সিল্করুট

ব্যঙ্গচিত্রে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড

মুহম্মদ আল মুখতাফি

‌দি ওল্ড লেডি অব থ্রেডনিডল স্ট্রিট ইন ডেঞ্জার

১৭৮০ সালের জুন মাস। লন্ডনের ক্যাথলিকবিরোধী মনোভাব রূপ নেয় দাঙ্গায়। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা লর্ড জর্জ গর্ডনের নামানুসারে দাঙ্গাটি ইতিহাসে গর্ডন রায়ট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এ সময় আন্দোলনকারীরা নিউগেট ও অন্যান্য কারাগার পুড়িয়ে ফেলার পর নজর দেয় ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের দিকে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সরকার বিশেষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে। ব্যাংকের গভর্নর ডেনিয়েল বুথ স্বয়ং ৩০ জন প্রহরীর দাবি জানান। তখন থেকেই রাত্রিকালীন নিরাপত্তার জন্য প্রহরী নিয়োগ দেয়া হয়। ব্রিটিশ সরকারের এ সিদ্ধান্ত জারি ছিল পরবর্তী ১৯৩ বছর। ব্যাংকের নিরাপত্তার জন্য প্রতি রাতে তারা সেখানে অবস্থান করত। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বিষয়টি স্থানীয় মানুষ ও সিটি করপোরেশনের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রহরীরা যখন ওয়েস্টমিনস্টার থেকে জনতার ভিড়ের মধ্য দিয়ে মার্চ করত, তাতে দীর্ঘ রাস্তায় সাধারণ জনতা, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী মানুষের ভোগান্তি হতো। ১৭৮৭ সালে নিজের ব্যঙ্গচিত্রে সেটাই তুলে ধরেন জেমস গিলরে। চিত্রকর্মের নাম ‘‌আ মার্চ টু দ্য ব্যাংক’।

চিত্রকর্মে দেখা যায়, গার্ডরা মার্চ করে যাওয়ার সময় সামনের সব মানুষকে পদদলিত করে যাচ্ছে। রাস্তায় পড়ে আছে পুরুষ, নারী ও শিশু। যেন সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হওয়া এক নতুন অত্যাচার। চিত্রকর্মটির বাস্তবিক রূপ যে ছিল না, তা কিন্তু না। ঠিক পরের বছরই দেখা যায় তার প্রমাণ। সে বছর জোসেফ মিটন নামক জনৈক গার্ড রাস্তা থেকে সরতে দেরি হওয়ার অপরাধে একজন সাধারণ মানুষকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। যদিও মিটনকে পরে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু তাকে সেভাবে ভারি দণ্ডের আওতায় আনা হয়নি। ব্যক্তিগত ক্রোধ থেকে হত্যা করেনি বলে বিচারক তাকে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন। তিক্ত হয়ে ওঠা লন্ডন করপোরেশনও ব্যাংকে আলাদা করে গার্ড রাখার ব্যাপারটিকে অসাংবিধানিক ও শহরের জন্য অবমাননাকর হিসেবে গণ্য করত। পরে ব্যাংকের চারপাশে টহল দেয়ার পরিবর্তে সেখানে নির্মিত ব্যারাকে অবস্থানের নির্দেশনা দেয়া হয় গার্ডদের। অবশ্য আরো নানা অভিযোগ এসেছে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষকে অপমান করা এবং তাদের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত করার মতো ঘটনা।

তবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে ঘিরে সবচেয়ে বিখ্যাত কার্টুন আঁকা হয়েছে আরো পরে। ১৭৯৭ সালের দিকে। এটাও এঁকেছেন জেমস গিলরে। চিত্রকর্মের নাম ‘‌দ্য ওল্ড লেডি অব থ্রেডনিডল স্ট্রিট ইন ডেঞ্জার।’ দেখা যায় ব্যাংক নোট দিয়ে তৈরি জর্জিয়ান পোশাক পরিহিত জনৈক বৃদ্ধা। বসে আছেন পকেট ভরা স্বর্ণ নিয়ে। তার সামনে লোভাতুর এক তরুণ দাঁড়িয়ে। পোশাক দেখেই অনুমান করা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট দ্য ইয়ংগার। ব্যঙ্গচিত্রে পিটকে বৃদ্ধার পকেটে হাত দেয়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। মুঠো দিয়ে বের করে আনছে স্বর্ণমুদ্রা। পাশে লেখার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বৃদ্ধার চিৎকার। তিনি বলছেন, ‘মানে কী! নিজেকে নিষ্কলুষ রেখেছিলাম কি তোর কাছে অসম্মানিত হওয়ার জন্য? হায় খুন! ধর্ষণ! লাঞ্ছনা! ধ্বংস, ধ্বংস, ধ্বংস!!!’

ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে পিট সরকার বারবার ব্যাংকের কাছে স্বর্ণ দাবি করতে থাকে। এভাবে রিজার্ভ শুষে নেয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত ১৭৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক স্বর্ণে লেনদেন স্থগিত করে দেয়। পিট দেশে চলমান ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার জন্যই ব্যাংককে কাগজের নোট ইস্যু করার নির্দেশ দেন। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারের আচরণকে তুলির আঁচড়ে তুলে ধরেন জেমস গিলরে। গিলরেকে মনে করা হয় ব্রিটিশ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কার্টুনিস্টদের একজন হিসেবে। ১৭৫৬ সালে জন্ম নেয়া এ শিল্পী সাধারণত রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্যারিকেচার আঁকতেন। হাস্যরস, গভীর জীবনবোধ, আঁকায় অকপটতা এবং নিখুঁত প্রয়োগের কারণে তিনি সুপরিচিত।

মুহম্মদ আল মুখতাফি: লেখক