ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল দুপুরের দিকে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে গ্রেফতার বাকি সব ছাত্র-জনতাকেও ছেড়ে দিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে গতকাল এক মানববন্ধনে প্লাটফর্মটির প্রতিনিধিরা এ হুঁশিয়ারি দেন।
ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া ছয় সমন্বয়ক হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আবু বাকের, আসিফ মাহমুদ ও নুসরাত তাবাসসুম। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘আমাদের ছয়জনকে পৃথকভাবে একজন করে পুলিশের গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সবাইকে একসঙ্গে ছাড়া হয়নি। আমরা শিগগিরই আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানাব।’
রাজধানীর একটি হাসপাতাল থেকে গত ২৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যার পর সদ্যবিদায়ী ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের হেফাজতে নিয়েছে ডিবি।’
এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই আরো দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে হেফাজতে নেয়া হয়। ২৮ জুলাই হেফাজতে নেয়া হয় নুসরাত তাবাসসুমকে। পরবর্তী সময়ে তারা ডিবি হেফাজতে থেকেই এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
ছয় সমন্বয়ককে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে বলেন, ‘তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য জিডি করেছিল। আজকে যখন তারা বলেছে যে তাদের আর নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, তারা চলে যেতে চেয়েছে; আমরা তাদের বাধা দিইনি, তারা চলে গেছে।’
এদিকে গতকাল দুপুরে ডিবি কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে মানে এই নয় যে আমাদের অবস্থান পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারা দেশে আটক ছাত্র-জনতাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। তাদের নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে।
মানববন্ধনে অংশ নেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান; বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরীন, আসিফ নজরুল, সামিনা লুতফা; অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা; মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম; মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক, নূর খান প্রমুখ।
সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার শক্তি সম্পর্কে ভুলে গেছে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তারা সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন করেছে। তারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা মিথ্যাচার করেছে। তারা এটি করতে পেরেছে এজন্য, এ সংস্থাগুলো বিচারহীনতা চিরদিন উপভোগ করতে পেরেছে। ভেবেছে এভাবেই সামনের দিনগুলোয় চালিয়ে যাবে। এ মিথ্যাচারনির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে মারা হবে? এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি হতে দেয়া হবে না। ২৪ ঘণ্টা আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকে রাখার বিরুদ্ধে। তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য আমরা খুশি। এখন যে যেখানে আটক আছে তাদের সবার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা ছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। পাশাপাশি এ পর্যন্ত যারা মারা গেছেন তাদের হত্যাকারীদের বিচারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিতে হবে। খুলে দিতে হবে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমি বলব, বাংলাদেশের নয় বরং সরকারের নষ্ট হচ্ছে।’
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আপনারা নিয়ে পোলাও-মুরগি খাওয়ান। কার টাকায় খাওয়ান? আমাদের টাকাই তো খাওয়ান। এগুলো বন্ধ করেন। এতগুলো তাজা প্রাণ কেড়ে নিলেন, এ ক্ষত সারবে না। আর একটা গুলিও শিক্ষার্থী ও জনতার বুকে দেবেন না। তারা যেন মুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারে সেটির নিশ্চয়তা চাই। তাদের আটকে রাখার ক্ষমতা কোথায় পেয়েছেন? এ প্রথার অবসান চাই। এ রকম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমরা চাই না। যাদের আটক রাখা হয়েছে সবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুন। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘আর কত রক্ত লাগবে আপনাদের? ক্যাম্পাসে বাহিনীগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো নিচে যাবে।’