শহরটিকে ধ্বংস করেছিলেন চেঙ্গিস খান। তার পুনরুজ্জীবন প্রাপ্তিও হয় আরেক খানের হাতে। তবে ইতিহাসে তিনি খান নয়, পরিচিতি পেয়েছিলেন খোঁড়া হিসেবে। হিতোপদেশ অনুসারে, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই। কিন্তু তার নামের সঙ্গে খোঁড়ার একটি প্রতিশব্দ পদবির মতোই জুড়ে গিয়েছিল। এতে তার কোনো মানহানি হয়নি। বরং খ্যাতি বেড়েছে। ইতিহাসখ্যাত সে যোদ্ধা, বিজেতা ও শাসককে দুনিয়া তৈমুর লং নামে চেনে। ফার্সি ‘লং’ শব্দটির অর্থ খোঁড়া। তৈমুর লংয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তার বিজয় অভিযানের অন্তরায় হতে পারেনি। সে অভিযাত্রার এক পর্যায়ে তিনি শহরটি জয় করেছিলেন। শহরটিকে নবসাজে সজ্জিত করে পূর্বসূরি খানের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন। যে শহরটিকে তিনি মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করলেন এবং নিজের রাজধানীর মর্যাদা দিলেন, তাকেই কিনা প্রেমিকার তিলের সঙ্গে বিনিময় করতে চান কপর্দকহীন এক কবি! আঁতে ঘা লাগে তৈমুর লংয়ের। কবিকে দরবারে হাজির করার সমন জারি করলেন। জীর্ণ পোশাকে মাথা উঁচু করে দরবারে গেলেন কবি। তার দৈন্যদশার দিকে ইঙ্গিত করে তৈমুর জানতে চান, ফকিরের কী সাধ্য যে সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চান! সম্রাটের প্রশ্নে অবিচল কবি। মুচকি হেসে জবাব দিলেন, এভাবে সব বিলিয়ে দিতে দিতেই তিনি ফকির হয়েছেন! কবির উত্তরে প্রীত সম্রাট। তিনি কবিকে খেলাত দিয়ে সসম্মানে বিদায় জানালেন। জগজ্জুড়ে খ্যাতি অর্জন করা সেই কবির নাম হাফিজ। আর শহরটির নাম সমরখন্দ। মধ্য এশিয়ায় তখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে খোরেজম সাম্রাজ্য। বর্তমান উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান সম্পূর্ণ এবং ইরান ও আফগানিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত সে সাম্রাজ্য। বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ শহর সমরখন্দ, বুখারা, উরজেঞ্চ, খোজেন্দ, মার্ভ ও নিশাপুর এ সাম্রাজ্যের অধীন। মোঙ্গল সর্দার চেঙ্গিস খান তখন দিকে দিকে অভিযান পরিচালনা করছেন এবং তার সাম্রাজ্যের পরিধি বাড়াচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১২১৮ সালের দিকে খোরেজম সাম্রাজ্যের সঙ্গে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সরাসরি সীমানা তৈরি হলো। খোরেজমের মসনদে তখন আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। তার রাজধানী সমরখন্দ। খোরেজম সাম্রাজ্যে তখন নানাবিধ অভ্যন্তরীণ গোলযোগ চলছে। সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন গোত্র ও নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে। খোরেজমের শাহর কপালে জুটেছে স্বেচ্ছাচারীর তকমা। তার চরিত্রের ব্যাপারে নানা বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে। শাসক হিসেবে তার অযোগ্যতা, ঔদ্ধত্য ও নিষ্ঠুরতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এক কথায় খোরেজম সাম্রাজ্যে তখন অরাজক পরিস্থিতি। তখনকার মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে চেঙ্গিস খানের বিশ্বস্ত কিছু লোক ছিলেন। তাদের মাধ্যমে তিনি ততদিনে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী তৈরি করে ফেলেছিলেন। তারা চেঙ্গিস খানকে প্রতিনিয়ত খোরেজমের রাজনৈতিক পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ করতেন। খোরেজমের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নিতে চাইলেন চেঙ্গিস। তবে খোরেজম সাম্রাজ্য জয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও শুরুতেই তিনি তা প্রকাশ করেননি। বরং তিনি খোরেজমের শাহকে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিলেন। নাগরিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন মোঙ্গল যাযাবরদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের পোশাক ও শস্যের একটি বড় অংশ খোরেজম সাম্রাজ্য থেকে আমদানি করার সুযোগ ছিল। চেঙ্গিস খানের প্রস্তাব নিয়ে দূত গেল খোরেজমের শাহর দরবারে। মোঙ্গল বাহিনীর দুর্ধর্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন খোরেজমের শাহ। তাই তিনি মোঙ্গল সর্দারের প্রস্তাবকে দুরভিসন্ধিমূলক মনে করে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। দমে গেলেন না চেঙ্গিস খান। তিনি আবার দূত পাঠালেন। এবারো দূত বিরস বদনে ফিরে এলেন। চূড়ান্ত আক্রমণের আগে শেষ চেষ্টা করতে চাইলেন চেঙ্গিস খান। শান্তিপূর্ণ ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে তিনি খোরেজমের শাহর দরবারে তৃতীয়বারের মতো প্রতিনিধি দল পাঠালেন। সেই দলে দুজন মোঙ্গল ও একজন মুসলিম দূত ছিলেন। খোরেজমের শাহ এবার নির্বুদ্ধিতার চূড়ান্ত করে ফেললেন। তার আদেশে মোঙ্গল দূতদ্বয়ের দাড়ি কামিয়ে দেয়া হলো এবং মুসলিম দূতকে হত্যা করা হলো। দূতকে হত্যা করা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিরোধী, খোরেজমের শাহ হয়তো তা জানতেন; কিন্তু তিনি জানতেন না যে চেঙ্গিস খানের দূতকে হত্যা করা মূলত আত্মহত্যার শামিল! খোরেজমের শাহ তাই করেছিলেন। দূত হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নিলেন চেঙ্গিস খান। বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী খোরেজম সাম্রাজ্য আক্রমণ করল। খোরেজমের শাহও প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু প্রবল পরাক্রম মোঙ্গল বাহিনীর সামনে টিকতে পারেনি শাহের বাহিনী। চেঙ্গিস খান খোরেজম সাম্রাজ্য দখল করে শহরগুলোয় তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিলেন। অগুনতি মানুষ হত্যা করেছিলেন। ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলেন চমৎকার সব স্থাপনা। তার সেই পাশবিক ক্রোধে সমরখন্দও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ১২২০ সালের মার্চ মাস। খোরেজম সাম্রাজ্যের রাজধানী সমরখন্দের দিকে এগিয়ে গেলেন মোঙ্গল সর্দার চেঙ্গিস খান। শহরটি ‘দুনিয়ার সবচেয়ে মনোরম স্বর্গ’ নামে পরিচিত ছিল। সুরক্ষা প্রাচীরে ঘেরা সে শহর। মোঙ্গল আক্রমণ ঠেকাতে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়েছিল। এর সেনাবাহিনীও খোরেজম সাম্রাজ্যের অন্য শহরগুলোর তুলনায় অনেক বড় ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় এক লাখ সৈন্যের একটি বাহিনী সমরখন্দ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। তাই তখনো কেউ ভাবতে পারেনি যে চেঙ্গিসের বাহিনীর সামনে সমরখন্দের এ প্রতিরক্ষা ব্যূহ কোনো কার্যকর প্রতিরোধ তৈরি করতে পারবে না। সমরখন্দ দখলের আগে চেঙ্গিস খান সংলগ্ন শহর বুখারা জয় করেছিলেন। তাই সেখান থেকে সমরখন্দের কোনো সাহায্য পাওয়া সম্ভব ছিল না। আর বুখারার পরাজিত হওয়া এবং সেখানে মোঙ্গল বাহিনীর তাণ্ডবলীলার সংবাদে সমরখন্দের সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। ততদিনে চেঙ্গিস খানের দুই পুত্র ওগোদেই ও চাঘাতাইও নিজেদের বাহিনী নিয়ে পিতার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। সমরখন্দ আক্রমণের সময় চেঙ্গিস খান এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বুখারার বন্দিদের সমরখন্দের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সামনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। আক্রমণের তৃতীয় দিনেই প্রায় ৫০ হাজার খোরেজমি সৈন্য মারা যায়। আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ তখন অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সমরখন্দকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু মোঙ্গল বাহিনীর সামনে জাগতিক কোনো শক্তিই যেন দাঁড়াতে পারছিল না। যুদ্ধের পঞ্চম দিন চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলো শাহের বাহিনী। মোঙ্গল বাহিনী প্রবল প্রতাপে সমরখন্দে প্রবেশ করল। মোঙ্গল বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণকারী সব সৈনিককে কচুকাটা করা হলো। অধিবাসীদের শহরের বাইরে সমবেত করে অধিকাংশকে হত্যা করা হলো। বিশ্বস্ত কয়েকজন সৈনিক ও পুত্র জালালউদ্দিনকে নিয়ে আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ পালিয়ে গেলেন। কাস্পিয়ান সাগরের ছোট একটি দ্বীপে তার শেষ দিনগুলো কেটেছিল। ১২২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অনেক গবেষক তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়াকে দায়ী করে থাকেন। তবে কারো কারে মতে, সাম্রাজ্য হারানোর আকস্মিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে তিনি মারা যান। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর হাতে সমরখন্দ পরাজিত হওয়ার পরবর্তী প্রায় এক শতক শহরটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। তারপর তৈমুর লংয়ের হাতে এর পুনরুজ্জীবন ঘটে। সমরখন্দের ইতিহাসে তা ‘তৈমুরী রেনেসাঁ’ নামে পরিচিত। ধূসর রঙের শক্তিশালী একটি ঘোড়া। তার পিঠে বসা মানুষটির গায়ে লম্বা জামা, বর্ণিল পাজামা, মাথায় লম্বা টুপি, কোমরে ঝুলছে তলোয়ার। তার চেহারা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে শক্তি ও ক্ষমতার আভাস। এ বিশেষ ব্যক্তিকে দেখতে ভিড় করেছে শহরের অধিবাসীরা। বিপুল বিস্ময়ে তারা সে মানুষটিকে দেখতে লাগল, যার হাতে তাদের এবং তাদের প্রিয় শহরের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তার পেছনে আরেকটি ঘোড়া। সেটি তুলনামূলক ছোট। তাতে আরোহী ভৃত্য মানুষটির মাথায় ছাতা ধরে আছে। ক্ষমতাধর মানুষটির নাম তৈমুর লং। বিজয়ীর বেশে তিনি সমরখন্দে প্রবেশ করছেন। ১৫ শতকে রচিত তৈমুরের আত্মজীবনী ‘জাফরনামা’য় তার সমরখন্দে প্রবেশের ঘটনাকে এভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ১৪ শতকের শেষ ভাগে তৈমুর লং মধ্য এশিয়ায় তার সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তিনি সমরখন্দকে রাজধানী বানিয়েছিলেন। তার সাম্রাজ্যের সমস্ত অঞ্চল থেকে তিনি বিদ্বান ব্যক্তি ও বিভিন্ন শিল্পের দক্ষ কারিগরদের সমরখন্দে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের অবদানে সমরখন্দ শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যভুক্ত প্রতিটি অঞ্চল থেকে সম্পদ এনে তিনি সমরখন্দের কোষাগারে জমা করেছিলেন। যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের যত বিস্তার ঘটছিল, সমরখন্দের ধনভাণ্ডার তত ফুলেফেঁপে উঠছিল। ইস্পাহান, দিল্লি, তাব্রিজ, দামেস্ক, আঙ্কারা, হেরাত প্রভৃতি শহর থেকে যাবতীয় ভালো সবকিছু নিয়ে তিনি সমরখন্দকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তৈমুরীয় শাসনামলে সমরখন্দ নীল গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও সমাধিসৌধের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এসব স্থাপনা টাইলস ও মোজাইকের চমৎকার কারুকাজের জন্যও অনন্যতা লাভ করেছে। সেসব স্থাপনার সৌন্দর্য দেখে আজও পর্যটকদের চোখ জুড়াচ্ছে। সে সময় শিরাজের কারিগররা মোজাইকের কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। তিনি সেখান থেকে তাদের সমরখন্দে নিয়ে এসেছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে সমরখন্দ সে সময়ের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৈমুরের রাজত্বকালে ইবনে আরাবশাহ নামে একজন আরব কাহিনীকার সমরখন্দে ছিলেন। তিনি সমরখন্দকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তৈমুর লংয়ের এসব কার্যক্রমের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তৈমুরীয় শাসনামলে সমরখন্দের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতেও ব্যাপক জোয়ার এসেছিল। বলা হয়, এশিয়ার মোট বাণিজ্যের অর্ধেক সমরখন্দের দখলেই ছিল। এর বাজারে চামড়া, লিনেন, মসলা, রেশমি কাপড়, মূল্যবান পাথর, তরমুজ, আঙুরসহ নানা ধরনের দ্রব্য পাওয়া যেত। তৈমুর কেবল বিজেতা ছিলেন না, তিনি একজন বড় নির্মাতাও ছিলেন। যুদ্ধবিরতির সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি স্থাপনা নির্মাণে ব্যস্ত থাকতেন। তার শাসনামলে নির্মিত স্থাপনাগুলো এখনো সে সাক্ষ্য বহন করছে। তেমনই একটি স্থাপনার গায়ে আরবি একটি প্রবাদ লেখা আছে: ‘যদি তুমি আমাদের সম্পর্কে জানতে চাও, তাহলে আমাদের স্থাপনাগুলো নিয়ে গবেষণা করো।’ তৈমুর সমরখন্দকে ইসলামী শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। তখন আনাতোলিয়া থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যকর্মের অনুপ্রেরণা ছিল সমরখন্দ। কেবল তৈমুর লংয়ের সময়েই নয়, তার বংশধরদের রাজত্বকালেও সমরখন্দের এ মর্যাদা অটুট ছিল। তৎকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল পারস্য। তৈমুরীয় শাসকরা পারস্য সংস্কৃতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তারা পারস্য থেকে শিল্পী, স্থপতি ও বিদ্বান ব্যক্তিদের নিজেদের সাম্রাজ্যে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের অনেকেই সমরখন্দে বসতি স্থাপন করেন। তৈমুর লংয়ের বংশধরদের অনেকেই বিখ্যাত নির্মাতা ছিলেন। তারা অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। অনিন্দ্যসুন্দর কারুকাজ ও সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনস্বরূপ তারা বিভিন্ন সুফির সমাধিসৌধ নির্মাণে প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তৈমুর লংয়ের উত্তরসূরি শাহরুখ তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী সমরখন্দ থেকে হেরাতে স্থানান্তর করেছিলেন। কিন্তু তাতে সমরখন্দের মর্যাদা ও গুরুত্ব কমেনি। তৈমুরীয় শাসনামলের পুরোটা জুড়ে নানাভাবে সমৃদ্ধ হয় সমরখন্দ। তৈমুর লংয়ের পর সমরখন্দের সমৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন তার নাতি মির্জা মুহাম্মদ তারাঘাই ইবনে শাহরুখ। ইতিহাসে তিনি উলুঘ বেগ নামেই বিখ্যাত। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে অবদানের জন্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ দুটি বিষয়ের চর্চার জন্য তিনি সমরখন্দে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি ‘উলুঘ বেগের মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র ও গণিতের বিদ্যার্থীদের তার মাদ্রাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি সমরখন্দে একটি মানমন্দিরও স্থাপন করেছিলেন। তৈমুর লংয়ের শাসনামলে সমরখন্দে নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে গোর-বিবি খানম মসজিদ ও শাহ-এ-জিন্দাহ কমপ্লেক্সের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে সৌন্দর্য ও নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ‘গোর-এ-আমির’ নামের একটি স্থাপনা। শব্দবন্ধের অর্থ আমিরের কবর। এটি মূলত তৈমুর লংয়ের প্রিয় নাতি মুহাম্মদ সুলতানের সমাধিসৌধ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সমেয় তৈমুর লংকেও এখানেই সমাহিত করা হয়। ‘গোর-এ-আমির’ কমপ্লেক্সে তৈমুর লংয়ের বংশধর উমর শেখ, মিরন শাহ, পীর মুহাম্মদ, শাহরুখ ও উলুঘ বেগও চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন নগরী সমরখন্দ। তার গায়ে চেঙ্গিস খানের আক্রমণের ক্ষত। তার চেয়েও বেশি উজ্জ্বল তৈমুর লংয়ের কীর্তি। নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক
খোরেজম ও মোঙ্গল বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ