নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অবস্থিত ন্যাশনাল গ্যালারির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ল দুজন। সেখানে সংরক্ষিত একটি চিত্রকর্ম চুরি করে নিরাপদে সরে গেল তারা। একটি চিরকুট রেখে গেল। সেখানে লেখা ছিল, ‘দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ধন্যবাদ’। দিনটি ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪। নরওয়েজীয় পুলিশ ব্রিটিশ পুলিশের সহায়তায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে ১৯৯৪ সালের ৭ মে চিত্রকর্মটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। চুরির দায়ে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
২২ আগস্ট, ২০০৪। এবার ঘটনাস্থল অসলোর মুংখ মিউজিয়াম। দিনে-দুপুরে মুখোশ পরা কয়েকজন বন্দুকধারী সেখানে ঢুকে পড়ে। ১৯৯৪ সালে চুরি যাওয়া চিত্রকর্মটির আরেকটি সংস্করণ এবার লক্ষ্য। চিত্রকর্মটি নিয়ে তারা গাড়িযোগে নিরাপদে পালিয়ে যায়। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল চিত্রকর্মটি চুরির দায়ে পুলিশ একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু চিত্রকর্মটি উদ্ধার করতে পারেনি। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে প্রমাণ লোপাট করার জন্য চোরেরা সেটি পুড়িয়ে ফেলেছে। অসলোর প্রশাসন চিত্রকর্মটি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারলে তার জন্য ২০ লাখ ক্রোন (নরওয়েজীয় মুদ্রা) পুরস্কার ঘোষণা করে। অবশেষে ২০০৬ সালের ৩১ আগস্ট নরওয়েজীয় পুলিশ চিত্রকর্মটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছে বলে দাবি করে।
ওপরের দুটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। চিত্রকর্মটির বিভিন্ন সংস্করণ বহুবার চুরি হয়েছে। তারও বেশি চুরির প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ফলে কিছু ক্ষতিও হয়েছে। যে চিত্রকর্মটি ঘিরে এত ঘটনার ঘনঘটা, তার শিরোনাম ‘স্ক্রিক’। ইংরেজি নাম ‘দ্য স্ক্রিম’। কাছাকাছি বাংলা অনুবাদ ‘চিৎকার’।
সাধারণ মানুষের তুলনায় একজন শিল্পী প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে অধিকতর সংযোগ অনুভব করেন। ফলে তার চিত্রকর্মে উপস্থাপিত দৃশ্যকল্প অনেক সময় দুর্বোধ্য ঠেকে। নরওয়েজীয় শিল্পী এডভার্ড মুংখ ও তার কাজও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তিনি তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চর্মচক্ষুর চেয়ে কিছু বেশিই দেখতেন। মনের কান দিয়ে শুনতেন এমন কিছু, যা সাধারণের কর্ণগোচর নয়। তেমনই একবার প্রকৃতির চিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন এডভার্ড মুংখ। সে অভিজ্ঞতাকেই তিনি ‘দ্য স্ক্রিম’ শিরোনামে চিত্রবন্দি করেছেন। তাই এর জার্মান শিরোনাম ‘ডার স্ক্রেই ডার নেচার’। অর্থাৎ, ‘প্রকৃতির চিৎকার’। এ শিরোনামেই চিত্রকর্মটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল। চিত্রকলার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্মের সাক্ষী হন দর্শনার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে কালক্রমে এডভার্ড মুংখ বিবেচিত হন অন্যতম প্রভাবশালী চিত্রশিল্পী হিসেবে। তবে যা বলেছিলাম, যথারীতি চিত্রকর্মটি খ্যাপাটে মনে হলো দর্শকের কাছে। তাই নরওয়ের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত সংস্করণটির ওপরের দিকে বাম কোনায় পেনসিলে লেখা আছে, ‘একজন পাগলই কেবল এটি আঁকতে পারে’। ধারণা করা হয়, ১৮৯৫ সালের অক্টোবরে নরওয়েতে চিত্রকর্মটির প্রথম প্রদর্শনী থেকে পাওয়া সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এডভার্ড মুংখ স্বয়ং এটি লিখেছিলেন। তার পরিবারে পাগলামির ইতিহাস আছে। চিত্রকর্মটি তিনি যখন আঁকছিলেন, তার বোন লরা ক্যাথারিন তখন পাগলা গারদে ছিলেন। সমালোচকরা সেদিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন। তারই প্রতিবাদ হিসেবে পেনসিলে লেখাটি লিখেছিলেন এডভার্ড মুংখ।
১৮৯৩ সালে আঁকা ‘দ্য স্ক্রিম’ ব্যক্তির মানসিক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। জীবনের নানাবিধ চাপে মনোবৈকল্যের শিকার হয় মানুষ। তখন সে এক ধরনের মহাজাগতিক বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। তারই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে নিজের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে ব্যক্তি। জীবনযাপন তখন অসার মনে হয়। নানা ধরনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সে যেতে থাকে। চারপাশের সবকিছু যেন চিৎকার করে তার দিকে আঙুল তাক করছে। তখন দুই হাতে সজোরে কান চেপে ধরা ছাড়া তার আর কিছু করার থাকে না। ব্যক্তির মনোজগতের এ বিশৃঙ্খলাকে রঙতুলিতে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এডভার্ড মুংখ। চিত্রকর্মটি তাই হয়ে উঠেছে মনোযন্ত্রণার সার্থক প্রতীক। এর মুখ্য চরিত্রের চেহারায় জ্যান্ত হয়ে উঠেছে মানুষের যন্ত্রণা ও উদ্বিগ্নতার ছাপ। তাই ‘দ্য স্ক্রিম’-এর সৌন্দর্য, রহস্যময়তা ও গুরুত্ব বিবেচনায় সাংবাদিক আর্থার লুবৌ লেখেন, ‘এটি আধুনিক চিত্রকলার প্রতিমূর্তি। আমাদের কালের মোনালিসা।’