সিন্ধু অববাহিকাকে ঘিরে হওয়া পানির হিস্যাটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ও দীর্ঘ সময় ধরে চালু থাকা আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন চুক্তি। ‘ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’ বা সিন্ধু জল চুক্তি নামে পরিচিত এ সমঝোতাটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল বিশ্বব্যাংক।
সিন্ধু এবং তার পাঁচ উপনদ বিতস্তা (ঝিলম), চন্দ্রভাগা (চেনাব), ইরাবতী (রবি), বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সতলুজ) ভারত থেকে পাকিস্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এ নদগুলোর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ভাগাভাগি করাই এ চুক্তির লক্ষ্য। আর তা বাস্তবায়ন এবং চুক্তি সম্পর্কিত যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তিতে গঠন হয় ‘সিন্ধু কমিশন’। গত ৬৪ বছর এ কমিশন বেশ সফলতা দেখিয়েছে।
অপরদিকে ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তি’ সই হয়। এ চুক্তি অনুসারে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত হয় যৌথ নদী রক্ষা কমিশন (জেআরসি)। তবে ৫২ বছর পার হলেও আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টন নিশ্চিতে এ কমিশন তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া সিন্ধু জল চুক্তিটিকে শক্তিশালী করেছে বিশ্বব্যাংকের উপস্থিতি। আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাটি যুক্ত থাকায় ভারত বা পাকিস্তান কেউই এ চুক্তিকে উপেক্ষা করে কোনো কাজ করতে পারছে না। যেকোনো কাজের আগে অপর দেশকে অবগত করতে হচ্ছে এবং কোনো বিষয় নিয়ে দ্বিমত দেখা দিলে তা সমাধানে নিতে হচ্ছে উদ্যোগ।
এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ নদী সিন্ধু ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীটি চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বত থেকে উৎপত্তি লাভ করে জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিলগিট-বালতিস্তান ও হিন্দুকুশ দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। পরে এটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পড়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ দুটি স্বাধীন হওয়ার পরপরই নদীটি নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল সিন্ধু নদী। ভারত ওই বছর পাকিস্তানে পানিপ্রবাহে বাধা দেয়। পরবর্তী সময়ে বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়ার শর্তে পাকিস্তানকে পানি সরবরাহে সম্মত হয় ভারত। তবে দুই দেশ এ নিয়ে কোনো স্থায়ী সমাধানে পৌঁছতে পারছিল না।
এর মধ্যে টেনেসি ভ্যালি অথরিটি এবং ইউএস অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ডেভিড লিলিয়েনথাল ওই অঞ্চল ভ্রমণে যান। সমস্যার সমাধান হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সিন্ধু নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তির পরামর্শ দেন। এরপরই বিশ্বব্যাংক বিষয়টিতে যুক্ত হয়, অচলাবস্থা সমাধানের জন্য ১৯৫৪ সালে একটি প্রস্তাব পেশ করে। দীর্ঘ ছয় বছর আলোচনার পর ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান সিন্ধু জল চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি অনুযায়ী সিন্ধু, বিতস্তা ও চন্দ্রভাগার পানির ওপর পাকিস্তানের অধিকার বেশি। আর ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রুর ওপর অধিকার বেশি ভারতের। চুক্তিটি বাস্তবায়নে উভয় দেশ থেকে একজন করে কমিশনার নিয়ে গঠিত হয় স্থায়ী সিন্ধু কমিশন। চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী কমিশন নিয়মিত ভ্রমণ ও তথ্য আদান-প্রদান এবং বছরে অন্তত একটি সভা করে থাকে। ৬৪ বছর ধরেই তা মেনে চলেছে দেশ দুটি। এমনকি ভারত-পাকিস্তান বেশ কয়েকটি সামরিক সংঘাতে জড়ালেও পানি বণ্টনের ওপর প্রভাব ফেলেনি। এখন পর্যন্ত সব কাজই বেশ সফলতার সঙ্গে করেছে এ কমিশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমিশন মোট ১১৭টি সভা করেছে। এছাড়া চুক্তি সম্পর্কিত যেসব মতবিরোধ দেখা দিয়েছে তা চুক্তিতে উল্লেখিত উপায়ে ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছে।
তবে দুটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে ভারত নদীর পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং সিন্ধু চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করছে, ২০১৬ সালে এমন অভিযোগ তোলে পাকিস্তান। পরে বিতর্ক মীমাংসার চেষ্টায় ভারতের অনুরোধে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং পাকিস্তানের অনুরোধে পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের (পিসিএ) চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এ দুটি প্রক্রিয়া নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে কমিশন।
দুই দেশের পারস্পরিক চুক্তিতে নির্মাণ করা হয়েছে সালাল বাঁধ। তুলবুল প্রকল্পটি কয়েক দশক ধরে ছাড়পত্রের জন্য ঝুলে আছে। বিরোধ বা মতানৈক্যের ক্ষেত্রে যথাক্রমে পিসিএ ও একজন নিরপেক্ষ কারিগরি বিশেষজ্ঞকে সালিশের জন্য ডাকা হয়। বাগলিহার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞের রায় অনুসরণ করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক ওই বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করে। কিষাণগঙ্গা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্যও ভারতকে পিসিএ রায় অনুসরণ করতে হয়েছিল। সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই সালিশি আদালত স্থাপন করা হয় ২০১০ সালে।
অপরদিকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার নদীগুলো ব্যবস্থাপনায় ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করা হয়। দুই দেশের মধ্যে মোট নদী ৫৪টি। সেচ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব নদীর পানিসম্পদ ভাগাভাগির মতো বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই ছিল এটির মূল উদ্দেশ্য। তবে জেআরসির কার্যপদ্ধতি অনুযায়ী বছরে চারটি সভা করার কথা ছিল। সে হিসাবে অর্থাৎ ৫২ বছরে ২০৮টি জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু বাস্তবে কমিশন আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে কেবল ৩৮টি সভা।
৫২ বছরে এ কমিশনের সাফল্য বলতে শুধু গঙ্গা চুক্তি। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তি সই করেন। এ চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের ন্যায্যভাবে পানি ভাগ করে নেয়ার কথা ছিল। যৌথ নদী কমিশনের ২০২৪ সালের তথ্য বলছে, এ বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পানির ন্যায্য অংশ পেয়েছে। যদিও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর রাজশাহী অঞ্চলে পানি সংকট এবং নদী শুকিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের সঙ্গে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে আগে যেখানে নদী ছিল সেখানে এখন বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চাষাবাদ হয়। এছাড়া ২০২৬ সালে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। সম্প্রতি এ চুক্তি নবায়নের বিষয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন, যা এ চুক্তির ভবিস্যৎকেও শঙ্কায় ফেলেছে।
এছাড়া, ১৯৮৩ সালে একটি স্বল্পমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২০১১ সালে ১৫ বছরের জন্য তিস্তা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার জেরে চুক্তিটি স্থগিত হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এ বিষয়টি সমাধানে আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি কমিশন। ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টনের জন্যও ১৯৯৭ সালে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তবে ২৭ বছরে এ কার্যক্রমও কেবল সচিব পর্যায়ে আলোচনা ও ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নেই সীমাবদ্ধ।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিবেশী হিসেবে যেমন সম্পর্ক থাকা দরকার সেটি নেই। যেকোনো পারস্পরিক সম্পর্কে একটি রাষ্ট্রের দুটি বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিত। প্রথমটি হলো তার ডিগনিটি এবং দ্বিতীয়টি রাষ্ট্র তথা জনকল্যাণ। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোর ঘাটতি ছিল বাংলাদেশের দিক থেকে। যেমন কোনো যৌথ নদীতে কোনো দেশ একক সিদ্ধান্তে বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না, অপর দেশের অনুমতি নিতে হয়। আবার বাঁধ নির্মাণের পরও নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করতে হয়। বাঁধ খুলে দেয়ার আগে জানাতে হয়। কিন্তু ভারত এগুলো মান্য করেনি। বাংলাদেশও গত ১৫ বছরে এসবের কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে নদীগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সহযোগিতা নিতে পারে। তবে তার জন্য বাংলাদেশকে আগে জাতিসংঘের পলিসির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। তাকে ইউএন ওয়াটার কোর্সেস কনভেনশনে স্বাক্ষর করতে হবে। তখন এ ধরনের বিষয়গুলোয় জাতিসংঘের সহযোগিতা নেয়া যাবে এবং কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি হলে দেশগুলো সেটি মেনে না চললে বা কোনো চুক্তি ভঙ্গ করলে জাতিসংঘের সহযোগিতা নেয়া যাবে।
এ বিষয়ে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন এবং পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাঈদের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।