বিশ্বের দীর্ঘমেয়াদি এবং গুরুতর সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বায়ুমণ্ডলে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাস। বেঁচে থাকার প্রায় প্রতিটি নিয়ামককেই প্রভাবিত করছে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা। যেমন খাদ্যের সংস্থান, বাসস্থান, জীবিকা নির্বাহের উপায় ইত্যাদির পরিবর্তন হচ্ছে অহরহ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতি হচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতর। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাস করে, যেখানে মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্যে অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন সেই ধারার ঐক্যনাশ করেছে, যার ফলে এ অঞ্চলগুলো আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। বন্যা, খরা, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়, সুনামি, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের বিধ্বংসী বন্যা প্রায় ৩০ লাখ লোককে করেছে গৃহহীন এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে। দক্ষিণ সুদান টানা চতুর্থবারের মতো চরম বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। এদিকে সিরিয়ায় তিন বছর ধরে গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বজুড়ে লা নিনার বৈরী প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপে যখন গরমে জীবন ওষ্ঠাগত, উত্তর আমেরিকার অনেক শহর তখন রেকর্ড পরিমাণ বরফের নিচে চাপা পড়ে রয়।
উন্নত দেশগুলোই কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রধানত দায়ী। শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে উৎপাদনের মহাযজ্ঞ লক্ষ করা গেছে আজকের উন্নত দেশগুলোতে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ডামাডোলে চাপা পড়ে ছিল পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। তাদের উন্নয়নের দায় বহন করছে আজকের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান ভুক্তভোগী হলো বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চলগুলো। এ কথা বেশি সত্যি বাংলাদেশের মতো নিচু ও বন্যাপ্রবণ এলাকা যাদের মূল ভূখণ্ডের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তুলনামূলকভাবে কম। ছয় ঋতুর বাংলাদেশ তার স্বাভাবিক ঋতুচক্র হারিয়েছে অনেক আগেই। গ্রীষ্মকালে প্রখর খরা, শীতকালে অভাবনীয় শৈত্যপ্রবাহ, বর্ষাকালে বন্যা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণঘাতী জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্যে এক নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতের রেকর্ড ঘাঁটলে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার বৈরী প্রভাব আমাদের দেশের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনের একজন, যাদের বেশির ভাগই জীবনধারণের জন্যে কৃষির ওপর নির্ভরশীল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। উত্তর মেরুর বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে বাংলাদেশ তার ব্যবহারযোগ্য ভূমির প্রায় ১১ শতাংশ হারাতে পারে। এতে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে যারা নিচু এলাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে, নানাভাবে প্রভাবিত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিও নানা ধরনের পদক্ষেপ এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। সেই সঙ্গে প্রবাসী আয়ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জীবনধারার খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশী প্রবাসীদের একটা অংশ ‘জলবায়ু অভিবাসী’। জলবায়ুর বৈরী প্রভাব, যেমন জলোচ্ছ্বাস বা নদীভাঙনে তারা হয়তো হারিয়েছে তাদের শেষ ভিটেমাটিটুকু অথবা বানের জলে ভেসে গেছে জীবন রক্ষাকারী চাষের জমিটুকু। এদের অনেকেরই একরকম বাধ্য হয়েই মাইগ্রেশন করতে হয়েছে দেশের অন্য কোথাও অথবা বিদেশে। তাদের পাঠানো অর্থই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস। প্রবাসী আয়ের অন্তঃপ্রবাহে দেশটি শীর্ষ ১৫টি দেশের মধ্যে একটি। বিগত বছরগুলোতে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি ছিল রেকর্ড পরিমাণ। গত এক দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
বলা বাহুল্য যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দরকার পর্যাপ্ত তহবিলের। অর্থের উপযুক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তন কিছুটা রোধ করা যায় এবং সেই সঙ্গে বৈরী প্রভাবগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। ২০০৯ সালে কপ-১৫ [কনফারেন্স অব পার্টি] সম্মেলনে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে বার্ষিক দশ হাজার কোটি মার্কিন ডলার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু-সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো জলবায়ুর জন্যে নিবেদিত বৈশ্বিক তহবিল থেকে অভিযোজন উদ্যোগের জন্য মাত্র ৩৭ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ হয়েছে বাংলাদেশের জন্য, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। এ অবস্থায় রেমিট্যান্স হতে পারে অর্থায়নের একটি টেকসই উৎস। অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকরা রেমিট্যান্স বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করেন। অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরেও রেমিট্যান্সের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হয় হারহামেশাই। তবে জাতীয় এবং পারিবারিক পর্যায়ে রেমিট্যান্স কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাস এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে সে সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।
জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নানাবিধ পরিবেশ সহায়ক নীতি গ্রহণ করে সরকার, যেমন বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নতুন নতুন আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন, উপকূলীয় এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি ইত্যাদি। এসব উদ্যোগে রেমিট্যান্স হতে পারে প্রয়োজনীয় তহবিলের উৎস। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পারিবারিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বেশি। রেমিট্যান্স গ্রহণকারী পরিবারগুলো জলবায়ুর নানান সমস্যা মোকাবেলায় এই অর্থ ব্যবহার করে, বিশেষ করে যারা পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করেন। উপকূলীয় অঞ্চলে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। গ্রামীণ বাসিন্দারা যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের মতো জলবায়ু বিপর্যয়ে নিজেদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নিতে পারে। এ নিমিত্তে উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা বিভিন্ন যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসন্ন পরিবেশগত বিপর্যয় সম্বন্ধে অবগত এবং মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হতে পারে। যেসব পরিবারে রেমিট্যান্সের অন্তঃপ্রবাহ বেশি, সেসব পরিবারে যোগাযোগের মাধ্যম এবং প্রযুক্তি ক্রয় এবং ব্যবহার ক্ষমতা বেশি থাকবে। তাই তারা জলবায়ুজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় অধিকতর প্রস্তুত থাকবে। অধিকন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফি বছর। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে বন্যার কারণে ক্ষতির পরিমাণও। আকস্মিক বন্যার পুনরাবৃত্তিসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে প্রতি বছর। তাই বাড়িতে বিভিন্ন রকমের জলবায়ু সহনশীল এবং টেকসই উপকরণের ব্যবহার, সমুদ্রসীমা থেকে বাড়ির উচ্চতা বৃদ্ধিকরণসহ গ্রামীণ এবং উপকূলীয় বাসিন্দাদের নানা পদক্ষেপ নিতে হয়। এই প্রক্রিয়া বেশ ব্যয়বহুল। উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা যাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি থাকবে তারা এসব ব্যয় বহন করা জলবায়ুজনিত ঝুঁকি হ্রাস করতে সমর্থ হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকও। খরা, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় বীজ, গাছপালা এবং ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে এ কথা বলা বাহুল্য। ফলে কৃষকের জীবিকা নির্বাহ ও খাদ্যনিরাপত্তায় নেতিবাচকভাবে প্রভাব পড়ে। কৃষক পরিবার যারা রেমিট্যান্স পায় তারা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধী বীজ, ফসল এবং চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা রাখে।
মানুষের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা অর্জন জরুরি। এ দুইয়ের জন্যেই আর্থিক সক্ষমতা অত্যাবশ্যকীয়। প্রবাসীদের পাঠানো তহবিল হতে পারে এ অর্থের অন্যতম উৎস। সাম্প্রতিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে একটি নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কীভাবে পরিবারকে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা করে সেই দিকগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারলে প্রবাসীরা পরিবারের কাছে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত হবে। বাড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণও।
ড. সামসুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক
শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউকে
ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক
নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান