উজবেকিস্তানের শহর সমরখন্দকে ঘিরে মানুষের আয়োজন খুব একটা কম সময়ের নয়। কল্পনার রঙে রঙিন এ শহর যতটা ব্যবসায়িক দিক দিয়ে মানুষকে টেনেছে, একই সঙ্গে টেনেছে এর সৌন্দর্যেও। তাজিকিস্তানের সীমানার কথাই ধরুন না! কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে পূর্বে চীন, ভিন্ন ভিন্ন এমন সংস্কৃতির মেলবন্ধন যেন হয়েছে সমরখন্দে এসেই। সঙ্গে তৈমুরের শাসনামল যোগ করেছে বৈচিত্র্য। চারপাশের সব অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের জন্য সমরখন্দ ছিল যেন এক তীর্থভূমি। তাই সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এখানে চলে এসেছে খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্যও। সমরখন্দে পদাঙ্ক পড়েছে যাদের শত শত যুগ ধরে সমরখন্দে একে একে রাশিয়ান, তুর্কি, ইহুদি, কোরিয়ান, ককেশিয়ান ও উজবেকদের পদধূলি পড়েছে। নিজেদের সঙ্গে রসনাকেও সঙ্গী করে এনেছেন এদের প্রত্যেকে। তাজিক রসনা সমরখন্দের খাদ্য ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় তাজিকরাই। এ তাজিক গোষ্ঠী অনেকটা সময় ধরে থেকেছে সমরখন্দ ও বুখারায়। তাদের খাবারে সীমানাগত কারণে এসেছে রাশিয়ান ও উজবেকিস্তানের মিশ্রণ। সঙ্গে নিজেদের পারসিয়ান ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে তাজিক রসনায় ঠাঁই পেয়েছে সুগন্ধি রকমারি ভাতও। রাশিয়ান রসনা সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে রাশিয়ান জাতির একটা বড় অংশ এসে বাস গড়ে এ এলাকায়। রাশিয়ানরা খাবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সাধারণত ধোঁয়া আর লবণ ব্যবহার করে বেশি। তাদের খাবারে আছে ব্রোশেট ও পিরোশকির মতো মাংস ও আলুর পুর দেয়া ভাজা রুটি। সেগুলো সমরখন্দের বাজার বা রেস্তোরাঁয়ও অহরহ খুঁজে পাবেন। তুর্কি রসনা ব্যবসায়িক কাজে এবং বসবাসের জন্যই অনেকটা সময় এ অঞ্চলে থাকেন তুর্কি জনগণ। এমনিতে মধ্য এশিয়ায় তুর্কি খাবারদাবারের প্রশংসা চলে বেশ। পাইডস নামের পিৎজার মতো একধরনের খাবার তো আছেই, সঙ্গে তুর্কিদের কাছ থেকে সমরখন্দের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে মাটন ক্যাসেরোল, কুচি করা ঝলসানো ভেড়ার মাংস আর ডজনখানেক কাবাব। ইহুদি রসনা এ গল্পটা একটু ভিন্ন। মনে করা হয়, বুখারা আর সমরখন্দে বছরের পর বছর ধরে বাস করে আসা ইহুদি গোষ্ঠী মূলত ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া ১০টি গোত্রের অন্তর্গত। তবে অনেক ঐতিহাসিক আবার মনে করেন, এ গোষ্ঠীগুলো তৈমুরের নেতৃত্বে সমরখন্দে এসেছিল। সমরখন্দের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইহুদি রঞ্জনকারক আর বুননশিল্পীদের এনেছিলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈমুরের শাসন ও সোভিয়েতের ভাঙন দেখা দেয়। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় সমরখন্দেই বাসা বাঁধে ইহুদি এ গোষ্ঠীগুলো। বর্তমানে উজবেকিস্তানে হাজারখানেক ইহুদি বাস করে। পারসিয়ান ও রাশিয়ান রসনার সঙ্গে খানিকটা মিশ্রিত হয়ে সবজি দেয়া পোলাও আর মাংস দিয়ে তৈরি ভারী খাবার হয়ে গেছে ইহুদি বাসিন্দাদের নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস। সেখানে একটু জিরা, ধনিয়া, হলুদ, গোলমরিচ আর মরিচ ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে স্বাদবর্ধক হিসেবে থাকে নানা রকম ভেষজ, পেঁয়াজ ও রসুন। কোরিয়ান রসনা মধ্য এশিয়াকে কখনই খুব বেশি ঝালযুক্ত খাবার টানেনি। তবে কোরিয়ান খাবারগুলো সেদিক দিয়ে একটু অন্য রকম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্তালিনের হাত ধরে এখানে বসতি গড়ে কোরিয়ানরা, সেখান থেকেই নিজেদের মসলা আর রন্ধনশৈলীকে পরিচিত করিয়ে দেয় তারা সমরখন্দের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে। কোরিয়ান শসার আচার, বিফ রিবন বা ক্যাবেজ ভরা কিমচি—প্রতিটি খাবার অসম্ভব জনপ্রিয় এশিয়ার রাজধানীগুলোয়। ককেশিয়ান রসনা বহু আগে থেকেই জর্জিয়ান, অ্যাজেরিস ও আর্মেনিয়ার বাসিন্দারা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পারসিয়ান রাজত্বকালীন ঘটনা। সে সময় ব্যবসায়িক সুবিধার্থে আর্মেনিয়ান যোদ্ধারা সিল্ক রোডে চলে আসে যুদ্ধ করার জন্য। একই কাজ করে ককেশাসরাও। ১৪ শতকে আর্মেনিয়ানরা চীন পর্যন্ত ভ্রমণ করে সেন্ট ম্যাথিউ মঠ বানানোর জন্য। সঙ্গে করে নিজেদের রসনাকেও নিয়ে যায় তারা সেখানে। কোথায় যাবেন খেতে? সমরখন্দে প্রথমবার গিয়ে ঠিক রেস্তোরাঁটা খুঁজে বের করা কঠিন হতে পারে আপনার জন্য। তাই এক্ষুনি জেনে নিন ঠিক কোথায় কোথায় গেলে সমরখন্দের স্বাদ পুরোটা নিতে পারবেন আপনি। সিয়াব বাজার রেজিস্তান থেকে কিছুটা দূরেই বিবি-খানুম মসজিদ অবস্থিত। সেটার ঠিক পাশেই সবচেয়ে বড় খাবারের বাজার খুঁজে পাবেন আপনি। নাম সিয়াব বাজার। এখানে তাজা সবজি, ফল আর রুটি পাবেন আপনি। তবে এগুলোই নয়, এ বাজারের মূল আকর্ষণ শুকনো ফল আর বাদাম অবশ্যই চাখতে ভুলবেন না। যদি খেয়ে ভালো লাগে তাহলে কিনেও ফেলতে পারেন। আর সময় থাকলে খাবার শেষে পাশের মসজিদটা থেকেও ঘুরে যেতে পারেন। সমরখন্দের অন্যতম এ মসজিদ গড়ে উঠেছিল ১৪০৪ অব্দে। মসজিদের গায়ে লেগে থাকা প্রাচীন কারুকার্য মুগ্ধ করবে আপনাকে অবশ্যই। পোলাওয়ের খোঁজ উজবেকিস্তানের প্রধান খাবারই হলো পোলাও। তবে শহর আর অঞ্চলভেদে সেটাতেও আছে ভিন্নতা। তাই অন্য কোথাও পোলাও খেলেও অবশ্যই সমরখন্দের পোলাও খেয়ে নিতে ভুলবেন না যেন। অন্যান্য রেস্তোরাঁয় যেতেই পারেন। তবে সমরখন্দ পোলাওয়ের জন্য বিখ্যাত অশ মারকাজি রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারবেন অবশ্যই। বিশাল হাঁড়িতে গরুর মাংস আর হলুদ গাজরের টুকরো দিয়ে সুগন্ধি চালে বানানো হয় এ পোলাও। প্লেটে খাবার পরিবেশনে গরুর মাংস, গাজর আর অন্যান্য জিনিসপাতি দিয়ে সাজানো হয় প্লেট। দারুণ তেলতেলে ভাব থাকে পোলাওয়ে, আর মিষ্টি গাজরের পাশে মাংসগুলোও হয়ে ওঠে নরম। এ পোলাও শেষ হয়ে যায় খুব দ্রুত। তাই যেতে হলে অবশ্যই দ্রুত চলে যেতে ভুলবেন না। আরেকটু অন্য রকম পোলাওয়ের স্বাদ নিতে চলে যেতে পারেন আলফাতলার অশে। কাবাব খেয়ে দেখুন সমরখন্দে নানা রকম কাবাবের স্বাদ যদি নিতে চান তাহলে অবশ্যই ইকরোম সাসলিকে ঘুরে আসুন। ২০ বছর ধরে ২৫ মিটার লম্বা গ্রিলে দারুণ সাসলিক বানিয়ে চলছে রেস্তোরাঁটি। শুধু পর্যটকই নয়, স্থানীয়দের জন্যও হাতের কাছের সেরা কাবাবের জায়গা এই রেস্তোরাঁ। তাই ভিড় একটু হবে, তবে ঘুরে আসতে ভুলবেন না! সমুচার জন্মভূমি মচমচে, পুরে ভরা, জিভে জল আনা সমুচা খুব পছন্দের? জেনে নিন, এ সমুচার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল বর্তমান উজবেকিস্তানের সমরখন্দ, বুখারা আর খিভায়। সিল্ক রোড দিয়ে যাতায়াত করা ব্যবসায়ীদের জন্য লম্বা ভ্রমণের সেরা খাবার ছিল এ মাংসের পুর দেওয়া সমুচা। তো সমুচার জন্মভূমিতে এলে সমুচা না খেলেই তো নয়! সমরখন্দে সমুচা খেতে চলে যান কোকান্দস্কায়া সোমসা, প্লাতান হটেল বা সামসোমিয়ান সোমসা রেস্তোরাঁয়। সোনালি, মুচমুচে আর গরমা গরম সমুচার খোঁজ পাবেন এখানেই। হালুয়া উজবেকিস্তানে মধু ও মধু দিয়ে তৈরি খাবারের চল বহুল। এমনই এক মধু দিয়ে তৈরি খাবারই হলো হালুয়া। সমরখন্দে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানীয় হালুয়াটি হলো তিলের হালুয়া। মধু আর তিলের সঙ্গে এখানে চিনির শিরা, ডিমের সাদা অংশ, বাদাম, মাখন ও আটা ব্যবহার করা হয়। টানা চিনি থেকে তিলের হালুয়া বানিয়ে সেটাকে বারবার টেনে নানা রঙের হালুয়া বানানো হয়। রুটি ব্রেড বা রুটি উজবেকিস্তানের অসম্ভব পছন্দের খাবার। রুটি শুধু এখানে খাবার না, ভালোবাসার নাম। তাই সমরখন্দে খাবারের একটা বড় অংশজুড়ে আছে এ রুটি। রুটি মূলত তাসখন্দ, বিখারা ও খিভা থেকে আসা রুটি হিসেবে আলাদা হয়। তবে সমরখন্দের রুটির ব্যাপারটাই আলাদা। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘উজবেক নান’ নামে। উজবেকিস্তানের রুটির তালিকায় আলাদা হয়ে থাকে এটি। এ সম্পর্কে আরো একটি গল্প প্রচলিত আছে। একবার বুখারার এক খানের খুব পছন্দ হয়ে গেল উজবেক নান। সে বলল, কেন আমরা সমরখন্দ থেকে রুটি আনি? এখানেই কেন বানাই না? খানের নির্দেশ অনুযায়ী সমরখন্দ আর বুখারা থেকে রুটির কারিগর আনা হলো এবং রুটি বানানো হলো। সেটার স্বাদ উজবেক নানের মতো হলো না। এবার সমরখন্দ থেকে রুটি বানানোর সব জিনিসপাতি এনে আবার চেষ্টা করলেন খান। তাতেও স্বাদ এল না রুটিতে। খানকে তখন বলা হলো, আমরা সব আনতে পারি সমরখন্দ থেকে। কিন্তু সমরখন্দের বাতাস আনতে পারি না। তাই অন্য স্থানে বানানো রুটির স্বাদও সমরখন্দের রুটির মতো হয় না! এ সমরখন্দ ব্রেড আপনি পাবেন সমরখন্দের সবখানেই। চেখে দেখবেন অবশ্যই! মানতি ডাম্পলিং অনেকটা সমুচার মতোই দেখতে খাবারটির ভেতরেও থাকে মাংস। তবে পার্থক্যটা হলো তেলে নয়, খাবারটি তৈরি হয় ভাপে। খাবারটি এ অঞ্চলে আসে চীন থেকে। সাধারণত দই আর মসলার একটা সসের মধ্যে ডুবিয়ে খাওয়া হয় এ গরু বা ভেড়ার মাংসের পুর দেয়া মানতি। সমরখন্দের যেকোনো ডাম্পলিংয়ের রেস্তোরাঁতেই এ মানতি খুঁজে পাবেন। খাবারে সমরখন্দের অনন্যতা প্রতিটি দেশ, প্রতিটি স্থান ও অঞ্চল খাবারের দিক দিয়ে নিজ নিজভাবে অনন্য। তবে সমরখন্দ এদিক দিয়ে যেন অনেকটা এগিয়ে। এর প্রধান কারণ শহরটির অবস্থান। একদিকে শহরটি যেমন তুরস্ক, ইরান বা মরক্কোর কাছ থেকে রোস্ট করা মাংস আর তন্দুরিতে বানানো রুটি টুকে নিয়েছে নিজেদের খাদ্যতালিকায়, তেমনি জায়গা করে দিয়েছে চীন, নেপাল ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা ভাপে বানানো নুডলস আর ডাম্পলিংও। অনেকের মতে, এ অঞ্চলের নিজস্ব এ খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছিল মাত্র ১২০-১৫০ বছর আগে। তবে চারপাশে মরুভূমি, ভূমধ্যসাগর আর পাহাড় থাকায় খাদ্যশস্য উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছে সমরখন্দ। এতে তাদের খাদ্যতালিকাও হয়ে উঠেছে আরো সমৃদ্ধ। বেশির ভাগ খাবারে মাংস আর চর্বির ব্যবহার থাকলেও তার সঙ্গে আটা, সবজি, চাল আর নানা রকম মসলার সংযুক্তি ঘটেছে। আপনি খাদ্যরসিক? সমরখন্দ তাহলে আপনার জন্য দারুণ একটা ঘুরে আসার মতো স্থান। সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি: লেখক
সিয়াব বাজারে শুকনা ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এক বিক্রেতা ছবি: ক্যানান ট্রাভেল