ডাইনি বলতে প্রথমেই কী মনে পড়ে? কালো আলখাল্লায় মোড়া লম্বা নাকের বৃদ্ধা, মাথায় সুচালো হ্যাট এবং সে একটা ঝাড়ুতে চড়ে উড়ে বেড়ায়। তার গায়ের রঙ সবুজ। দীর্ঘদিন ধরে পপুলার কালচারে এভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে ডাইনিকে। এছাড়া সে হবে রাগী, ছোট বাচ্চাদের কাছে শয়তানের প্রতিরূপ আর সবসময় কোনো না কোনো ক্ষতি করবে কারো। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ম্যাকবেথ থেকে ফ্র্যাঙ্ক বমের উইজার্ড অব ওজ—যেভাবে ডাইনিকে উপস্থাপন করা হয়েছে তাই চলছে এখনো। আসছে হ্যালোইনে এভাবেই ‘কসপ্লে’ করতে দেখা যাবে অনেককে। প্রশ্ন হলো এ রূপ কোথা থেকে এল? কারা করল এবং এর পেছনে যুক্তিটা কী?
ডাইনির ধারণাটি ইউরোপে এসেছে মধ্যযুগে এবং তা চলেছে প্রাক-আধুনিক যুগেও। উইচ হান্টিং, ডাইনিদের পুড়িয়ে মারার কথা আমরা পড়েছি। মূলত যারা জাদু চর্চা করত বা এ ধরনের সন্দেহ যাদের নিয়ে ছিল তাদেরই ডাইনি বলা হতো। তবে অনেক ক্ষেত্রে চার্চের মতের বিরুদ্ধে গেলে তাদেরও ডাইনি তকমা দেয়া হতো (জোয়ান অব আর্ককে এ কারণেই মরতে হয়েছিল)। অনেক সময় ডাইনি বলে ধাত্রীদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া তুলনামূলক আধুনিক চিকিৎসা ও জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত নারীদের বিরুদ্ধেও আনা হতো ডাইনি হওয়ার অভিযোগ। সম্প্রতি ব্রিটিশ লাইব্রেরি এমন একটি শো নিয়ে এসেছে, যেখানে মধ্যযুগে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত নারীদের কীভাবে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করা হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সাধারণভাবে একটি ধারণা ছড়ানো হয়েছিল ডাইনিরা শয়তানের প্রতিনিধি। এরা নিজেদের নানা ধরনের পশু বা অন্য জীবে পরিণত করতে পারত। রাতের বেলা ঘুরে বেড়াত একটা ঝাড়ুতে চেপে। এ ঝাড়ু তাদের জাদুদণ্ড হিসেবেও ব্যবহার হতো। এরা চাইলে প্রকৃতির ওপরও নিজের প্রভাব খাটাতে পারত। তৈরি করতে পারত ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতীতি। এসবের ওপর ভিত্তি করেই ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বেশ বড় পরিসরে ‘উইচ হান্টিং’ হয়েছে ইউরোপে। তাদের নিয়ে ভয় ছড়ানো হয়েছিল এবং প্রচারের একটা বড় মাধ্যম ছিল চিত্র।
ডাইনিদের প্রকাশ করা প্রথম কাজটি ছিল হাইনরিখ ক্রামারের ‘ম্যালিয়াস মেলফিক্র্যাম’। বইটিকে উইচক্র্যাফটের ম্যানুয়াল বলা যায়। প্রকাশ হয়েছিল ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। লেখক একজন জার্মান সাধু। তিনি জানিয়েছিলেন ডাইনিরা নরমাংস ভক্ষণ, শয়তানের সঙ্গে দেহ সংসর্গ করে থাকে এবং তারা পুরুষকে নপুংসক করতে পারে। ক্রামার আরো বলেছিলেন ধাত্রীরা মূলত শিশুদের শয়তানের কাছে উৎসর্গ করে।
জাদুবিদ্যার চর্চা নিয়ে এর আগে তেমন হুলস্থুল ছিল না, কিন্তু বইটি প্রকাশের পরই ডাইনি নিয়ে নানা আলাপ শুরু হয়। তাদের ক্ষতিকারক হিসেবে দেখতে শুরু করে সমাজ। ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে ডাইনিবিদ্যাই সাহিত্য ও প্রতিদিনের আড্ডার বিষয়ে পরিণত হয়। আলব্রেখট ডুরার (ক্রামারের প্রকাশকের নাতি) ডাইনিদের ছবি প্রকাশ করা শুরু করেন। ডুরার তার প্রকাশনার মাধ্যমে ডাইনিদের একটা প্রটোটাইপ চালু করেন। তার কাজগুলোয় নারীকে অনেকাংশেই শরীরসর্বস্ব করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৪৫০-১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩০০ বছরের ইতিহাসে প্রায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ নারীকে ডাইনি হওয়ার অভিযোগে হত্যা করা হয়। যদিও ডাইনি বা শয়তানদের দোসরদের কোনো লিঙ্গ-পরিচয় নির্দিষ্ট ছিল না, কিন্তু মারা গেছেন নারীরাই বেশি। এ জায়গা থেকেই অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে তৈরি প্রটোটাইপ থেকে ডাইনির কসপ্লে না করে অন্য কোনোভাবে তাদের উপস্থাপন করতে। এর মধ্যে অন্যতম হলেন রেমেদিয়াস ভারো। তিনি স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী। দীর্ঘদিন তিনি মেক্সিকোয় বাস করেছেন। তার আশপাশে ছিল বাদুড়, বিড়াল আর নানা ধরনের তাবিজ-কবজ। এসব থেকে তিনি ‘ডাইনি’কে নতুন করে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ভালোর একটি বিশেষ চিত্র দর্শকের নজর কাড়ে। তিনি ১৯৫৭ সালে একটি ছবি তৈরি করেছেন, যেখানে ডাইনিকে পেঁচার মুখাবয়ব দিয়েছেন। শরীরটা নারীর, মুখাবয়বে নারীত্ব থাকলেও পেঁচাত্ব স্পষ্ট। এর মধ্য দিয়ে চিত্রকার ডাইনিকে নতুন করে উপস্থাপনের পাশাপাশি ডাইনির চেহারা বদলের ইতিহাসটাও মূর্ত করেছেন। এমন আরো অনেক কিছু তৈরি করার চেষ্টা চলছে। পুরনো ধারণা থেকে বের করে আনতে আমাদের সাহায্য করবে নতুন ধারার এসব শিল্পকর্ম।