ডিসেম্বর, সাল ১৯৪৬। তিনি তখন কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বিখ্যাত বামপন্থী নেতা সোমনাথ লাহিড়ী ও নৃপেন চক্রবর্তী তাকে তেভাগা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করার জন্য রংপুরে যেতে বললেন। ১৭ ডিসেম্বর রাতে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণীর কম্পার্টমেন্টে চড়ে কলকাতা থেকে রংপুরে আসেন সোমনাথ হোর। এ প্রসঙ্গে ‘তেভাগার ডায়েরি’তে তিনি লেখেন, ‘১৯৪৬-এ তেভাগা আন্দোলন একটি অসাধারণ কৃষক সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।...এর তিন বছর আগে ১৯৪৩ সনে বাংলায় প্রলয়ংকরী মন্বন্তর ঘটে গেছে।...আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টির আনুকূল্যে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র এবং “স্বাধীনতা” দৈনিকে কিছু কাজ করি। থাকি ৭৭ নং ধর্মতলা স্ট্রিটের কমিউনে, কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের আশ্রয়ে। সোমনাথ লাহিড়ী ও নৃপেন চক্রবর্তী অকৃপণ স্নেহ করতেন। তাদেরই আগ্রহে যাই রংপুরে তেভাগা আন্দোলন দেখতে।’
সোমনাথ হোর একাধারে একজন চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, ভাস্কর, লেখক, পর্যটক, রাজনীতিবিদ এবং সবকিছুর ওপরে একজন মানবদরদি। শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদে কেঁদে ওঠে যার মন। দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত ভুখা ও হাড় জিরজিরে মানুষ দেখে হৃদয়ের ভেতর মোচড় দেয়। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের উদ্দীপনা তাকে আন্দোলিত করে। সোমনাথ হোর তাই নিজেকে কোনো স্থানিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। ছুটে বেড়িয়েছেন চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল। এঁকেছেন মানুষের মুখ, তাদের দুঃখ, কষ্ট, নিপীড়ন ও সংগ্রামের ছবি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত সেসব বয়ান লিপিবদ্ধ করেছেন ডায়েরির পাতায়। তার রচিত ‘তেভাগার ডায়েরি’ হয়ে উঠেছে এ আন্দোলনের অন্যতম দলিল। তেভাগা আন্দোলনের বিবরণের পাশাপাশি অনেক স্কেচও সংযুক্ত করেছেন সেখানে। আশির দশকে শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বসে এক সাক্ষাৎকারে সোমনাথ হোর বলেছিলেন, ‘মানুষের এই বিবিধ যন্ত্রণা, কষ্টগুলো বারবার আমার চেতনায় ধাক্কা মারে, সহজে বিস্মৃত হতে পারি না।’ ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলা কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন অনেক প্রগতিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিককে আলোড়িত করেছিল। তাদের অন্যতম ছিলেন ১৯২১ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সোমনাথ হোর। সহজাত প্রতিভায় সৃজনশীল নানা খাতে নিজেকে প্রবাহিত করলেও মগজে ও মননে সোমনাথ হোর মূলত ছিলেন শিল্পী। তার কথায় তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে এভাবে, ‘আসলে আমি বক্তৃতা দিতে পারলে আমাকে বক্তৃতা দিতেই ডাকা হতো। কিন্তু আমি ছবি আঁকতেই পারতাম, লিখতে বা বক্তৃতা দিতে পারতাম না। সেই জন্যে আমাকে দিয়ে ওই কাজটাই করানো হতো।’ (শিল্পী সোমনাথ হোরের সঙ্গে কিছুক্ষণ, কুন্তল রুদ্র—যুবশক্তি, শারদ সংখ্যা ১৪০১, পৃ. ১১) ছবিতেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন মানুষের মুখ, তাদের জীবন। জীবনকে অনুসন্ধানের এক প্রবল তাড়না নিয়ে তিনি ছুটে গেছেন জনপদ থেকে জনপদে। স্বরচিত ‘চা-বাগিচার কড়চা’র ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘মাঝে মাঝে নেশার মতো পেয়ে বসত দরিদ্র শোষিত এই মানুষগুলির মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা। তাদের মুখে তাদের কথা শুনতাম, তাদের সঙ্গে ঘুরে মিটিংয়ে মিছিলে যেতাম, শিকারেও গেছি তীর, ধনুক, বল্লম নিয়ে, আর ভালোবেসে ছবি এঁকেছি।...অবলা, সুরধুনী, সূর্যমণিরা, যারা মালিকের লোকেদের তীব্র ঘৃণায় সরিয়ে রাখত, তারাই আমাদের অলাজ সুযোগ দিয়েছে ছবি আঁকার—কমরেড নামাঙ্কিত পাসপোর্ট ছিল বলে। তাদের, তাদের ছেলেমেয়েদের এবং স্বামীদের সেই প্রতিকৃতিগুলি আমার শিল্পকর্মে নানাভাবে যাওয়া-আসা করেছে।’
চিত্রকলায় সোমনাথ হোরের উদ্ভাসন ঘটে চল্লিশের দশকে। চট্টগ্রামে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি তখন পঞ্চাশের মন্বন্তরের ছবি আঁকছেন। সেগুলো ছাপা হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজি পত্রিকা পিপল’স ওয়ার ও বাংলা পত্রিকা জনযুদ্ধতে। চিত্তপ্রসাদই সোমনাথকে ক্ষুৎপীড়িত মুমূর্ষু মানুষের প্রতিকৃতি আঁকতে উৎসাহিত করেছিলেন। চিত্রশিল্পের জগতে তাই তাকেই নিজের প্রথম দীক্ষাগুরু হিসেবে অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছেন সোমনাথ হোর। ‘আমার চিত্রভাবনা’য় তিনি লেখেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই তেতাল্লিশ বা পঞ্চাশের মন্বন্তর এলো। তখনই কমিউনিস্ট শিল্পী চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। উনি আমাকে রাস্তায় রাস্তায়, হাসপাতালে সঙ্গে নিয়ে হাতেকলমে দেখিয়ে দিলেন—কী করে ভুখা এবং অসুস্থদের ছবি আঁকতে হয়। আমি কাঁচা হাতে তাই করতে লাগলাম।...পোস্টারে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বন্ধুদের সহায়তায় গ্রামে গ্রামে দেখিয়ে এক নতুন ধরনের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লাম।’ চিত্তপ্রসাদের আগ্রহেই তিনি জনযুদ্ধ পত্রিকায় ছবি পাঠাতে লাগলেন। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ছবিগুলো জনযুদ্ধ পত্রিকায় ছাপা হওয়া শুরু করলে শিল্পী হিসেবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সোমনাথ হোরের নাম। সেই সুবাদে জন্মভূমি চট্টগ্রামকেই এ শিল্পীর উত্থানপর্ব ধরা যায়। জনযুদ্ধে তিনি কার্টুন, ছবি, সংবাদচিত্র, সংবাদ সহযোগী চিত্র ও প্রতিকৃতি এঁকেছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সোমনাথ হোরের পরিচিতি শৈশবেই। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কমিউনিস্টদের সঙ্গে তার মায়ের যোগাযোগ ছিল। ছোট বোন ছিলেন পার্টি ডকুমেন্টের কুরিয়ার। কমিউনিস্ট পার্টিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ চট্টগ্রামের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সৌজন্যে। কলকাতায় গিয়েও তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে কমিউনিস্ট পার্চির তৎকালীন সেক্রেটারি পি. সি. যোশির পরামর্শে পার্টির সদস্য নিখিল চক্রবর্তী ও স্নেহাংশু আচার্যের সহায়তায় ২৪ বছর বয়সে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেন সোমনাথ হোর। নিয়মিত ছবি আঁকতে থাকেন পার্টির কাগজে। আঁকতেন তিনি দারুণ। তার ছবিতে ঘটনাপ্রবাহ যেন জ্যান্ত হয়ে ধরা পড়ত। তাই তাকে তেভাগা আন্দোলন সরজমিনে পর্যবেক্ষণের জন্য রংপুরে পাঠানো হলো। সেই সঙ্গে সূচিত হলো সোমনাথ হোরের শিল্পীজীবনের এক নতুন অধ্যায়। পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভুখা নাঙ্গা গ্রামবাসীর জায়গায় ঠাঁই পেল তেভাগা আন্দোলনের লড়াকু কৃষকদের মুখ। জনযুদ্ধ পত্রিকার পরিবর্তে এবার তেভাগার ডায়েরি। সেই ডায়েরিতে তিনি স্কেচের মাধ্যমে কৃষক সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। কিছু পোর্ট্রেটধর্মী স্কেচও করেছেন। তেভাগার লড়াই কেবল রংপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সমগ্র উত্তরবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল সে আন্দোলন। সোমনাথ হোরের পোর্ট্রেটধর্মী স্কেচগুলোর সূত্রে সেই ব্যাপক সংগ্রামের লড়াকু মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হয় দর্শক। ‘তেভাগার ডায়েরি’র পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে ভাগচাষীদের গ্রাম, তামাক চাষে মগ্ন কৃষক, কৃষকদের সন্তানদের জন্য পাঠশালা, তেভাগা আন্দোলন বিষয়ে রাত্রিকালীন সভা ইত্যাদি স্কেচ। আর আছে কৃষক নেতাদের পোর্ট্রেটধর্মী স্কেচ। তবে সোমনাথ হোর কেবল কৃষক আন্দোলন ও কৃষকদের স্কেচই করেননি, তেভাগা ডায়েরিতে জোতদার, কালোবাজারি, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের স্কেচও ঠাঁই পেয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে নিপীড়ন, আন্দোলনের বাইরে গিয়ে এক বৃহত্তর ও পূর্ণাঙ্গ জীবনের পরিচয় ফুটিয়ে তোলার সচেতন প্রয়াস ছিল সোমনাথ হোরের। সারা জীবনে করা অজস্র স্কেচ, ড্রইং, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, টেরাকোটাসহ বিচিত্র মাধ্যমে হয়েছে তার সার্থক প্রতিফলন।