ব্রিটিশ ওয়েস্ট
ইন্ডিজের প্রথম
সুগার ব্যারন
ছিলেন কর্নেল
জেমস ড্রাক্স।
বার্বাডোজের দ্বীপে
তিনি অন্য
প্লান্টারদের আমন্ত্রণ
জানাতেন বিলাসী
পার্টির জন্য।
এ অঞ্চলে
ব্রিটিশদের আরেক
প্রাথমিককালের প্লান্টেশনের
ম্যানেজার রিচার্ড
লিজন এ
রকম পার্টিতে
অংশ নিয়েছিলেন।
তার কথা
এসব পার্টিতে
থাকত আকর্ষণীয়
সব খাবারের
অঢেল উপস্থিতি।
আনারস তখনো
ইংল্যান্ডের মানুষের
পরিচিত নয়,
কিন্তু জেমস
ড্রাক্সের পার্টিতে
সেগুলো পরিবেশন
করা হতো
আর লিজন
ছিলেন আনারসের
ভক্ত।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে
ড্রাক্সের জীবন
কোনো শাহজাদার
চেয়ে কম
ছিল না।
নিজের সুগার
প্লান্টেশনে তিনি
জ্যাকোবিন ম্যানশন
নির্মাণ করেছিলেন।
তিনি ছিলেন
বার্বাডোজের সবচেয়ে
ধনী ব্যক্তি।
অন্যদিকে লিজন
বার্বাডোজে পা
রেখেছিলেন ১৬৪৭
সালে, সে
বছরই এ
দ্বীপ নগণ্য
এক ব্রিটিশ
সেটলমেন্ট থেকে
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
সবচেয়ে ধনী
প্লান্টেশনে পরিণত
হয়েছিল। ১৬৫৭
সালে প্রকাশিত
লিজনের আ ট্রু
অ্যান্ড এক্সাক্ট হিস্টরি অব
দ্য আইল্যান্ড অব বার্বাডোজ গ্রন্থে
তিনি বর্ণনা
করেছেন, কীভাবে
চিনি এ
দ্বীপকে বদলে
দিয়েছিল। জমির
দাম আসমান
ছুঁয়েছিল। কর্নেল
মডিফোর্ড ৭
হাজার পাউন্ড
পরিশোধ করেছিলেন
হিলিয়ার্ডের ৫০০
একরের সুগার
প্লান্টেশনের অর্ধেক
শেয়ারের জন্য।
কিন্তু এর
জন্য পাঁচ
কী ছয়
বছর আগে
দিতে হতো
মাত্র ৪০০
পাউন্ড। এ
একটি উদাহরণ
থেকেই বোঝা
যায় চিনি
সেদিন ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যের জন্য
কী ভূমিকা
রেখেছিল। এর
আগে তামাক
ও তুলা
ছিল দ্বীপের
প্রধান অর্থকরী
শস্য। লিজন
সঠিকভাবেই অনুমান
করেছিলেন যে
২০ বা
৩০ একরের
এসব ছোট
প্লান্টেশনের এ
দ্বীপ, যা
ইংল্যান্ডের আইল
অব উইটের
তুলনায় খুব
একটা বড়
না, একসময়
‘দুনিয়ার
অন্যতম ধনী
স্থান’-এ
পরিণত হবে।
ক্যাপ্টেন জন
পাওয়েল ১৬২৫
সালে বার্বাডোজের
নির্জন দ্বীপে
ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের
দাবি করেন।
তিনি তখন
কোর্টিন টেক্সটাইল
ট্রেডিং কোম্পানির
পক্ষ থেকে
নৌযাত্রায় দক্ষিণ
আমেরিকা থেকে
ফিরছিলেন। তিনি
দ্বীপে একটি
ক্রুশ স্থাপন
করেন এবং
ব্রিটিশ রাজার
নাম একটি
গাছের গায়ে
খোদাই করে
দেন। উইলিয়াম
কোর্টিনের আর্থিক
সমর্থন নিয়ে
দুই বছর
পর নিজের
ভাই হেনরি
পাওয়েলকে নিয়ে
পুনরায় দ্বীপে
ফিরে আসেন
জন। তাদের
সঙ্গে ছিলেন
দ্বীপে বসতি
গাড়তে আগ্রহী
৫০ জন
আশাবাদী সেটলার।
তাদের মধ্যে
ছিলেন ১৮
বছর বয়সী
জেমস ড্রাক্স।
সে সময়
সাম্রাজ্য নিয়ে
ব্রিটিশদের ধারণা
বদলে যাচ্ছিল।
১৬২০-এর
দশকে ভার্জিনিয়া
বছরে দুই
লাখ পাউন্ড
তামাক পাঠাচ্ছিল
ইংল্যান্ডে। দেশটিতে
তামাকের বিক্রি
বাড়ছিল; এক
পাউন্ড তামাক
প্রায় ১
পাউন্ড বয়ে
আনত। প্রমাণিত
হয়েছিল যে
অর্থকরী ফসল
জন্মানো যায়
এমন উপনিবেশগুলো
ব্রিটিশদের জন্য
লাভজনক। হেনরি
পাওয়েল লোকজনকে
বার্বাডোজে রেখে
চলে যান
ডাচ গায়ানায়।
সেখান থেকে
খাদ্য, তামাকগাছ
ও বীজ
নিয়ে ফিরে
আসেন। এছাড়া
হেনরির সঙ্গে
ছিল তিন
ক্যানো ভর্তি
আরাওয়াক ইন্ডিয়ান।
কৃষি জ্ঞানের
জন্য ইংরেজরা
আরাওয়াকদের ওপর
নির্ভরশীল ছিল।
তাদের আশা
ছিল এ
আরাওয়াকদের সহায়তায়
তারা ভার্জিনিয়ার
তামাকচাষীদের মতো
সফল হবেন।
দ্বীপের সেটলারদের
মধ্যে একজন
ছিলেন হেনরি
উইনথ্রপ। তিনি
ইংল্যান্ডে থাকা
তার বাবাকে
আশ্বস্ত করেছিলেন
দ্বীপে তামাক
চাষ করে
বেশ মোট
অর্থ আয়
করা যাবে।
কিন্তু উৎপাদিত
তামাকের মান
ভালো না
হওয়ায় তার
সে আশায়
গুড়েবালি পড়ে
যায়। এ
হেনরি উইনথ্রপের
মতো জেমস
ড্রাক্সও তামাক
থেকে লাভের
আশা করছিলেন।
কিন্তু তামাকের
খারাপ মানের
কারণে আশানুরূপ
লাভ হচ্ছিল
না। ১৬৩০
নাগাদ সবাই
বুঝে গিয়েছিলেন
তামাক তাদের
ভাগ্য পরিবর্তন
করবে না।
এরপর ড্রাক্স,
হিলার্ড ও
জেমস হলডিপ
মিলে তুলায়
বিনিয়োগ করলেন।
কিন্তু ১৬৩০-এর
দশকের শেষ
নাগাদ এ
পণ্যও বাজারে
ভালো দাম
পাচ্ছিল না।
এবার এ
ত্রয়ী নতুন
কোনো শস্য
খুঁজছিলেন এবং
তাদের দৃষ্টি
আকর্ষণ করল
চিনি। ১৬৩০-এর
দশকে ব্রাজিলের
উত্তর-পূর্ব
উপকূল ছিল
বৈশ্বিক চিনি
উৎপাদনের হাব।
মধ্যযুগের আদি
পর্বেই চিনি
উৎপাদনের কেন্দ্র
উত্তর ভারত
থেকে লেভেন্ট-এ
চলে আসে।
পঞ্চদশ শতাব্দী
নাগাদ ইউরোপের
চিনির চাহিদা
পূরণ করত
সাইপ্রাস ও
সিসিলি।
ড্রাক্স ১৬৪০
সালে ব্রাজিল
সফর করেন—উদ্দেশ্য
ছিল চিনি
চাষ ও
উৎপাদন প্রক্রিয়া
সম্পর্কে জ্ঞান
লাভ। ১৬৫০
সাল নাগাদ
ড্রাক্স বার্বাডোজে
চিনি উৎপাদনে
মোটামুটি পারদর্শী
হয়ে ওঠেন।
নিউফাউন্ডল্যান্ডের ফিশারি
যদি শিল্প
গঠন ও
সংগঠনের অগ্রদূত
হয়ে থাকে,
তাহলে ওয়েস্ট
ইন্ডিজের সুগার
প্লান্টেশন ছিল
দুনিয়ার প্রথম
অ্যাগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল
ফ্যাক্টরি, যেখানে
উৎপাদন চাহিদার
অধীন কর্মশক্তি
পরিচালিত হয়েছিল।
চিনি উৎপাদনে
পর্তুগিজদের ব্যবস্থাপনা
অনুসরণ করেনি
বার্বাডোজের ব্রিটিশ
সেটলাররা। ধনী
প্লান্টাররা একটা
চিনির মিল
স্থাপন করেন
এবং সেখানে
আখের সরবরাহ
আসত ভাগচাষীদের
কাছ থেকে।
ড্রাক্স চিনি
উৎপাদন ও
পরিশোধনে অনেক
বেশি দক্ষ
ব্যবস্থা গড়ে
তোলেন। এমনকি
আখ ক্ষেতেও
শিল্প কাঠামোর
শ্রম বিভাগের
নীতি প্রয়োগ
করা হয়েছিল।
চারা রোপণ,
আগাছা পরিষ্কার
ও গাছ
কাটার জন্য
আলাদাভাবে দক্ষ
কর্মীদের নিয়োগ
করা হয়।
সবাই একটি
বড় যন্ত্রের
অধীন বিভিন্ন
অংশে কাজ
করতে শুরু
করেন। দাসদের
বিভিন্ন শিফটে
ভাগ করা
হয়েছিল, যেন
উৎপাদন প্রক্রিয়া
নিরবচ্ছিন্ন থাকে।
বিভিন্ন প্রক্রিয়ার
সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা
ও সংগঠনের
গুরুত্ব, ফসলের
মাঠ ও
ফ্যাক্টরিকে এক
জায়গায় নিয়ে
আসা এবং
জমি থেকে
শ্রমিক ও
প্রসেসিং প্লান্টের
বিনিয়োগ শুধু
প্লান্টারদের হাতে
থাকা—সব
মিলিয়ে এ
সুগার প্লান্টেশনগুলো
তখন পর্যন্ত
হয়ে উঠেছিল
পুঁজিবাদের একটি
আগ্রাসী মডেল।
সে সময়ের
ইউরোপীয় ফার্ম
ও ইন্ডাস্ট্রিগুলোর
চেয়ে অনেক
এগিয়ে ছিল
বার্বাডোজের এ
অ্যাগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল
চিনি প্লান্টেশনগুলো।
অষ্টাদশ শতাব্দীর
শেষ দিকে
নিজের ডায়েরিতে
জাহাজের পার্সার
অ্যারন থমাস
লিখেছিলেন, ‘আমি
আর কখনো
চায়ে চিনি
মিশিয়ে পান
করব না।
কারণ এ
চিনি নিগ্রোদের
রক্ত ছাড়া
আর কিছুই
নয়।’ তার
ফ্রিগেট যখন
ওয়েস্ট ইন্ডিজে
গিয়েছিল, তখন
সেখানকার চিনি
উৎপাদন প্রক্রিয়া
দেখে তিনি
এ কথা
লিখেছিলেন। কিন্তু
চিনি উৎপাদনের
সেই প্রাথমিককালে
এটা শুধু
নিগ্রোদের রক্ত
ছিল না,
সঙ্গে শ্বেতাঙ্গদের
রক্তও তাতে
মিশে ছিল।
বার্বাডিয়ান প্লান্টাররা
শ্বেতাঙ্গ চাকরদের
ব্যবহার করত
বন কেটে
জমি তৈরি
করা এবং
তাতে আখ
লাগানো থেকে
চিনি উৎপাদনে।
১৫৩০ থেকে
১৬৩০ সালের
মধ্যে ইংল্যান্ডে
বিভিন্ন কৃষি
সংস্কারের কারণে
গ্রামের প্রায়
অর্ধেক কৃষক
জমি হারিয়েছিলেন।
কেউ কেউ
নতুন দক্ষতা
অর্জন করে
কারিগর হিসেবে
আবির্ভূত হন।
১৬২০ নাগাদ
ভূমিহীন শ্রমিকরা
কাজের খোঁজে
বিভিন্ন স্থানে
ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
আর সুযোগটিই
নিয়েছিলেন সুগার
প্লান্টেশনের মালিকরা।
বণিকরা এ
শ্রমিকদের সংগ্রহ
করে ওয়েস্ট
ইন্ডিজে পাঠাতে
শুরু করলেন।
তাদের চার
বা পাঁচ
বছরের জন্য
প্লান্টারদের কাছে
বিক্রি করে
দেয়া হতো।
এ সময়কালের
পর সেই
নিউ ওয়ার্ল্ডে
তাদের পেশাগত
প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে
সহায়তা করা
হতো। এটা
ছিল স্বল্পকালীন
দাস ব্যবস্থা।
এক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ
মালিকরা এ
শ্বেতাঙ্গ দাসদের
বিশেষ কোনো
সুবিধা দিতেন
না। আইরিশ
বিদ্রোহীদেরও পাঠিয়ে
দেয়া হতো
বার্বাডোজের সুগার
প্লান্টেশনে। তাদের
দেশে ফেরা
নিষিদ্ধ করা
হয়। ১৮৪০-এর
দশকে বার্বাডোজে
পৌঁছেছিল আট
হাজার শ্বেতাঙ্গ
‘দাস’।
কিন্তু এতে
বিকাশমান চিনি
শিল্পের শ্রমের
চাহিদা মিটছিল
না। ১৬৪১
সালে পশ্চিম
আফ্রিকা থেকে
কৃষ্ণাঙ্গ দাস
বোঝাই প্রথম
জাহাজ বার্বাডোজে
হাজির হয়।
ধনী প্লান্টাররা
তাদের তত্ক্ষণাৎ
কিনে নেন।
ধীরে ধীরে
বিস্তৃত হতে
থাকে ব্রিটিশদের
দাস ব্যবসা।
উপনিবেশগুলোয় রুপার
খনির অভাবের
ক্ষতিপূরণ করতে
ইংরেজরা যে
পণ্যটি খুঁজে
পেয়েছিল তার
নাম চিনি।
সপ্তদশ শতাব্দীর
শেষ ভাগে
ইংল্যান্ড ৩
লাখ ২০
হাজার কুইন্টাল
ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান
চিনি আমদানি
করত, যার
মূল্য ছিল
সে সময়ের
৬ লাখ
৩০ হাজার
পাউন্ড। কুইন্টালপ্রতি
চিনি আমদানিতে
একটি রাজস্ব
পেত ব্রিটিশরাজ।
শুধু চিনির
আর্থিক মূল্যই
যে ইংল্যান্ডের
সমৃদ্ধিতে ভূমিকা
রেখেছিল বিষয়টা
তেমন নয়।
চিনিকে কেন্দ্র
করে বিকশিত
হয়েছিল বাণিজ্য
ও শিল্প
ব্যবস্থা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
ছিল প্রথম
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
কেন্দ্র, যা
অন্যসব উপনিবেশগুলোকে
একটি জালে
আবদ্ধ করেছিল।
এ ঘটনা
বিকশিত করেছিল
নৌবিদ্যা, দক্ষতা,
শিল্প ও
আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে।
সপ্তদশ শতাব্দীর
অর্থনীতিবিদ চার্লস
ডেভন্যান্ট উল্লেখ
করেছিলেন, ‘এগুলো
স্বর্ণ কিংবা
রুপার চেয়ে
কোনো জাতির
জন্য সত্যিকার
সম্পদ।’ প্রথম
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
নতুন এক
প্লান্টার, বণিক,
বিনিয়োগকারী ও
শিল্পপতি শ্রেণীর
জন্ম দিয়েছিল।
এদের বিশেষত্ব
ছিল এরা
জমির চেয়ে
বাণিজ্যকে ভিত্তি
করে বিকশিত
হয়েছিল। এবং
এরা জমির
মালিকানাকেন্দ্রিক অভিজাততন্ত্রকে
চ্যালেঞ্জ করার
মতো অর্থনৈতিক,
সামাজিক ও
রাজনৈতিক ক্ষমতা
অর্জন করেছিলেন।
আটলান্টিক বাণিজ্য
ব্যবস্থা কাঠামোগত
পরিবর্তন ও
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
নিশ্চিত করেছিল,
যা ব্রিটেনের
শিল্প বিপ্লবকে
সফল করে।
শানজিদ অর্ণব: লেখক ও সাংবাদিক