১৯২৯ সালে ভয়াবহ ধসের মুখে পড়ে
মার্কিন শেয়ারবাজার। যার প্রভাবে তিন-চার বছরের মধ্যে দেশটির পুরো অর্থনীতিই মন্দাক্রান্ত হয়। এ মন্দা কেবল
যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিশ শতকের সবচেয়ে
দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাব বিস্তারকারী এ মন্দার নেপথ্যে রয়েছে ওয়াল স্ট্রিটে মাত্র
চারদিনের ধস। ওই ঘটনার নয় দশক পেরিয়ে গেলেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করাটা আজও
প্রাসঙ্গিক।
মার্কিন পুঁজিবাজারে ধস ও মহামন্দা
সেই মহামন্দার আগের অবস্থা বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায়, তার আগের দশকে মার্কিন ব্যাংকগুলো শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে অতি
উদার নীতি গ্রহণ করেছিল। ঋণের অর্থে শেয়ার কিনতে গিয়ে অনেকে ঝুঁকির বিষয়টি
একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। শেয়ারবাজারে ধস নামায় ব্যাংকগুলো ঋণের অর্থ আর পুরোটা ফেরত
পায়নি। ফলে শেয়ারবাজারে ধসের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও ধস
শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে তা প্রকৃত অর্থাৎ উৎপাদনের অর্থনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখান
থেকেই শুরু হয় মহামন্দা। ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপি প্রায় ১৫
শতাংশ কমে যায়। বিশ্বের কয়েকটি দেশের অর্থনীতি ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝিতে মন্দার
ধকল কাটাতে পারলেও অনেক দেশে এর প্রভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত ছিল।
ধনী-দরিদ্র সব দেশের জন্যই সেই মহামন্দার
প্রভাব ছিল ব্যাপক বিধ্বংসী। এর কারণে ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে যায় ৫০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বেড়ে যায় ২৫ শতাংশ।
অন্যান্য দেশেও বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে মহামন্দার
তীব্র প্রভাব ছিল, বিশেষ করে যেসব শহর ভারী শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অনেক দেশে
নির্মাণকাজ এক প্রকারে বন্ধই হয়ে যায়। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিও ভয়াবহ লোকসানের মুখে
পড়েছিল। শস্যের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। গুটিকয়েক কর্মসংস্থানের উৎসে
অত্যধিক চাহিদার কারণে প্রাথমিক শিল্প যেমন খনি শিল্পে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদরা মার্কিন
পুঁজিবাজারের হঠাৎ দরপতনকে মহামন্দার সূত্রপাত বলে অভিহিত করেন। যদিও কারো কারো
কাছে এই দরপতন ছিল মহামন্দার উপসর্গ মাত্র,
কারণ নয়।
১৯২৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট ধসের পরও কিছু
অর্থনীতিবিদ সামান্য সময়ের জন্য আশাবাদী ছিলেন। জন ডি রকফেলার ছিলেন তাদেরই একজন।
তিনি বলেছিলেন, ‘এ সময়ে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছে। আমার জীবনে ৯৩ বছরে অনেক মন্দা এসেছে
আবার চলেও গেছে। উন্নতি সবসময় ফিরে এসেছে এবং আবার আসবে।’
চার কার্যদিবসে মহাধস
১৯২৯ সালের অক্টোবরে মার্কিন
পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধস নামে। সে সময় ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ
পয়েন্ট হারায় ২৫ শতাংশ। বাজার মূলধন কমে যায় ৩ হাজার কোটি ডলার, আজকের
দিনে যা ৩৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সমান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত টাকার ক্ষয়ক্ষতি
হয়েছিল, সেই ধসে মার্কিন শেয়ারবাজার হারিয়েছিল তার চেয়েও বেশি। আর্থিক ক্ষতি তো
তাও অংকে পরিমাপ করা যায়। কিন্তু যে বিষয়টি কেবল সংখ্যার বিচারে পরিমাপ করা যায় না, তা
হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা। ওই ধসের পর ওয়াল স্ট্রিটে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ভয়াবহ
সংকট দেখা দেয়।
অনেকেই মনে করেন, সেই ভয়াবহ ধসের শুরু ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর, যা ‘ব্ল্যাক থার্সডে’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলে সেই ধসের শুরু আরো কয়েক মাস আগে, যখন ওই বছরেরই মার্চে সূচক ১০ শতাংশ কমে যায়। বলা হচ্ছিল বাজার সংশোধনের অংশ হিসেবেই এ পতন। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল বাজারধসের সূচনামাত্র।
২৪ অক্টোবর ডাও জোনসে লেনদেন শুরু হয়
৩০৫ দশমিক ৮৫ পয়েন্ট নিয়ে। দ্রুতই তা ১১ শতাংশ কমে যায়, যাকে
বাজার সংশোধনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছিল। বাজার পুনরায় চাঙ্গা করতে ওয়াল স্ট্রিটের
ব্যাংকাররা তখন মরিয়া হয়ে শেয়ার কেনা শুরু করেন। এ কৌশলের ফলও মিলল হাতেনাতে। দিন
শেষে দেখা গেল ডাও জোনস কমেছে মাত্র ২ শতাংশ। ২৫ অক্টোবর শুক্রবার বাজার
ঊর্ধ্বগামী ছিল। ওইদিন ডাও জোনস ১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০১ দশমিক ২২ পয়েন্টে। পরের
দিন শনিবার ‘শর্ট ট্রেডিং ডে’তে এ ঊর্ধ্বগামিতা উধাও। ডাও জোনস কমে দাঁড়ায় ২৯৮ দশমিক ৯৭ পয়েন্টে। বড়
ধাক্কাটা আসে এর পরের দুই কার্যদিবসে। ২৮ অক্টোবর ‘ব্ল্যাক মানডে’তে সূচক কমে
গেল ১৩ শতাংশ। দিন শেষে ডাও জোনস দাঁড়ায় ২৬০ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে। ২৯ অক্টোবর ‘ব্ল্যাক
টুয়েসডে’তে এ শেয়ার আরো ১২ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ২৩০ দশমিক শূন্য ৭ পয়েন্টে। অর্থাৎ
চার পূর্ণাঙ্গ কার্যদিবসে ডাও জোনস পয়েন্ট হারায় ৭৫ দশমিক ৭৮ বা ২৫ শতাংশ। সূচকের
এমন নিম্নগামিতায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। আতঙ্কিত হয়ে ১ কোটি ৬৪
লাখ ১০ হাজার ৩১০টি শেয়ার বেচে দেন তারা। নয় দশক আগের সময়ের বিচারে সংখ্যাটি
একেবারে কম নয়।
ধসের কারণ
ইয়াহু ফিন্যান্স ডাও জোনস
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ হিস্টোরিক্যাল প্রাইসেসের তথ্য অনুসারে, ২৪
অক্টোবর ধস শুরুর সেই সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ডাও জোনস অবস্থান করছিল
সেপ্টেম্বরের সূচকের চেয়ে ২০ শতাংশ কমে। অর্থাৎ ২৪ অক্টোবরের আগে থেকেই বাজার
পতনমুখী ছিল। মূলত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ব্রিটিশ স্টক মার্কেটে বড় ধরনের পতন
মার্কিন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা অক্টোবরের সেই মহাধসের
পেছনে কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে এনেছেন। এর মধ্যে প্রথমেই আসে ‘ক্রেডিট
বুম’
বা ঋণ প্রবৃদ্ধি। ১৯২০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের হার অনেক
বেড়ে যায়। কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছিল।
শেয়ার বিনিয়োগকারীরাও বসে থাকেননি। তারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেদার শেয়ার কেনা
শুরু করেন। আর ঋণ গ্রহণ মানেই ঝুঁকি। এ কারণে ১৯২৯ সালের অক্টোবরে যখন
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়,
তখন তারা ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানোর জন্য
হন্যে হয়ে শেয়ার বিক্রি শুরু করেন। বাজারধসের পেছনে বিষয়টি বড় ভূমিকা রেখেছে।
আরেকটি বড় কারণ ছিল মার্জিনে শেয়ার কেনা। সে সময় ব্যাংকঋণের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা মার্জিনেও প্রচুর পরিমাণে শেয়ার কিনছিলেন। অর্থাৎ কোনো শেয়ারের মূল্যের ১০ থেকে ২০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করেই তারা শেয়ার কিনতে পারছিলেন। বাকি ৮০-৯০ শতাংশ মূল্য ধার হিসেবে থেকে যাচ্ছিল। পদ্ধতিটি ওই সময় নতুন চালু হওয়ায় এর ব্যবহার অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। ফলে মার্জিনে শেয়ার কেনা হচ্ছিল অনেক বেশি, যা বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। ধস নামার পর সে সময়ের অনেক ‘মার্জিন মিলিয়নেয়ার’ ফকির বনে গিয়েছিলেন। আর যারা মার্জিনে শেয়ার কেনার জন্য ধার দিয়েছিল, অর্থ ফেরত না পাওয়ায় তাদেরও পথে বসতে হয়েছিল।
১৯২০-এর দশকে নতুন নতুন উৎপাদন কৌশলের
আবির্ভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অটোমোবাইলের মতো শিল্প খাতগুলোয় উৎপাদন অনেক বেড়ে
গিয়েছিল। কিন্তু চাহিদা সে অনুপাতে না বাড়ায় কোম্পানিগুলোর বিক্রি সেভাবে হচ্ছিল
না, যার
প্রভাব পড়ে মুনাফায়। কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্স আশানুরূপ না হওয়ায় শেয়ারদরে এর
প্রভাব পড়তে শুরু করে। এমনকি ১৯২৯ সালে কার বিক্রিতে পতন, ইস্পাত
উৎপাদন সংকোচন ও আবাসন খাতে মন্দার লক্ষণ থাকলেও বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা কিন্তু
থামেনি। চাহিদা ও উৎপাদনে সামঞ্জস্য না থাকা এবং শিল্প খাতের মন্দা ভাব উপেক্ষা
করে ক্রমাগত শেয়ার কেনা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯২৮
সাল থেকে সুদহার বাড়াতে থাকে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ। ১৯২৯ সালের আগস্টে সুদের
হার ৬ শতাংশ উন্নীত করায় তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শেয়ারের চাহিদা কমে
যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া অক্টোবরের সেই মহাধসের
কারণ হিসেবে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি খাতে মন্দা, ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ইত্যাদির
কথাও উল্লেখ করেন অনেকে।
ফিরে আসা
১৯২৯ সালে মার্কিন শেয়ারবাজারের সেই
ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগেছিল। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ডাও জোনস আগের
বছরের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেড়ে সর্বোচ্চ ৩৮১ দশমিক ১৭ পয়েন্টে উঠে যায়। এ অবস্থায় ফিরে
আসতে ওয়াল স্ট্রিটকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। সে বছরের ২৩ নভেম্বর
ডাও জোনসের অবস্থান ছিল ৩৮৩ দশমিক ৮ পয়েন্ট।
দ্য ব্যালান্স, ইকোনমিকস
হেল্প ও উইকিপিডিয়া অবলম্বনে
শরিফুল আলম শিমুল