মোগল আমলের নারী চিত্রশিল্পীরা

ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর ‘ভারত কলাভবন’। সেখানে ভারতীয় চিত্রকর্মের নানা দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংরক্ষিত।

ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর ‘ভারত কলাভবন’। সেখানে ভারতীয় চিত্রকর্মের নানা দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংরক্ষিত। সবই আকর্ষণীয়। উপভোগ্য। এর মধ্যেও একটি চিত্রকর্ম আলাদাভাবে সমঝদার দর্শনার্থীদের নজর কাড়বে। চিত্রকর্মে তিন নারী। তাদের মধ্যে একজন চিত্রশিল্পী। হাঁটুর ওপর ক্যানভাস রাখা। বাম হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন। ডান হাতে ধরা তুলি। সামনে বসা আরেক নারীর প্রতিকৃতি আঁকছেন তিনি। ঠিক পেছনে বসে আরেক নারী মুগ্ধ হয়ে চিত্রশিল্পীর কাজ দেখছেন। চিত্রকর্মটি মোগল আমলে আঁকা হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের শাসনকালে অঙ্কিত দুর্লভ চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। চিত্রকর্মটি মোগল আমলে নারী চিত্রশিল্পীদের উপস্থিতির চমৎকার দলিল।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল শাসকরা শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সম্রাট আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে বড় একটি চিত্রশালা স্থাপন করেছিলেন। সেখানে শত শত চিত্রশিল্পী ছিলেন। তাদের অনেকেই পারস্য থেকে এসেছিলেন। সে সময়ের দুজন চিত্রশিল্পী বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। পারস্যের মীর সৈয়দ আলী তাবরিজি ও খাজা আবদুস সামাদ। তারা সম্রাট হুমায়ুনের আমন্ত্রণে দিল্লিতে এসেছিলেন। খাজা আবদুস সামাদ কাবুলে এক রাজকীয় চিত্রশালা স্থাপন করেছিলেন। আর মীর সৈয়দ আলী তাবরিজি স্থাপন করেছিলেন দিল্লিতে। ফার্সি পাণ্ডুলিপির অলংকরণ ও সৌন্দর্যবর্ধনে এসব শিল্পী অবদান রেখেছিলেন। সম্রাট আকবরের অন্যতম সভাসদ আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে অসংখ্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছেন। তারা সবাই পুরুষ। নারী শিল্পীদের বর্ণনা নেই বললেই চলে। তবে জন্ম, বিয়ে, পারিবারিক দৃশ্য ইত্যাদি থিমের ওপর অঙ্কিত অনেক চিত্রকর্ম নারীদের ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।

সম্রাট আকবরের শাসনামলে তেমন কোনো নারী চিত্রশিল্পীর উল্লেখ পাওয়া না গেলেও তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে চিত্রকর্মের একটি সংকলন তৈরি করা হয়েছিল। এর নাম ‘মুরাক্কা-ই-গুলশান’। সে সংকলনে কয়েকজন নারী চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি’র বর্ণনা অনুসারে, তিনি ১৫৮৫ সালে ফতেহপুর সিক্রিতে একটি চিত্রশালা স্থাপন করেছিলেন। তিনি পারস্যের চিত্রশিল্পী আকা রেজা হেরাতিকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে মোগল হারেম তথা জেনানা মহলের নারীরা চিত্রশিল্পের সবক নিতেন বলে এক দলিলে জানা যায়। তেহরানের গুলিস্তান প্যালেস লাইব্রেরিতে নাদিরা বানুর কয়েকটি এনগ্রেভিং সংরক্ষিত আছে। সেসব চিত্রকর্মে তার স্বাক্ষরের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে আকা রেজা হেরাতির নাম উল্লেখ আছে। তবে মোগল হারেমের নারী চিত্রশিল্পীরা সাধারণত বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের মৌলিক কাজগুলোর প্রতিরূপ তৈরি করতেন। এক্ষেত্রে তারা বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কিছু জায়গায় নিজেদের সৃজনশীলতার ছাপও রেখেছেন। তারা পারস্যের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী বিহজাদ ও আগা মিরাকের মৌলিক চিত্রকর্মের অনুকরণ করেছেন। ইউরোপের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের এনগ্রেভিং ও মিনিয়েচারের প্রতিরূপও তারা এঁকেছেন। এসব চিত্রকর্মের মধ্যে বাইবেল ও খ্রিস্টধর্মের বিষয়বস্তু যেমন ‘ম্যাডোনা’, ‘দি অ্যানানসিয়েশন’ ইত্যাদিও ছিল।

নাদিরা বানু সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রেই আঁকাআঁকির নেশা পেয়েছিলেন। তার পিতা মীর তকি একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। নাদিরা বানু মোগল আমলের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী আবুল হাসানের সমসাময়িক ছিলেন। আবুল হাসান ছিলেন নাদিরা বানুর গুরু আকা রেজা হেরাতির পুত্র। নাদিরা বানু ইউরোপীয় এনগ্রেভিংগুলোর প্রতিরূপ তৈরিতে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ‘মুরাক্কা-ই-গুলশান’ চিত্রসংকলনে তার আঁকা কয়েকটি এনগ্রেভিং জায়গা করে নিয়েছে। সংকলনটি বর্তমানে তেহরানের গুলিস্তান প্যালেস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। ১৬০০-০৪ সালের মধ্যে তিনি চিত্রকর্মগুলো এঁকেছিলেন। চিত্রকর্মে সম্পৃক্ত তার স্বাক্ষর থেকে এটি জানা যায়। নাদিরা বানুর চিত্রকর্মগুলো পিটার ক্যানডিডো ও মার্টিন-ডে-ভোসের মৌলিক কাজগুলোর খুব কাছাকাছি। ধারণা করা হয় যে এ ব্যাপারে মোগল দরবারের জেসুইট চিত্রশিল্পীরা নাদিরা বানুকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ফাদার জেরোমে হাভিয়েরের এক প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায়, সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারের চিত্রশিল্পীদের দেয়ালচিত্র অঙ্কনের ব্যাপারে নির্দেশনা নেয়ার জন্য জেসুইটদের কাছে পাঠানো হতো। সে দলে সম্ভবত নাদিরা বানুও ছিলেন। মোগল আমলের নারী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে নাদিরা বানু বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন।

মোগল আমলের আরেক বিখ্যাত নারী চিত্রশিল্পী হলেন রোকেয়া বানু। তিনি পারস্যের চিত্রশিল্পীদের অনুকরণে চিত্রকর্ম এঁকেছেন। বিভিন্ন ইউরোপীয় চিত্রকর্মের প্রতিরূপও তিনি তৈরি করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ‘সিটেড ইউরোপিয়ান ন্যুড মেন’। তিনি চিত্রকর্মটি ১৬৩০ সালে এঁকেছিলেন। ‘মুরাক্কা-ই-গুলশান’ সংকলনে ঠাঁই পাওয়া চিত্রকর্মটির একটি এনলার্জড কপি ডাবলিনের চেস্টার-বেটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এটি ফ্লেমিশ চিত্রশিল্পী জোহানেস স্যাডেলারের একটি এনগ্রেভিংয়ের অনুকরণে এঁকেছিলেন রোকেয়া বানু। অনুকরণ হলেও চিত্রকর্মটিতে নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন রোকেয়া বানু। স্যাডেলারের চিত্রকর্মে পেশিবহুল এক মানুষকে দেখা যায়। রোকেয়া বানু তার চিত্রকর্মে পেশির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে মানুষটির মধ্যে বেশ সৌম্য ভাব এসেছে। মানুষটি একটি গাছের নিচে বসে আছে। তার পেছনে বসে আছে একটি কুকুর। অর্থাৎ, রোকেয়া বানু মানুষটিকে তার চিত্রকর্মে একজন সাধক হিসেবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে নারী চিত্রশিল্পী হিসেবে সহিফা বানু নাম করেছিলেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, তার প্রকৃত নাম শাফিয়া বানু। জাহাঙ্গীর তাকে সহিফা বানু উপাধি দিয়েছিলেন। সে নামেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দ্য সন হু মর্নড হিজ ফাদার’। এটি বিখ্যাত ফার্সি কাব্য ‘মানতিক-আত-তয়্যার’-এর একটি দৃশ্যের ইলাস্ট্রেশন। ১৬২০ সালে তিনি এটি এঁকেছিলেন। মূল চিত্রকর্মটি ১৫ শতকের। এঁকেছিলেন পারস্যের খ্যাতনামা ক্যালিগ্রাফার সুলতান আলী আল মাশহাদি। সহিফা বানুর আঁকা প্রতিরূপটি আগা খান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। তার আরেকটি চিত্রকর্মের নাম ‘দ্য বিল্ডিং অব দ্য ক্যাসেল অব খাওয়ারনাক’। এটি বিহজাদের একটি চিত্রকর্মের অনুকরণ। তবে সেখানে নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন তিনি। বিহজাদের দ্বিমাত্রিক ভবনের পরিবর্তে তিনি ত্রিমাত্রিক দালান এঁকে নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। চিত্রকর্মটি গুলিস্তান প্যালেস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। 

তবে সহিফা বানুর আঁকা ইরানের শাহ তামাস্পের একটি প্রতিকৃতি তাকে বহুল পরিচিতি দিয়েছে। গবেষকদের ধারণা, এটিও পারস্যের বিখ্যাত কোনো শিল্পীর সফল অনুকরণ। শাহ তামাস্প চিত্রশিল্পের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার দরবারের দুজন চিত্রশিল্পী সম্রাট হুমায়ুনের সভায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। সহিফা বানুর আঁকা প্রতিকৃতিতে দেখা যায়, শাহ তামাস্প একটি গাছের নিচে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে আছেন। পাশে বয়ে যাচ্ছে ছোট একটি নদী। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত চিত্রকর্মটির নিচে আরবি হরফে শাহ তামাস্পের নামের পাশে চিত্রকর হিসেবে সহিফা বানুর নাম লেখা আছে।

নিনি নামে মোগল আমলের আরেক চিত্রশিল্পীর নাম পাওয়া যায়। ‘দ্য মার্টায়ারডম অব সেইন্ট সিসিলিয়া’ এঁকে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। এটিও ইউরোপীয় একটি এনগ্রেভিংয়ের অনুকরণ।

মোগল আমলে চিত্রশিল্পী হিসেবে এ কয়েকজন নারীর নাম পাওয়া যায়। তারা নিজেদের চিত্রকর্ম দিয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এখনো তাদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন।

আরও