রাজধানীর উত্তরায় সংঘর্ষ তীব্রতা পেয়েছিল গত ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই। এ তিনদিনে এলাকাটিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পথচারীদের হতাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। আহত-নিহতদের অনেককেই তখন নিয়ে আসা হয় উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আটজন নিহত হওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে। যদিও নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হাসপাতালের কর্মচারী-কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এ দুদিনে হাসপাতালটিতে নিয়ে আসা মরদেহের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এসব মরদেহের সবই ছিল গুলিবিদ্ধ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮-২০ জুলাই পর্যন্ত রীতিমতো হতাহতের ঢল নেমেছিল হাসপাতালটিতে। হঠাৎ চিকিৎসাসেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা এত বেশি হারে বেড়ে যাওয়ায় সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়ে তাদের। জরুরি ভিত্তিতে মেডিকেল টিম তৈরি করতে হয়। এজন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আরো ডাক্তার নিয়ে আসা হয়। গঠন করা হয় মেডিকেল টিম। তবে আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ কয়দিনে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা নিতে এসেছিল ২৬৫ আহত ব্যক্তি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে গুলিবিদ্ধ ছিলেন। তাদের সবাইকে চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়া হয়েছে। এ মুহূর্তে হাসপাতালে সংঘর্ষে আহত কেউ নেই। তাদের সবাইকেই চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। অনেকেই পুরোপুরি সুস্থ না হলেও পুলিশি হয়রানির ভয়ে আগাম ছাড়পত্র নিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই দেহ বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় ছিল বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নিহতদের একজন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থী জাহিদুজ্জামান তানভীন। পরিবারের সঙ্গে থাকতেন উত্তরার আজমপুরে। গত ১৮ জুলাই দুপুরবেলা পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। বাসা থেকে বেরিয়েই শিক্ষার্থী ও পুলিশের সংঘর্ষে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গুলি তার গলা দিয়ে বিদ্ধ হয়ে মাথা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে উত্তরার কুয়েত-বাংলাদেশ সরকারি হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আরেকজন বরিশালের জসিম উদ্দিন। উত্তরার একটি ওয়ার্কশপে ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন তিনি। ওয়ার্কশপের একটি গাড়ির জন্য যন্ত্রাংশ কিনতে আরেকটি দোকানে যান।
ফেরার পথে তিনিও সংঘর্ষে পড়েন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান জসিম। বুকের বাম পাশে বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল তার।
শুধু তানভীন কিংবা জসিমই নন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে উত্তরার অন্যতম সরকারি হাসপাতাল কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে আসা সবক’টি মরদেহই ছিল গুলিবিদ্ধ। নিহতদের পরিবার ও হাসপাতাল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে শুধু নিহতরাই নন, আহতদের মধ্যেও বেশির ভাগই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। কারো কারো শরীরে ১০-১৫টিরও বেশি ছররা গুলি পাওয়া গেছে।
সরজমিনে গত ৩০ জুলাই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবেই চলছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। বেলা ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগীয় কিছু রোগী প্রধান ফটকের বুথে টিকিট কেটে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বেলা ১টা নাগাদ সে বৃষ্টি আরো বাড়তে থাকে। বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে কমতে থাকে রোগীদের আনাগোনা। ১টার পর বহির্বিভাগীয় সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জনসমাগমেও ছেদ পড়ে।
কথা হয় একজন নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। সংঘর্ষের দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে একসঙ্গে এত আহত-নিহত মানুষ আগে কখনো দেখিনি। ১-২ মিনিট পরপর কেউ না কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে আসছিলেন। প্রায় সবার গায়েই ছিল ছররা গুলির গর্ত। যতগুলো মরদেহ হাসপাতালে এসেছে, সবই গুলিবিদ্ধ ছিল।’
এ সময় মরদেহের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি আর কথা বলতে চাননি। এর আগে তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘কী বলব ভাই, অনেকে পুরোপুরি সুস্থ হননি। তবু পুলিশের ঝামেলার কারণে হাসপাতাল থেকে জোর করে ছাড়পত্র নিয়ে তারা বাড়ি চলে গেছেন।’
হাসপাতালের আরেকজন কর্মী বলেন, ‘সেদিন আমার ডিউটি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু আহত-নিহতের সংখ্যা দেখে আর যেতে পারিনি। এমন দিন আর কখনো না আসুক। এতগুলো তাজা প্রাণ নিথর দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। তরুণ শিক্ষার্থীদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখতে তো নিজেরই খারাপ লাগে।’
সবাই গুলিবিদ্ধ ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ পোলাপানের গায়েই গুলি লেগেছিল। তবে হাত-পা কাটা কিছু পোলাপানও এসেছিল।’
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘১৮ জুলাই দুপুর থেকেই হতাহত রোগী আসতে থাকে। আমাদের ডাক্তাররা তখনো হাসপাতালে থাকায় সেবা দিতে পেরেছি। কারণ দুপুরের পর শুধু জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা থাকেন। পরদিনও এমন ঘটনার বিষয়ে আমরা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলাম। সেজন্য সকালেই ঢাকা মেডিকেল ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ডাক্তার এনে মেডিকেল টিম গঠন করে প্রস্তুত থাকি। দুপুরের পরই আহত মানুষ আসতে থাকে হাসপাতালে। ওই মেডিকেল টিমের মাধ্যমেই সেবা দিই আমরা।’
নিহতদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সাতটি মরদেহ আসে হাসপাতালে আর শুক্রবার আসে একটি। সবারই হাসপাতালে আনার আগে মৃত্যু হয়। তাদের সবাই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।
আহতদের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আহতদের অনেকেরই মেজর সার্জারি করতে হয়েছে। অন্য অনেককে বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।’