দুজনের দেশ আলাদা। সমসাময়িকও নন তারা। কিন্তু উভয়েই চিত্রশিল্পী। এটি সাধারণ মিল। তাদের মধ্যে একটি বিশেষ মিলও আছে। সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেরই চিত্রকর্মে বিষয়বস্তু হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে কৃষিজীবী সম্প্রদায়। তাই ১৮১৪ সালের ৪ অক্টোবর ফ্রান্সের নরম্যান্ডি প্রদেশের গ্রুচি গ্রামে জন্ম নেয়া চিত্রশিল্পী জ্যঁ ফ্রাঁসোয়া মিলের চিত্রকর্মগুলো দেখলে ১৯১৩ সালের ১০ আগস্ট বাংলাদেশের নড়াইলে জন্ম নেয়া এসএম সুলতানের কথা মনে পড়বে। তেমনি সুলতানের কাজ দেখলে মনে হবে মিলের কথা। নিজের চিত্রকর্মে কৃষকদের মহিমা, গৌরব ও শক্তিমত্তা ফুটিয়ে তুলেছেন সুলতান। মিলেও তার চিত্রে কৃষকদের ভাবগাম্ভীর্য, কঠোর পরিশ্রম ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন এঁকেছেন। এ কারণে তার গায়ে এঁটে দেয়া হয়েছে ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী’র তকমা। কিন্তু তাতে তিনি মোটেই বিচলিত হননি। কৃষকদের প্রতি মিলের এ দরদ বহু চিত্রশিল্পীকে প্রভাবিত করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ ও সালভাদর দালি। মিলের চিত্রকর্মগুলো তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। এর মধ্যে ১৮৫৭-৫৯ সালের মধ্যে তেল রঙে আঁকা ‘দি অ্যাঞ্জেলাস’ (ভক্তিগীতি) শিরোনামের চিত্রকর্মটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রার্থনার জন্য কৃষিকাজে বিরতি দিয়েছেন দুই কৃষক। পুরুষ ও নারী। মাথা নিচু করে তারা প্রার্থনা করছেন। পাশে পড়ে আছে কৃষিকাজের উপকরণ। উনিশ শতকে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে দিনে তিনবার (সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা) চার্চের ঘণ্টা বাজানোর মাধ্যমে কৃষকদের প্রার্থনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো। ‘দি অ্যাঞ্জেলাস’ চিত্রে গ্রামীণ কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের জীবনের সে দিকটিই সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মিলে। তার চিত্রকর্মটি ভ্যান গঘ ও দালিকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে দুজনেই মূল বিষয় ঠিক রেখে নিজেদের মতো করে চিত্রকর্মটি এঁকেছেন। দি অ্যাঞ্জেলাসের অনুকরণে আঁকা ভ্যান গঘের চিত্রকর্মটির নাম ‘দি অ্যাঞ্জেলাস, আফটার মিলে’। এটি ছাড়া মিলের আরো বহু চিত্রকর্ম নিজের মতো করে এঁকেছেন ভ্যান গঘ। মিলের প্রভাবে ভ্যান গঘের চিত্রকর্মেও কৃষক বিষয় হয়ে এসেছে। এর মধ্যে ১৮৮৯-৯০ সালে আঁকা তার ‘দ্য সিয়েস্তা’ চিত্রকর্মের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি এটি মিলের ১৮৬৬ সালে আঁকা ‘নুনডে রেস্ট’-এর অনুকরণে এঁকেছিলেন। এ দুটি চিত্রকর্মে দেখা যায় এক নারী কৃষক জমিতে কাজের বিরতিতে পাশে শোয়া পুরুষ সঙ্গীটির বুকের কাছে মাথা রেখে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ১৮৬৯ সালে প্যাস্টেল রঙে আঁকা মিলের ‘উইন্টার ইভনিং’ অনুকরণে তিনি ১৮৮৯ সালে এঁকেছেন ‘ইভনিং’। ডাচ এ চিত্রশিল্পী মিলের কাজ দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে তিনি বলেছেন, ‘তরুণ চিত্রশিল্পীদের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অভিভাবক, উপদেষ্টা ও পথপ্রদর্শক হলেন মিলে।’ ভ্যান গঘ তাকে ‘ফাদার মিলে’ বলে অভিহিত করেছেন। আর দি অ্যাঞ্জেলাসের অনুকরণে স্যুররিয়াল চিত্র আঁকা সালভাদর দালির জন্য রীতিমতো অবসেশনে পরিণত হয়েছিল। দি অ্যাঞ্জেলাসের বিষয়ের ভিত্তিতে তিনি ১৯৩২ সালে একটি, ১৯৩৩ সালে দুটি ও ১৯৩৪ সালে একটি চিত্র এঁকেছিলেন। তিনি এটিকে তার দেখা অবচেতন চিন্তার ‘সবচেয়ে রহস্যময়, গভীর ও সমৃদ্ধ’ উপস্থাপন বলে মন্তব্য করেছেন।
সচ্ছল
এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম। বাবা জ্যঁ লুই নিকোলা ও মা হেনরি
মিলের প্রথম সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে কৃষিকাজে সাহায্য করতেন তিনি। তাই লাঙল চালানো, বীজ বপন করা, ফসল কাটা, আঁটি বাঁধা, খড় তৈরি করা,
মাড়াই, খোসা ঝাড়া, সার দেয়াসহ যাবতীয় কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তিনি। আর এগুলোই হয়ে
উঠেছে তার চিত্রকর্মের মূল উপাদান। একে একে তিনি এঁকেছেন ‘দি অ্যাঞ্জেলাস’, ‘দ্য সোয়ার’, ‘দ্য
গ্লিনার্স’, ‘দ্য
পটেটো হার্ভেস্ট’-এর
মতো চিত্রকর্ম। প্রতিটি চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে কৃষকের প্রতিচ্ছবি। দ্য সোয়ার চিত্রকর্মে একজন কৃষককে মাঠে বীজ ছড়াতে দেখা যায়। দ্য গ্লিনার্সে দেখা যায় তিন কৃষক মাঠ থেকে শস্যের শীষ কুড়াচ্ছেন। এভাবে বার বার কৃষি ও কৃষক হয়েছে
তার চিত্রকর্মের উপজীব্য।
ফরাসি চিত্রশিল্পী জ্যঁ ফ্রাঁসোয়া মিলেকে উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিত্রশিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চিত্রশিল্পে রিয়েলিজমের তিনি অন্যতম পুরোধা। আজ এ চিত্রশিল্পীর জন্মদিন। তার প্রতি শ্রদ্ধা।