নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বিকালে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই-ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং তাদের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত/প্রাপ্ত নিবন্ধন বাতিল করেছে এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায় বহাল রেখেছেন।’
সরকারের নির্বাহী আদেশে সংগঠন দুটিকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে যে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির সাম্প্রতিক কালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত। এ কারণে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮ (১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরসহ তাদের সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। ওই আইনের তফসিল-২-এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’
২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা জামায়াতকে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। পরে জিয়াউর রহমানের আমলে তারা রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়। দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল তখন থেকেই। চার দশক পর সেই দাবি পূরণ হলো, যদিও যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতের বিচারের দাবি এখনো অপূ্র্ণ রয়ে গেছে। পাশাপাশি হাইকোর্ট এক রিট মামলার রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও তা বহাল রেখেছেন।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আলোচনায় থাকলেও বিষয়টি গতি পায় সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর। ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে দেয়া পরিপত্র জুনের শেষে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করলে ছাত্ররা ফের মাঠে নামেন। জুলাইয়ে তা সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছড়িয়ে যায়। পরে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে একপর্যায়ে তা সহিংসতায় গড়ায়।
এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা শুরু হয়। রামপুরায় বিটিভি ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ভাংচুর করে আগুন দেয়া হয় এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালীর টোল প্লাজা এবং মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনে। এ আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের মধ্যে এক সপ্তাহে ১৫০ মানুষের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করেছে সরকার, যদিও দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে বিভিন্ন তথ্যে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে নাশকতা করেছে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী, আর তাতে মদদ দিয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি। এ প্রেক্ষাপটে গত সোমবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। পরদিন মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে।’
আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এ সবকিছু তো ছাত্ররা করেনি। ছাত্রদের পেছনে রেখে পেছন থেকে যারা করেছে সেগুলো জামায়াত-শিবির-বিএনপি। অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এটাই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেজন্য অনেক দিনের যে চাহিদা ছিল, জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার, আজকে সেই প্রক্রিয়াটি চলছে।’
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বুধবারই জারি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া সারতে একদিন সময় লেগে যায়। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সকালে আইন মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠিয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং করে আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।’ এরপর বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরপাত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।