নের ঘোষবেড় এলাকায় বাড়ি লাভলী আক্তারের (৩৫)। দুই মেয়ে রেখে বছর খানেক আগে স্বামী মারা গেছেন। টিনের ছাপড়া ঘরে থাকেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বন্যায় তার টিনের ছাপড়া ঘর ভেঙে গেছে। একেক দিন একেজনের বাড়িতে থাকেন তিনি। কখনো কেউ খাবার দিলে খেতে পারেন, না দিলে না খেয়েই থাকতে হয়। সরকারি সাহায্য দূরের কথা, কেউ দেখতে পর্যন্ত আসেননি বলে জানান লাভলী। কীভাবে নতুন ঘর করবেন, সে ব্যবস্থাও নেই।

উপজেলার পৌরসভা, জুগলী, ভুবনকুড়া ও কৈচাপুর ইউনিয়নে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে বন্যার ক্ষতি। বাস্তুহারা মানুষের অভাব আরো দীর্ঘ হচ্ছে। কারো থাকার ঘর নেই, খেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের কাছে ক্ষতির সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এরশাদুল আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যদি এ বিষয়ে কেউ ফোন করে, বিশেষ করে আমার কাছে, তখন আমরা ত্রাণ পৌঁছে দিই। কোথায় ত্রাণ পৌঁছায়নি সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারলে ত্রাণ পৌঁছে দেব। আমরা দুর্গম অঞ্চলেও ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছি।’

উপজেলার কতটি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—এ বিষয়ে তথ্য আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যেই এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। যেহেতু এখনো চারটি ইউনিয়নে পানি স্থির অবস্থায় রয়েছে। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে ক্ষতির তথ্য পাওয়া যাবে।’

আরও