তারা পাঁচজন। প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথা ও মুখমণ্ডল কাপড়ে ঢাকা। যেন তারা দেখতে না পারে। তাদের গাদাগাদি করে কারাগারের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে তারা ফিলিস্তিনি। চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকলেও তারা দমে যায়নি। তারা শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত। দৃঢ় মনোভাবের অধিকারী। তথাপি বিরাজ করছে চাপা বিষণ্নতা। তাদের ভবিষ্যৎ বর্ণহীন ও নিরানন্দ। ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণ তাদের ঠেলে দিয়েছে চরম সংকটের মুখে।
‘প্রিজন’ শিরোনামের একটি চিত্রকর্মে এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের জীবন। ১৯৮২ সালে তেলরঙে ছবিটি এঁকেছিলেন ফিলিস্তিনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সুলাইমান মনসুর। প্রতীকী এ চিত্রকর্মে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও সর্বাত্মক সংগ্রাম ফুটে উঠেছে। জন্মভূমিতে প্রাণভরে শ্বাস নিতে না পারার হাহাকার প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হচ্ছে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির বুকে। এক অনির্বচনীয় বিষণ্নতা সবসময় তাদের ঘিরে থাকে। ফিলিস্তিনের আপামর জনগোষ্ঠীর সে সামষ্টিক বেদনাবোধ ক্যানভাসে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন শিল্পী। তবে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান ইসরায়েলি হামলা কথায় বা ছবিতে প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সুলাইমান মনসুর। সম্প্রতি (১২ অক্টোবর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আঁকা একটি ছবি শেয়ার করেছেন তিনি। এটিও তেলরঙে আঁকা। শিরোনাম ‘গাজা’। কফিনের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন ফিলিস্তিনি এক নারী। ইসরায়েলি সেনাদের আক্রমণে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছেন অসংখ্য ফিলিস্তিনি। ছবিটি তাই দেশটির নিত্যবাস্তবতার সার্থক প্রতীক হিসেবে হাজির হয়েছে। ছবির সঙ্গে কিছু কথাও লিখেছেন তিনি। শিগগিরই ফিলিস্তিনের জনগণ মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারবে বলে আশাবাদী সুলাইমান মনসুর। তিনি লেখেন, ‘অচিরেই ফিলিস্তিনের মানুষ কেবল গাজা উপত্যকার সৌন্দর্য নিয়ে লিখবে ও ছবি আঁকবে। ফিলিস্তিনের মানুষ স্বাধীন হবে। তারাই সারা দুনিয়াকে বেঁচে থাকার মানে শেখাবে।’
শিল্পী সুলাইমান মনসুরের মতো এমন আশা নিয়ে বেঁচে আছে ফিলিস্তিনের প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ আশাবাদকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে তিনি এঁকেছিলেন ‘মাই নেম ইজ প্যালেস্টাইন অ্যান্ড আই উইল সারভাইভ’ শিরোনামের চিত্রকর্ম। তেলরঙে আঁকা ছবিটিতে এক নারী ফিলিস্তিনের পতাকা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ২০২১ সালে শিল্পী সুলাইমান মনসুর এঁকেছেন ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায় গাজা উপত্যকায় এক নারী নতজানু হয়ে একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে আছে। গাছটির একটি বিশেষত্ব আছে। এক পাশের পাতা ও ডালগুলো বিবর্ণ। ফলহীন। স্পষ্টই বোঝা যায়, এটি ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বর্তমান দুর্দশাকে প্রতীকায়িত করছে। অন্য পাশ সবুজ ও সতেজ। লাল লাল ফলে পরিপূর্ণ। এটি ফিলিস্তিনিদের সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রতীক। আর গাছটি যেন তাদের মাতৃভূমি। বর্তমান বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, একদিন সুদিন আসবে, সে আশায় তারা নিজেদের মাটিকে আঁকড়ে ধরে আছে। ফেসবুকে ছবিটি শেয়ার দিয়ে সুলাইমান মনসুর লেখেন, ‘তারা তাদের ঐতিহাসিক মাতৃভূমি, তাদের ইতিহাস, তাদের ঐতিহ্য এবং তাদের একমাত্র ভবিষ্যৎকে আঁকড়ে ধরে আছে।’
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী হবে, তার উত্তর এখনো কালের গর্ভে। কিন্তু সুলাইমান মনসুরের মতো ফিলিস্তিনি চিত্রশিল্পীদের এসব কাজ সময়ের দলিল হয়ে থেকে যাবে।