ওয়াসার গাফিলতিতেই ঢাকার খালের সর্বনাশ

প্রকাশ: মার্চ ২২, ২০২৩

মোহাম্মদ এজাজ । রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান। নদী, পরিবেশ এবং জলবায়ু ইস্যুতে কাজ করছেন। তিনি বাংলাদেশে কর্মরত ৫০টিরও বেশি নদীভিত্তিক সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট সুশীল সমাজের জোট জিবিএম পিপলস নেটওয়ার্কের নির্বাহী সহসভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা। এক দশক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর এখন তিনি প্রাকৃতিক সম্পদ, পানি, নদী ও জলাশয় সংরক্ষণ এবং অববাহিকার জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকার খাল, জলাশয় ও জলাভূমির একাল-সেকাল নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন

ঢাকার খাল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। দুই দশকে ঢাকার খালগুলোতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন? 

ঢাকার ইকোলজি ও জিওগ্রাফি আমরা চিন্তা করি, দেখা যাবে দুই দশক আগে থেকেই ঢাকায় নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বাড়তে শুরু করে। আমরা প্রচুর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আগারগাঁও, কাজীপাড়া, মিরপুর, তেজগাঁওয়ে দেখেছি। আর পুরান ঢাকার পুরোটাই তো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা ছিল। এর পাশাপাশি ঢাকার পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক, সেচ মেশিন ইত্যাদি এবং সারের ব্যবহার বেড়ে যায়। এর ফলে প্রচুর কৃষি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে এ শ্রমিকরা গ্রাম থেকে শহরমুখী হতে শুরু করে। শহরের ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে সহজে কাজ পাওয়া যায়। আর বস্তিতেও কম টাকায় বসবাস করার সুযোগ আছে। আশির দশকের পর থেকেই ঢাকায় ব্যাপক হারে কাজের খোঁজে মানুষ আসতে থাকে। ফলে ঢাকায় প্রচুর আবাসনের চাহিদা তৈরি হয়। শুরুর দিকে ইনফরমালভাবে মানুষ বস্তিতে থাকা শুরু করে। এখনো ঢাকার ৩০ শতাংশ মানুষ ইনফরমালভাবে আবাসনের চাহিদা পূরণ করছে। এর মধ্যে ১৯৮৮-এর ভয়াবহ বন্যা দেখল ঢাকা। ফলে বন্যা সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে ঢাকাকে আরো শুষ্ক করে ফেলা হয়। ৯০-৯১ সালের এ বাঁধ নির্মাণ হয়। এটাকে নাম দেয়া শহররক্ষা বাঁধ। এই বাঁধের কারণে ঢাকার জিওগ্রাফি পুরোপুরি পাল্টে যায়। বর্ষার সময় ঢাকার যে অঞ্চল তলিয়ে যেত, সেটা এখন আর তলায় না। যেমন পুরো উত্তরা, গাবতলী থেকে শুরু করে মিরপুরের নিচু জমি পুরোটা, পাইকপাড়া, মনিপুর, ভাসানটেক, মোহাম্মদপুরের বড় অংশ এগুলো সব তলিয়ে যেত। বর্ষা চলে গেলে এসব এলাকায় ধান চাষ হতো। এখনো আপনি যদি ঢাকার পশ্চিম অংশে যান বিশেষ করে তুরাগের ওইপারে এখনো বর্ষায় পুরো এলাকা তলিয়ে যায়, পানি চলে গেলে ধান চাষ করা হয়। যখন শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ হলো তখন আমরা ঢাকাকে পুরোপুরি শুষ্ক এলাকা করে ফেলেছি। আসলে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা তখন করা হয়নি। একটি শহরকে যে পুরোপুরি শুষ্ক এলাকায় রূপান্তর করা কোনোভাবেই উচিত নয়, শহরে জলাভূমি রাখতে হয়, বন্যার প্রকৃতি রক্ষা করতে হয় এ বিষয়গুলো তখন মাথায় না নেয়ার ফলেই ঢাকার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ে। ভুল নীতিতে শহরকে শুষ্ক করার পর পরই জলাভূমি ও খাল বিল ঝিলের জমির দাম রাতারাতি বাড়তে শুরু করে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষজন তখন জমি কিনে নেয়। এর ফলে দেদারসে খাল দখল হতে থাকে। ঝিল ভরাট হতে থাকে। জলাভূমিতে সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্প হয়ে ঢাকার বাসযোগ্যতা পুরোপুরি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। 

তার মানে ঢাকার জলাভূমি ও খাল ধ্বংসের পেছনে সরকারি-বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলো বড় ভূমিকা পালন করেছে?

অবশ্যই। বাঁধ নির্মাণের পরপর প্রথম সরকারি উদ্যোগে আবাসিক এলাকা জোনিং করা হয়। উত্তরা, বনশ্রী, শেখেরটেক, মোহাম্মদপুর, মালিবাগ চৌধুরীপাড়াসহ নতুন ঢাকায় সরকার আবাসিক এলাকা জোনিং করে। সরকারের দেখাদেখি বেসরকারি আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসেন। তারাও অপরিকল্পিতভাবে জলাভূমি ও খাল দখল করে আবাসন ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে ঢাকায় যতগুলো আবাসন প্রকল্প আছে এর সবই সিএস ম্যাপ অনুযায়ী জলাভূমি ও খাল ভরাট করে গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলোতেও খাল ভরাট হয়েছে। যেমন উত্তরায় অনেক খাল ছিল, বনশ্রী পুরোটাই বিল ছিল, আফতাবনগরে এখনো খাল ভরাট চলছে। একইভাবে ছোট ছোট ঝিলও ভরাট হয়ে যায়। ঢাকায় এখনো অনেক জায়গার নাম ঝিলপাড়া আছে কিন্তু সেখানে ঝিলের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরাও পাল্লা দিয়ে খাল, জলাভূমি ও কৃষিভূমি ভরাট করেছেন। এক্ষেত্রে রাজউক কোনো বাধাই দেয়নি।

ভরাটের শুরুর দিকে বাধা দেবে কীভাবে? তখন তো বোঝা যায়নি জলাভূমি ও খাল ভরাটের মূল্য এমন চরমভাবে দিতে হবে।

সরকারের এ আচরণটাই তো ভুল। কোনো একটা বিষয় শুরুতেই অ্যাকশনে যায় না। ঘটনা ঘটে গেলে, অপরিকল্পিতভাবে খাল ভরাট হলে তখন অ্যাকশনে যায়। একবার টাকা খরচ করে ভরাট করেছে, আবার টাকা খরচ করে খনন করবে বা ভাঙবে। এটা তো রিঅ্যাক্টিভ অ্যাকশন। বরং সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘটনা ঘটার আগেই পরিকল্পিতভাবে অ্যাকশন নিতে হবে। শুরুতেই কঠোরভাবে বলে দিতে হবে, তুমি এটা করতে পারবে অথবা পারবে না। এমন না যে তখন পরিবেশ বা জলাভূমি নিয়ে আমরা কথা বলিনি। বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়েছে আজ থেকে ২৮ বছর আগে। 

আবাসন প্রকল্পের তোড়ে খাল দখল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খালকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। ১০ বছর আগেও ঢাকার খালে সমৃদ্ধ নৌযোগাযোগ ছিল। এ নিয়ে কিছু বলুন। 

ঢাকার খাল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, পশ্চিম ঢাকার লোকেরা বলছে আমরা নৌকাযোগে পূর্ব ঢাকায় গিয়েছি। একইভাবে পূর্বের লোকেরা নৌকায় চড়ে পশ্চিমে এসেছে। খালকেন্দ্রিক এ যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসের ক্ষেত্রে আবাসন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রাস্তা ও নিচু সেতু সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে খালের ওপর কালভার্ট নির্মাণ করে ঢাকার খালের সর্বনাশ করে ফেলে। সরকারিভাবে যখন খালকে মিনিমাইজ করে রাস্তা নির্মাণ করা হলো, তখন সাধারণ মানুষ এটা শিখে ফেলল। মানুষ ভাবল, সরকার যদি খালকে কালভার্ট বানাতে পারে আমরা কী দোষ করলাম। তখন ব্যক্তি উদ্যোগে খালগুলো দখল ও ভরাট হতে শুরু করে। নতুন যে হাউজিং হচ্ছে তারাও খাল ভরাট করে প্লট বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে তারা বলছে, পানি পাসের জন্য আমরা সরকারি মডেলে কালভার্ট করে দিচ্ছি। এটা তো তাদের শেখানো হয়েছে। অথচ খালের ওপর বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করলে অর্থাৎ ব্রিজ হবে উঁচু, এতে ওপরে গাড়ি চলাচল করবে, আর নিচে নৌকা চলবে, এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আজ ঢাকার এ অবস্থা হতো না। 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওয়াসার অবহেলায় ঢাকার অবশিষ্ট খালগুলোও দখল-দূষণে মৃতপ্রায়—এ বিষয়ে আপনার মত কী?

হ্যাঁ একটা বড় ভূমিকা তো ওয়াসার রয়েছে। ওয়াসা খালের দায়িত্ব পেয়েছিল আশির দশকে। আর যখন থেকে ওয়াসাকে খালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার পর থেকেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা শুরু হয়েছে। খালের দখল সবচেয়ে বেশি হয়েছে ওয়াসা দায়িত্বে থাকাকালে। এর আগে খালের দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের কাছে। তাদের থেকে খালের দায়িত্ব ওয়াসাকে দেয়া হয়। কিন্তু ওয়াসা এ দায়িত্ব নিতে চায়নি এবং দায়িত্ব নেয়ার পর কিছু করতেও পারেনি। আর দ্বিতীয়ত এমন কোনো খাল নেই যেখানে স্যুয়ারেজ লাইনের পানি যায় না। তার মানে ওয়াসা ইচ্ছাকৃতভাবে স্যুয়ারেজ লাইনের নোংরা পানি খালে দিয়েছে। ওয়াসা আসলে এখন পুরো নিরুপায়। স্যুয়ারেজ লাইন তো এখানে আসার কথা ছিল না। এখন লাইন আছে। কিন্তু এটা যদি বন্ধ করে দেন তাহলে এ লোকগুলো বসবাস করবে কীভাবে? স্যুয়ারেজ লাইন ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের সেপটিক ট্যাংক করতে হবে। আমি বলব, ওয়াসা চাইলে খালগুলো সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারত। সে দক্ষতা ও জনবল দুটোই ওয়াসার ছিল। কিন্তু ওয়াসা ইচ্ছাকৃতভাবে খালগুলো নষ্ট করেছে। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য ওয়াসার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ঢাকার খালগুলো সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে এবং হারিয়েও গেছে। 

দুই সিটির তত্ত্বাবধানে খালগুলো কেমন আছে?

আশার কথা হলো এখনো ঢাকায় অনেক বড় বড় খাল ও জলাশয় আছে। যেগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে ঢাকার ইকোলজি অনেকটাই রিকভার করা সম্ভব। হাতিরঝিল ও ধানমন্ডি লেক এ দুটো অনেক বড় জায়গা নিয়ে এখনো টিকে আছে। পিলখানার ভেতর লেক  ও পুকুর আছে। আজিমপুরে সরকারি হাউজিংয়ে পুকুর আছে। আবার এর সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছি এখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক জলাভূমি আছে। ঢাকা শহরে সাড়ে তিনশর বেশি জলাভূমি আছে। এগুলো খুব দ্রুত ভরাট হয়ে যাবে, যেহেতু সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই। ড্যাপের মধ্যেও এগুলোকে জলাভূমি হিসেবে আইডেন্টিফাই করা হয়নি। দেখা যাবে কিছুদিনের মধ্যেই একটা পুকুর ভরাট করে মার্কেট, ভবন করা হয়ে গেছে। আমার দৃঢ়ভাবে মনে হয়, ইকোলজি রক্ষা করার ক্ষেত্রে এগুলো করা উচিত ছিল না। সে জায়গা থেকে আমরা বড় সংকট দেখি। এখন আপনার প্রশ্নে আসি, ঢাকার খালগুলো কেমন আছে। এখানে দুইটা বিষয়। একটা হলো কিছু নতুন ওয়াটার বডি তৈরি হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো অনেক পুরনো ওয়াটার বডিগুলো নষ্ট হয়েছে। পুরনো ওয়াটার বডিগুলো সিটি করপোরেশনকে দেয়ার পর ব্যবস্থাপনা কতটুকু হচ্ছে এটাই এখন বড় প্রশ্ন। কিছুটা ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। আগে ওয়াসা প্রায় শতকোটি টাকা খাল পরিষ্কারে খরচ করত। এখনো দুই সিটি করপোরেশন খালগুলো পরিষ্কার করেছে। কিন্তু পরিষ্কার করার পর আর কোনো উন্নয়ন দেখিনি। আমরা সম্প্রতি  খালের সীমানা নির্ধারণের কথা শুনছি। এ সার্ভেটা কীভাবে হচ্ছে এ ব্যাপারে আমরা কেউ ওয়াকিবহাল না। মেয়র সেটা পরিষ্কার করছেন না। কারণ এটা দেখার দায়িত্ব সার্ভে বিভাগের। তারা তো সার্ভেটা করছে না, বলা হচ্ছে ড্রোন দিয়ে সার্ভে করা হচ্ছে। একটা ভূমি সার্ভে কখনো ড্রোন দিয়ে হয় না। সরকারি সার্ভে ড্রোন দিয়ে করার কোনো ম্যান্ডেট নেই। সরকারি খালের সার্ভে যিনি করবেন সেটা ভূমি জরিপ অধিদপ্তর থেকে করতে হবে। আমরা মনে করি ভূমি জরিপ অধিদপ্তর থেকে সার্ভেটা করা উচিত, এটা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন ভাবছে, খালগুলোকে মানুষ যেভাবে জোর-জবরদস্তিমূলক দখল করেছে, আবার দখলমুক্ত করাটাও জবরদস্তিমূলক হওয়া চাই। কিন্তু মেয়রদের আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, খাল দখলদার উচ্ছেদের ব্যাপারে এ ধরনের জবরদস্তিমূলক আচরণ হওয়া উচিত নয়।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫