সর্বশেষ তিন প্রান্তিকের মধ্যে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী করপোরেট মুনাফা কমেছে। এর পেছনে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলোর প্রবৃদ্ধির তারতম্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে চীনের অর্থনৈতিক শ্লথতা এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে সবচেয়ে বেশি। দেশটির নানা খাতের ওপর বিভিন্ন দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের নির্ভরতা রয়েছে। ফলে চীনের অর্থনৈতিক মন্থরতার সরাসরি প্রভাব পড়েছে এসব কোম্পানির ব্যবসায়িক মুনাফায়। খবর নিক্কেই এশিয়া।
মার্চে শেষ হওয়া প্রান্তিকে চীনের একাধিক শিল্প খাতে উৎপাদনে মন্থরতা দেখা যায়। এর মধ্যে রাসায়নিক থেকে ইস্পাত ও সরঞ্জাম খাত উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে এ সময় মার্কিন টেক জায়ান্ট ও সেমিকন্ডাক্টর-সম্পর্কিত কোম্পানিগুলো জেনারেটিভ এআইয়ের মাধ্যমের মুনাফা অর্জন করেছে।
কুইক ফ্যাক্টসেট ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়ের হিসাব ও পূর্বাভাস অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন ও ইউরোপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ২৪ হাজার ৬০০টি পাবলিকলি ট্রেড করা কোম্পানির নিট মুনাফা বার্ষিক ৬ শতাংশ কমে ১ দশমিক ১১ ট্রিলিয়ন হয়েছে। মোট বৈশ্বিক বাজার মূলধনের ৯০ শতাংশ এসব কোম্পানির দখলে।
মার্চে শেষ হওয়া প্রান্তিকে বৈশ্বিক ১৭টি শিল্প খাতের মধ্যে নয়টিতে মুনাফা বেড়েছে। অন্যদিকে আগের প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মুনাফা বেড়েছিল ১১ খাতে।
বছরের প্রথম প্রান্তিকে চীনা কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। দেশটির তালিকাভুক্ত ব্যবসায় মোট মুনাফার প্রায় ৪০ শতাংশ করে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আবাসন খাতকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার নিম্ন সুদহার নির্ধারণ করায় চীনের আর্থিক খাত এখন ভুগছে। দেশটির শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না মুনাফা আগের প্রান্তিকের তুলনায় আরো সংকুচিত হয়েছে।
জানুয়ারি-মার্চে চীনে নতুন বাড়ি বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। দেশটির প্রধান আবাসন সংস্থা চায়না ভ্যাঙ্কে রেড রেটিংয়ের মধ্যে পড়েছে। আবাসনের বাজারে দীর্ঘস্থায়ী মন্দার প্রতিক্রিয়ায় চীন নিষ্ক্রিয় হাউজিংগুলো স্থানীয় সরকারের আওতায় নেয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি পিপলস ব্যাংক অব চায়নাও সম্পত্তি ক্রয়ে বন্ধকের ন্যূনতম হার বাতিল করেছে। কিন্তু নিম্ন সুদহার চীনা ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকির মুখে রেখে দিয়েছে।
চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা অন্যান্য দেশ ও বিভিন্ন শিল্পকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে দুর্বল সত্ত্বেও দেশটির রাসায়নিক খাতে উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে এশিয়াজুড়ে এ খাতে দেশটির আধিপত্য দেখা দিয়েছে।
জাপানের সুমিতোমো কেমিক্যাল জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে নিট লোকসান দেখেছে। এশিয়ার পেট্রোকেমিক্যাল বাজার সম্পর্কে কোম্পানিটির প্রেসিডেন্ট কেইচি ইওয়াতা বলেন, ‘এ বছর আমরা বড় উন্নতি আশা করছি না।’
এছাড়া চীনা সরবরাহের আধিক্যের মধ্যে মুনাফা কমেছে জাপানের নিপ্পন স্টিল ও দক্ষিণ কোরিয়ার ইস্পাত প্রস্তুতকারক পিওএসসিও হোল্ডিংসের। পিওএসসিওর বাজার কৌশলবিষয়ক প্রধান জিওং কি-সিওপ বলেন, ‘ডিসেম্বরে আয়ের শীর্ষে যাওয়ার পর থেকে বাজারের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। অর্থনৈতিক উদ্দীপনার অভাবে চীনে হতাশা বাড়ছে এবং দেশটির পণ্যের অতিরিক্ত সরবরাহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারকে দুর্বল করছে।’
বিনিয়োগের জন্য অগ্রগামী শিল্পগুলোর একটি হলো সরঞ্জাম নির্মাণ খাত। এ খাতে বিশ্বব্যাপী মুনাফার হার কমেছে ১৪ শতাংশ। এ খাতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি কমেছে চীনে ৩৬ শতাংশ।
এর আগে বৈশ্বিক করপোরেট মুনাফায় নেতৃত্বের স্থানে থাকলেও উপকরণ ও জ্বালানি খাতে কমেছে ২৬ শতাংশ।
অন্যদিকে টানা দ্বিতীয় প্রান্তিকে আর্থিক খাতে মুনাফা কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদহারের কারণে অর্থায়ন কমে যাওয়ায় প্রভাবিত হয়েছে ব্যাংক অব আমেরিকা ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে খরচ বেড়ে যাওয়ায় আঞ্চলিক ব্যাংকগুলো বেশি আমানত দখলে রাখার প্রতিযোগিতা বদ্ধ করেছে।
এসব পতনের বিপরীতে এআই নির্ভর শিল্পগুলো প্রবৃদ্ধি দেখেছে। তথ্য প্রযুক্তি খাতে ১৩ শতাংশ ও ইলেকট্রনিকস খাতে মুনাফা বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
সমষ্টিগতভাবে জিএএফএম নামে পরিচিত মার্কিন টেক জায়ান্টদের মধ্যে অ্যাপল বাদ দিলে গুগল প্যারেন্ট অ্যালফাবেট, ফেসবুক প্যারেন্ট মেটা, অ্যামাজন ডটকম ও মাইক্রোসফটের মুনাফা বেড়েছে। এআইয়ের চাবিকাঠি ধরা হয় ক্লাউড পরিষেবাকে। এ খাতে অ্যামাজনের পরিষেবাগুলো তিন গুণেরও বেশি নিট মুনাফা করেছে।
উচ্চ সুদহারের কারণে ইউরোপীয় বাজার পুনরুদ্ধারের সামগ্রিক প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। মন্থর চাহিদার কারণে জার্মান রাসায়নিক প্রস্তুতকারক বিএএসএফের নিট মুনাফা কমেছে ১২ শতাংশ।
এদিকে তোকাই টোকিও ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরির চিফ গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস্ট শোজি হিরাকাওয়া বলেছেন, ‘ইউরোপ ও চীনের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় কিছু ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কিছু খাতে ভোক্তা ব্যয় ধীর হয়ে গেছে। আমরা দ্বিতীয় প্রান্তিকেও (এপ্রিল-জুন) বড় কোনো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আশা করতে পারি না।’
বছরের প্রথম প্রান্তিকে জাপানের শিল্পোৎপাদন খাত শক্তিশালী হয়েছে। জাপানের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। দুর্বল ইয়েন রফতানিকেন্দ্রিক কোম্পানিগুলোকে কার্যক্রম বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করছে।