আমেরিকা, জাপান, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ডসহ আরো কয়েকটি দেশে যাচ্ছে আমাদের শতরঞ্জি

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৩

রংপুরের শতরঞ্জি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছে শতরঞ্জি শিল্পে। এমনি একজন নারী উদ্যোক্তা স্বপ্না রানী সেন। গড়ে তুলেছেন রংপুর ক্রাফট নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে তাদের তৈরি শতরঞ্জি কয়েকটি দেশে রফতানি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক স্বপ্না রানী সেন সম্প্রতি শতরঞ্জি শিল্পের বিভিন্ন দিক, এর সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন বণিক বার্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রংপুর জেলা প্রতিনিধি এসএম পিয়াল

কত দিন ধরে শতরঞ্জি শিল্পের উন্নয়নে কাজ করছেন। এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কোন বিষয় আপনাকে উৎসাহিত করেছে?

আমি শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি ২০১১ সালে। এর আগে প্রায় ১২ বছর বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেছি। চাকরির সুবাদে নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করতে যেয়ে তাদের জন্য নিজে কিছু করার ইচ্ছা জাগে। তাছাড়া আমার স্বামীও আমাকে এ বিষয়ে শুরু থেকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন এবং এখনো সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছেন। শুরুটা হয়েছিল দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার কুমরপুর গ্রামে ১০ জন নারীকে নিয়ে। তাদের আমি সুতা দিতাম। তারা নিদের্শনামতো বিভিন্ন শতরঞ্জি পণ্য তৈরি করত। তাদের বর্গফুট অনুযায়ী পারিশ্রমিক দিতাম। তারা সবাই গৃহিণী। প্রথমে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বর্তমানে বাড়িভিত্তিক শতরঞ্জি পণ্য তৈরির পাশাপাশি রংপুরের শতরঞ্জি পল্লী বলে খ্যাত নিসবেতগঞ্জ এলাকার রাধাকৃষ্ণপুরে এবং ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল এলাকায় রংপুর ক্রাফট নামে শতরঞ্জির বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য দুটি কারখানা চালু করেছি। কারখানা দুটিতে ৪০০ জনেরও বেশি নারী কর্মরত। শতরঞ্জির বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে ফ্লোর মেট, দস্তরখানা, জায়নামাজ, ওয়াল মেট, টেবিল মেট,  বিভিন্ন প্রকার ব্যাগ অন্যতম।

শতরঞ্জির উপকরণ (কাঁচামাল), বিশেষ করে সুতা ও রঙ কি স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হয়? যদি উৎপন্ন না হয়, উপকরণ প্রাপ্তিতে কোনাে সমস্যা হচ্ছে কিনা? কর্মীদের কত টাকা করে দৈনিক মজুরি দেন?

শতরঞ্জি তৈরির মূল উপকরণ (কাঁচামাল) সুতা ও রঙ সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর। পিক মৌসুমে (শীতকালে) উপকরণ সংকট প্রকট হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য শতরঞ্জি স্থানীয় পণ্য হলেও এর উপকরণ বগুড়া জেলার আদমদীঘি শাওন নামক এলাকা এবং রাজধানী ঢাকা থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাই স্থানীয়ভাবে যাতে এসব উপকরণ পাওয়া যায়, সেদিকে আমি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। প্রত্যেক কর্মীকে তৈরি পণ্যের বর্গফুট মেপে মজুরি পরিশোধ করা হয়। প্রতি মাসে একজন কর্মী প্রকারভেদে ৬-১৪ হাজার টাকা আয় করেন। ক্রেতা পর্যায়ে শতরঞ্জি পণ্য পাইকারি বিক্রি হয় প্রতি বর্গফুট ৫৫-৭০ টাকা এবং খুচরা বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। 

শতরঞ্জির নতুন ধরনের নকশায় ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে কী করছেন?

আমরা সবসময় ক্রেতাদের পছন্দকে গুরুত্ব দিই। তাছাড়া সমসাময়িক কালে বাজারে কোন ধরনের নকশা ও রঙের সমন্বয়ে তৈরি শতরঞ্জি পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। আগে হাতির পা ও জামদানি নকশার চাহিদা ছিল। এখন উল্লেখযোগ্য নকশার মধ্যে জিগজাগ, বরফি, কয়েল, পাগলা-পাগলি ও মন্দির ডিজাইন অন্যতম। নকশার নামগুলোর অধিকাংশই কারিগরদের দেয়া।

বর্তমানে পৃথিবীর কয়টি দেশে আপনাদের পণ্য রফতানি হচ্ছে?

বর্তমানে আমেরিকা, জাপান, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, ইংল্যান্ডসহ আরো কয়েকটি দেশে আমার উৎপাদিত পণ্য যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে শতরঞ্জি তৈরির উপকরণ পাওয়া যায় না। ফলে বায়ারের চাহিদামতো শতরঞ্জি পণ্য সরবরাহ করতে পারলে রফতানির পরিমাণ আরো বাড়ানো যেত।

বর্তমানে কয়টি প্রতিষ্ঠান শতরঞ্জি তৈরি করছে? কয়টি পরিবার শতরঞ্জি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত? 

প্রায় ২৫টি প্রতিষ্ঠানে শতরঞ্জি তৈরি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার নিয়মিত শতরঞ্জি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া বাসাবাড়িতে অনেক পরিবারের সদস্যরা শতরঞ্জি তৈরি করছেন।

রংপুর ছাড়াও কোন কোন জেলায় শতরঞ্জি তৈরি হচ্ছে? সেগুলোর গুণগত মান কেমন?

রংপুর ছাড়াও দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীতে শতরঞ্জির বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে। বাইরের জেলায় তৈরি হলেও দেখা যায় কোনো না কোনো উদ্যোক্তা একাধিক কারখানা স্থাপন করেছেন। তাই গুণগত মানের সমস্যা হয় না। তবে কিছু অসাধু ব্যক্তি নিম্নমানের সুতা দিয়ে শতরঞ্জি পণ্য তৈরি করে তুলনামূলক কম দামে বাজারজাত করছে। একই রকম দেখতে মনে হওয়ায় অনেক ক্রেতা কম মূল্যে এসব পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। ওইসব কারণে মানসম্পন্ন শতরঞ্জি পণ্য বাজারজাত করে উদ্যোক্তারা সহজে বিক্রি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। 

কর্মীদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ কি আছে? এই প্রশিক্ষণ কারা দেন?

কর্মীরা আগে মূলত বিসিক থেকে শতরঞ্জি তৈরিতে প্রাথমিক ধারণা পেত। কিন্তু বর্তমানে প্রকল্পটি বন্ধ আছে। কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে পুনরায় এটি চালু করা দরকার। আমাদের প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ট্রেইনার আছে। তারা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া আমরা বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।

শতরঞ্জি শিল্পে ব্যাংকঋণ কি সহজে পাওয়া যায়?

মর্টগেজ ছাড়া কোনো ব্যাংক ঋণ দেয় না। একমাত্র ব্র্যাক ব্যাংক হচ্ছে ব্যতিক্রম। কোনো মর্টগেজ প্রয়োজন হয় না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উচিত ব্যবসার পরিধি দেখে ঋণের বিষয়টি বিবেচনা করা।

শতরঞ্জি শিল্পে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বলুন।

কর্মীদের সময়মতো পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য অনেক সময় আমাদের নামমাত্র মূল্যে শতরঞ্জি পণ্য বিক্রি করতে হয়। কোনো বিক্রয় নীতিমালা না থাকায় মধ্যস্বত্বভোগীরা কয়েক গুণ দাম বেশি নিচ্ছে। শতরঞ্জির কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন না হওয়ায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। করোনার আগে মখমল সুতা (স্যানেল) প্রতি কেজি ১৫০ টাকা ছিল। বর্তমানে প্রতি কেজি ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার সুতা স্থানীয়ভাবে ডায়িং না হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ডায়িং করতে সুতা ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ শিল্পে দক্ষ কারিগরের যথেষ্ট অভাবও রয়েছে।

শতরঞ্জি উন্নয়নে এবং বিভিন্ন অনিয়ম রুখতে আলাদা কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন আছে কিনা।

শতরঞ্জি বর্তমানে জিআই পণ্য। একটি স্থানের (রংপুর) অনেক দিন আগের কৃষ্টি, কালচার এবং মানুষের ভালোবাসার স্মৃতি বহন করছে বংশপরম্পরায়। কিন্তু করোনার সময় থেকে দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব হয়েছে। তারা অনলাইনে শতরঞ্জি পণ্য অধিক দামে বিক্রি করছে। এতে কারখানার মালিকের চেয়ে বেশি লাভ করছে তারা। তাই উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত দামের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা জরুরি। আমি মনে করি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের ধারণা খারাপ নয়। 

শতরঞ্জি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? 

ব্যবসার পরিধি বাড়ানো আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এখন বায়ারদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে শতরঞ্জি পাঠালেও নিকট ভবিষ্যতে নিজেই শতরঞ্জি পণ্য রফতানি করতে চাই। পণ্যের গায়ে লেখা থাকবে মেড ইন রংপুর ক্রাফট।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫