শাসক, ক্ষমতাসীন বা প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম কার্টুন। চিত্র বা অঙ্কনের এ ধারা শুরুর পর থেকে তা মানুষকে যেমন বিনোদন দিয়েছে, তেমনি কার্টুনিস্টরা এর মাধ্যমে করেছেন প্রতিবাদ। বাংলাদেশেও এককালে কার্টুন আঁকা হতো প্রচুর। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতাতেই ছাপা হতো। সাপ্তাহিক, মাসিকের পাতাতেও থাকত। কিন্তু দীর্ঘদিনের একদলীয় শাসনে এ বিষয়ে আসে নানা রকম চাপ। প্রিন্ট মিডিয়া পিছিয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্টুন প্রকাশ করেছেন কার্টুনিস্টরা। এরপর আসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। তুলি-কলমের ওপর আসে আঘাত। কিন্তু কার্টুন আঁকা থেমে থাকেনি। জুলাই ২০২৪-এ আবার ফিরে আসে কার্টুন। আওয়ামী লীগের অপশাসন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আঁকা হয়েছিল বহু কার্টুন। তাই নিয়েই আয়োজিত প্রদর্শনী ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’।
পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনে চলমান এ প্রদর্শনীতে ৮২ জন শিল্পীর আঁকা ১৭৫টি কার্টুন। তুলনামূলক ছোট জায়গায় হলেও আয়োজনটি পরিচ্ছন্ন। আয়োজকরা জানেন তারা কী প্রদর্শন করতে চাচ্ছেন। স্পষ্টতই তারা ছাত্র আন্দোলনের সময়টাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে। কেননা এ প্রদর্শনীতে থাকা কার্টুনগুলো সে সময়ের সাক্ষ্য দেয়। দেয়ালে ঝুলে থাকা এক একটা কার্টুনে স্বৈরশাসকের প্রতি বিদ্রুপ। দেখা যায় শেখ হাসিনার অনেক ব্যঙ্গচিত্র। এর মধ্যে তার কাট আউটও আছে। ব্যঙ্গচিত্র থেকে কাট আউট করার চিন্তাটি দারুণ। মেট্রোরেল পরিদর্শনে গিয়ে মেট্রোর দুঃখে কাঁদা (কিংবা কান্নার অভিনয় করা) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাট আউট কার্টুনের সঙ্গে ছবি তুলে অনেকেই পোস্ট করে লিখছেন, ‘নাটক কম করো পিও।’
প্রদর্শনীর মূল পোস্টারে শেখ হাসিনার ছবিটি মেহেদী হকের আঁকা। হিটলারের সালামের আদল খুঁজে পাওয়া যাবে এতে। তারই আঁকা একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে আয়মান সাদিককে নৌকা থেকে ফেলে দিচ্ছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। প্রোফাইল পিকচার লাল করার কারণে ১০ মিনিট স্কুলের আর্থিক সুবিধা বাতিল করার বিষয়টি রয়ে গেল এ কার্টুনের মধ্যে। মাহতাব রশীদের কার্টুনে আছে হাসিনার আমিত্ব। আমি, আমার দুটি শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার কার্টুন। আছে তীর্থর আঁকা টাইপোগ্রাফিতে লেখা স্বৈরাচার। আছে হেলমেট পরা ছাত্রলীগ পোষার কার্টুন। বাদ যায়নি হারুনের ভাতের হোটেলও।
কেবল এরাই না, কার্টুনে আছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া প্রতিবাদী মুখও। একাধিক চিত্রে আছেন আবু সাঈদ। তার প্রতিরোধের চিত্র এঁকেছেন মাহতাব রশীদ, অ্যারন নবী। চমৎকার একটি আয়োজন আছে মীর মাহফুজ মুগ্ধকে নিয়ে। বেশকিছু পানির বোতল সুতোয় বেঁধে ঝোলানো আছে প্রদর্শনীর এক অংশে। ছোট ছোট বোতলগুলোর লেবেলে লালের মাঝে সাদা অক্ষরে লেখা মুগ্ধর নাম।
আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত আছেন তরুণ শিল্পী, কার্টুনিস্ট ও চারুকলার শিক্ষার্থীরা। দেবাশীষ চক্রবর্তীর পোস্টার, অপু, মাহতাব রশীদ, মেহেদী হকের পাশাপাশি আছেন নাতাশা জাহান, এশা নাওয়ার, আকিফা হক প্রিমা, ফারশিদ রশিদ প্রমুখ তরুণরা। তারা সবাই এ আন্দোলনের পুরোটা সময় ছিলেন সরব। সৌহাত রাশেদিন সৌখিন জানান, গ্রাফিতি এঁকে গেছেন তারা আন্দোলনের সময়। খেয়েছেন ধাওয়া। তার পরও দেয়ালে এঁকেছেন, কার্টুন করেছেন।
সে সবকিছু নিয়েই এ আয়োজন। দৃকের লেভেল এইটে গেলে মনে হবে বিদ্রোহের সময়টা দর্শনার্থীর সামনে ফুটে রয়েছে। যারা সে সময়টা দেখেছেন তারা সহজেই নিজেদের সঙ্গে মেলাতে পারবেন। যারা দেখেননি তাদের জন্যও এ আয়োজন ও সংগৃহীত কার্টুনগুলো ভবিষ্যতে আন্দোলনের দলিল হয়ে থাকবে। বিদ্রোহের দিনগুলোর সাক্ষ্য দেবে কার্টুন।