সিল্করুট

ব্যাংকের নিরাপত্তায় ছিলেন ৫৩৪ প্রহরী

নিজাম আশ শামস

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, ১৮১৬। শিল্পী: থমাস হসমার শেফার্ড

আঠারো শতকের শেষ ভাগ। লন্ডন শহরে চলে গর্ডন দাঙ্গা। ক্যাথলিক বিদ্বেষীরা এ দাঙ্গা পরিচালনা করে। দাঙ্গার ফল ভয়াবহ। আনুমানিক ৭০০ মানুষ নিহত। মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। ব্যাংক তো কোন ছাড়! দাঙ্গাকারীদের কাছে ব্যাংক হলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক। তাই স্বাভাবিকভাবেই গর্ডন দাঙ্গার উত্তাপ ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গায়েও এসে লাগে। ১৭৮০ সালের ৭ জুন রাতে দাঙ্গাকারীরা ব্যাংকে হামলা করার চেষ্টা করে। এক নয়, একাধিকবার। প্রথমে তারা রাত ৮ টার কিছু পরে আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয় আঘাত হানে রাত ১০টায়। সর্বশেষ তারা খুব ভোরে হামলা করে। লন্ডনের চিপসাইড সড়ক থেকে এগিয়ে এসে দাঙ্গাকারীরা থ্রেডনিডল সড়কে অবস্থিত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আক্রমণ করে। তাদের কয়েকজনের হাতে ছিল মাস্কেট বন্দুক। তারা সংখ্যায় অনেক ছিল। ব্যাংকের অশ্বারোহী প্রহরীদের পরাহত করে তারা। কিন্তু পদাতিক প্রহরীদের সঙ্গে আর পেরে উঠল না। পদাতিকরা অনবরত আগুন জ্বালিয়ে দাঙ্গাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সে রাতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের অশ্বারোহী ও পদাতিক প্রহরীদের সঙ্গে ছিলেন ব্যাংকের কর্মীরাও। তাদের হাতে ছিল লোডেড বন্দুক। সে রাতে লন্ডনের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত দাঙ্গাকারী নিহত হয়েছিল। অনেক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বিপর্যয় এড়াতে পেরেছিল। পরের দিন যথারীতি ব্যাংকের কার্যক্রম সচল ছিল।

সে রাতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের ঝুঁকি বুঝতে পেরেছিলেন। দাঙ্গা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে ব্যাংক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। অসতর্কতার কারণেও ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন মোমবাতি না নেভানো কিংবা চাবি হারিয়ে যাওয়া। এগুলো ব্যাংকের সাধারণ সমস্যা ছিল। তাই কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের নিরাপত্তা বিধানে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। সন্ধ্যায় ব্যাংক বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী ভোর পর্যন্ত নিরাপত্তার নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলা হতো।

গর্ডন দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রহরা আরো মজবুত করা হয়েছিল। ব্যাংকের সুরক্ষার জন্য ৫৩৪ জন পদাতিকের একটি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এটিই ছিল সে সময় লন্ডনের সবচেয়ে বড় সশস্ত্র বাহিনী। ১৭৮২ সালে তাদের জন্য ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল। কোনো প্রহরী ব্যারাকে অনুপস্থিত কিনা কিংবা অননুমোদিত কেউ ব্যারাকে প্রবেশ করছে কিনা তা কড়া নজরে রাখা হতো। দাঙ্গার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কর্নেল হফ ডেভিগ নামে একজন সামরিক প্রকৌশলীর সঙ্গে আলোচনা করে। ব্যাংকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার উপায় ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। তিনি বেশকিছু পরিবর্তনের উপদেশ দিলেন। ব্যাংকের চারপাশে শক্ত ও উঁচু সুরক্ষাপ্রাচীর তৈরি করতে বললেন। ব্যাংকসংলগ্ন ভবনগুলো কিনে নিতে বললেন। হফ ডেভিগের উপদেশ অনুসারে কাজ করার আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার পাউন্ড। ব্যাংকের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার জন্য সামরিক কর্মকর্তার কাছে ধরনা দেয়া কর্তৃপক্ষের সতর্কতা ও উদ্বেগ প্রমাণ করে। তবে তারা সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ব্যাংক ঘেরাও করার উপদেশটি গ্রহণ করেননি। তাদের মতে, ব্যাংক একটি পাবলিক ইনস্টিটিউশন। তাই এটিকে ঘেরাও করা উচিত হবে না। কিন্তু ব্যাংকসংলগ্ন ভবনগুলো কিনে নেয়ার প্রস্তাব তাদের মনঃপূত হয়েছিল।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সঙ্গে লাগানো ছিল একটি চার্চ। সেন্ট ক্রিস্টোফারস। এ চার্চ থেকে খুব সহজেই ব্যাংকে অনুপ্রবেশ করা সম্ভব ছিল। তাই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের লাগোয়া চার্চের অংশটি কিনে সেসব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এ নিয়ে পার্লামেন্টে তারা পিটিশন করেছিল। যাজকপল্লীর অধিবাসীরা এর প্রতিবাদ করে। কিন্তু ততদিনে সুপরিকল্পিতভাবে আশপাশের বাড়িগুলো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিনে নিয়েছিল। আর সেন্ট ক্রিস্টোফারসের তৎকালীন বিশপ রবার্ট লোথও ব্যাংককে সমর্থন করেছিলেন। তাই ব্যাংক সেন্ট ক্রিস্টোফারস কিনে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বাহ্যিক প্রতিরক্ষা সুনিশ্চিত করা হয়েছিল।

কার্যক্রম চলাকালীন ব্যাংকের বিভিন্ন নথি, বই ও খাতা উন্মুক্ত স্থানে থাকত। গ্রাহকের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এগুলো কর্মীদের হাতের নাগালে প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর সেগুলোর নিরাপত্তা বিধানে ব্যবস্থা নিয়েছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তাই বিকাল ৫টায় গ্রাহকের জন্য ব্যাংক বন্ধ হলেও ক্লার্কদের কাজ শেষ হতো আরো দেরিতে। তারা পরবর্তী কার্যদিবসের জন্য রেকর্ড হালনাগাদ করত। ব্যাংকের রেকর্ড, নথিপত্র, ক্যাশ ইত্যাদি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল ক্লার্কদের ওপর। একজন ক্যাশিয়ার তাদের কাজ তত্ত্বাবধান করতেন। ব্যাংক নোটগুলো সব গুনে হিসাব মিলিয়ে ওয়্যারহাউজে তালা দিয়ে রাখা হতো। ড্রয়িং লেজার, জেনারেল ও ডিভিডেন্ড লেজার, জার্নাল ও টিন বক্স (সম্ভবত এ বক্সে নথিপত্র ও ব্যাংক নোট ভরে রাজস্ব বিভাগে নিয়ে যাওয়া হতো) একটি সুরক্ষিত কক্ষে তালাবন্দি করা হতো। চাবিটি প্রধান হিসাবরক্ষকের বাসভবনে পৌঁছে দেয়া হতো। এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পর সংশ্লিষ্ট ক্লার্ক একটি খাতায় স্বাক্ষর করতেন।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ডিসকাউন্ট শাখায় ঝুঁকি আরো বেশি ছিল। কারণ সে শাখার রেকর্ডগুলো অধিকতর জটিল ছিল। ডিসকাউন্ট শাখার ক্লার্কদের কাজ শেষ হতে প্রায়ই রাত ৭-৮টা বেজে যেত। এমনকি আরো বেশি সময় লাগত। বিলগুলো একটি লোহার সিন্দুকে রাখা হতো। সিন্দুকের চাবি প্রধান হিসাবরক্ষক বা তার ডেপুটির কাছে সংরক্ষিত থাকত। কখনো কাজ শেষ হতে অনেক রাত হতো। তখন চাবি কার কাছে দেয়া হবে সেটি নির্ধারিত থাকত না। তখন লোহার সিন্দুকে দুটি তালা লাগানো হতো। দুজন ক্লার্ক এ কাজের দায়িত্বে থাকত। তারা দুটি চাবি বুঝে নিয়ে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রেখে দিত। ডিসকাউন্ট শাখার লোহার সিন্দুকটি আবার একটি ক্লোজেটে সংরক্ষণ করা হতো। সব নথিপত্র, ক্যাশ, বুলিয়ন ইত্যাদি যথাযথ স্থানে সংরক্ষণ করে ক্লার্করা ব্যাংক থেকে বের হতেন। তারপর সারা রাত ওয়াচম্যানদের সতর্ক প্রহরায় থাকত ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। আঠারো শতকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ওয়াচম্যানদের বার্ষিক ৩ পাউন্ড ৩ শিলিং বেতন দিত। আর সংখ্যাতিরিক্ত ওয়াচম্যানদের বেতন ধার্য ছিল ২ পাউন্ড ২ শিলিং। তারা কর্মীদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ক্রিস্টমাস বক্স ও টিপস পেত। প্রতি বছর ক্রিস্টমাসে তাদের একটি করে গ্রেট কোট ও এক জোড়া করে পাতলুন দেয়া হতো। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল পর্যন্ত ওয়াচম্যানরা পালাক্রমে ব্যাংক পাহারা দিত।

অনুপ্রবেশকারী, দাঙ্গাকারী ও অন্যান্য অনাহুত সমস্যার সমাধান ওপরে বর্ণিত উপায়ে করেছিল ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। অগ্নি প্রতিরোধের জন্যও তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছিল। এটি একটি বড় সমস্যা ছিল। যেকোনো মুহূর্তে আগুন লাগার ঝুঁকি ছিল। বিশেষ করে সন্ধ্যা ও রাতে এ ঝুঁকি বেড়ে যেত। কারণ তখন মানুষ কম থাকত। মোমবাতি বা চুল্লি থেকে কোনো কিছুতে আগুন লাগলে তা খেয়াল করার আগেই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। চেক শাখায় আগুন লাগার ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ এটি ছিল প্রধান পোর্টারের ঘরের ঠিক পাশে। আর সে ঘরে বছরের অধিকাংশ সময় চুল্লিতে আগুন প্রজ্বলিত থাকত। আগুন প্রতিরোধে ব্যাংক এলাকায় প্রচুর খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল। যেন আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে। ১৭৭০-এর দশকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি চারতলা ফায়ার-প্রুফ লাইব্রেরি তৈরি করে। সেখানে ব্যাংকের যাবতীয় রেকর্ড সংরক্ষণ করা হতো। কিছু রেকর্ড চাকাযুক্ত বাহনে রাখা হতো। আগুন লাগলেই যেন তৎক্ষণাৎ অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যায়। সর্বোপরি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নিজস্ব ফায়ার ব্রিগেড ছিল। ১৭৮৩ সালে ব্যাংকের মালিকানায় চারটি ফায়ার ইঞ্জিন ছিল। এসব ইঞ্জিন দিয়ে অনেক উঁচুতে পানি ছিটানো যেত। ইঞ্জিনগুলো মিনিটে ৭৭০ লিটার পানি পাম্প করতে সক্ষম ছিল এবং প্রায় ৩৫ মিটার দূরত্বে পানি ছিটাতে পারত। প্রতি মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার ইঞ্জিনগুলো পরীক্ষা করা হতো। ত্রুটি থাকলে সারানো হতো। ইঞ্জিনগুলোকে সবসময় কার্যোপযোগী রাখা হতো।

আঠারো শতকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান সময়ের মতো এতটা আধুনিক ছিল না। তা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নাগালে থাকা সব ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বড় ধরনের আক্রমণ কিংবা বিপর্যয় থেকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন ব্যাংকের পরিচালকরা। নিঃসন্দেহে এটি তাদের বড় সাফল্য।

নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক