সিল্করুট

১৭৪০ সালে মদিনা মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন নবাব সিরাজউদদৌলা

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন


মসজিদের নাম মদিনা। নামটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বিশেষ করে বাংলায় কোনো ধর্মীয় স্থাপনার এমন নাম হজরত মুহাম্মদ (দ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত মদিনা শরিফের সঙ্গে এর সংযুক্তি প্রমাণ করে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে নবিজির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ এমন নামকরণ। এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপনের জন্য মাটি আনা হয়েছিল মদিনা শরিফ থেকে। এর পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল। যারা আর্থিক অসংগতি কিংবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে মদিনা শরিফে যেতে পারবেন না, তারা যেন এখানে এসে আত্মার প্রশান্তি লাভ করতে পারেন। আবার আরেকটি মত অনুসারে মাটি আনা হয়েছিল কারবালা থেকে। তবে মুর্শিদাবাদে অবস্থিত মদিনা মসজিদের তাৎপর্য আরো গভীর। স্থাপত্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মদিনা মসজিদ নামে পরিচিত হলেও এটি আসলে কোনো মসজিদ নয়। মদিনা মসজিদ মূলত কারবালায় সপরিবারে শহীদ হওয়া হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পবিত্র সমাধির একটি প্রতীকী উপস্থাপন। তিনি নবিজির প্রিয় দৌহিত্র। ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার বড় ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর মাধ্যমেই হজরত মুহাম্মদ (দ.)-এর বংশধারা দুনিয়ায় প্রবহমান। নবিজির পরিবার ‘আহলে বাইত’ নামে পরিচিত। সুতরাং, এ ধরনের স্থাপনা নির্মাতার আহলে বাইতের প্রতি প্রেমকে প্রমাণ করে। একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আহলে বাইতের অনুসারী এবং নবিজির পর তারাই খিলাফতের দাবিদার, এমন মতাদর্শে বিশ্বাসীরা সাধারণত শিয়া নামে পরিচিত। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে সুন্নি মুসলিমরাও আহলে বাইতকে অনুসরণ করেন এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করেন। তবে শিয়া ও সুন্নিদের আহলে বাইত অনুসরেণের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। সে অন্য আলাপ। তা এ লেখায় আলোচ্য নয়। মোদ্দা কথা হলো, নবিজির আহলে বাইত তথা হজরত আলী (রা.), হজরত ফাতেমা (রা.), ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতীকী সমাধি তৈরির মাধ্যমে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার নজির শিয়া ধারাতেই দেখা যায়। সুন্নিদের ক্ষেত্রে এমন কোনো নজির নেই। সুতরাং, এ দাবি করা যায় যে মদিনা মসজিদের নির্মাতা একজন শিয়া মতাবলম্বী মুসলিম ছিলেন। আরো বিষয় আছে। মদিনা মসজিদ একক কোনো স্থাপনা নয়। এটি বৃহত্তর একটি স্থাপনার কেন্দ্র। সেই বৃহত্তর স্থাপনা হলো মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ‘নিজামাত ইমামবাড়া’। এটি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া। শব্দটি আদিতে ছিল ‘ইমামবারগাহ’। সেখান থেকে উচ্চারণের সুবিধার্থে ‘ইমামবাড়া’র প্রচলন। অর্থ ইমামের আবাসস্থল। এতে আপত্তি তোলার কোনো সুযোগ নেই যে ইমামবাড়াগুলো বারো ইমামের অনুসারী শিয়াদের দ্বারা নির্মিত এবং তাদের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। সুন্নি সম্প্রদায়ের এ ধরনের বা কাছাকাছি কোনো স্থাপনা নির্মাণের নজির নেই। ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা এসব ইমামবাড়া এখানে বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রধান কেন্দ্র। এ ইমামবাড়াগুলো থেকে মহররমের তাজিয়া বের করা হয়। অতএব, এ কথা স্বীকার না করার কোনো উপায় নেই যে ইমামবাড়ার নির্মাতারা প্রত্যেকে শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং এ আদর্শের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুর্শিদাবাদের নিজামাত ইমামবাড়া এবং এর অভ্যন্তরে অবস্থিত মদিনা মসজিদের নির্মাতা ছিলেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব মীর্জা মুহাম্মদ সিরাজউদদৌলা।

বাংলার নবাবদের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তারা প্রায় সবাই শিয়া ছিলেন। নবাব সিরাজউদদৌলাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার শিয়া পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবেই ১৭৪০ সালে নিজামাত ইমামবাড়া ও তার অভ্যন্তরে অবস্থিত মদিনা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। নবাব সিরাজউদদৌলা নির্মিত ইমামবাড়া ও মদিনা মসজিদ ছিল কাঠের তৈরি। নবাব নিজ হাতে এ দুটি স্থাপনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং নির্মাণকাজে প্রত্যক্ষ তদারক করেছিলেন। তার নির্মিত ইমামবাড়া পুরনো ইমামবাড়া নামে পরিচিত। এটি দুবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। প্রথমে ১৮৪২ সালে, পরে ১৮৪৬ সালে। ফলে ইমামবাড়াটি সংস্কারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু মদিনা মসজিদটি অক্ষত থেকে যায়। নবাব নাজিম মনসুর আলী খান ১৮৪৭ সালে বর্তমান ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেন। তিনি নতুন একটি মদিনা মসজিদও নির্মাণ করেন।

নবাব সিরাজউদদৌলার এসব স্থাপত্যকীর্তি তার শিয়া পরিচয়ের প্রমাণ বহন করে। তার উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সূত্রও এ পরিচয়কে আরো শক্তিশালী করে। তার পিতা জয়নুদ্দিন মুহাম্মদ খান ওরফে মীর্জা মুহাম্মদ হাশিম ওরফে হায়বত জঙ্গ শিয়া মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন। মা আমিনা বেগমও শিয়া ছিলেন। সিরাজের চাচা নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। মুর্শিদাবাদের শিয়া মতাবলম্বী নবাব সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানের সঙ্গেও তিনি আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। সর্বোপরি যার কাছ থেকে সিরাজউদদৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মসনদের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন, সেই নবাব আলিবর্দি খান একজন একনিষ্ঠ শিয়া ছিলেন। আলিবর্দি শব্দের অর্থই আলীর ফুল। এমন নামই ইঙ্গিত দেয় যে বংশগতভাবে নবাব আলিবর্দি খান আহলে বাইত তথা বারো ইমামের অনুসারী ছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইমামবাড়া ও মদিনা মসজিদের মতো অনেক স্থাপনা নবাব আলিবর্দি খানের শাসনামলেও নির্মিত হয়েছিল। তিনি সৈয়দ মুহাম্মদ আলী নামে একজন শিয়া বুজুর্গ ও আলেমের মুরিদ ছিলেন। সুতরাং, এটি পরিষ্কার যে নবাব সিরাজউদদৌলা একটি শিয়া পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন এবং শিয়া সাংস্কৃতিক আবহেই তার বেড়ে ওঠা। এর প্রভাব পড়ে পরিণত বয়সে তার কর্মকাণ্ডে। যে কারণে শিয়া নবাব ও শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। তার দরবারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন শিয়া। তাদের মধ্যে মীর জাফর অন্যতম। অবশ্য তিনি পরবর্তী সময়ে নবাবের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়াকে ত্বরান্বিত করেন।

তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নবাব সিরাজউদদৌলা শিয়া হলেও তিনি সুন্নিসহ সব সম্প্রদায়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এ কারণে তার শিয়া পরিচয় নিয়ে খুব একটা হইচই হয়নি। এমনকি এ কারণে তার শাসনও কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। অবশ্য এ কথা বাংলার সব নবাবের ক্ষেত্রেই সত্য। তারা মহররমের তাজিয়া, মর্সিয়া, ইমামবাড়া, মদিনা মসজিদ ইত্যাদি শিয়া সংস্কৃতি ও স্থাপনা এ অঞ্চলে চালু ও জনপ্রিয় করে তুললেও তাদের বিরুদ্ধে সুন্নি বা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবাদের নজির ইতিহাসে নেই। অন্য নবাবদের সময়ে যেমন, তেমনি নবাব সিরাজউদদৌলার সময়েও শিয়া ও সুন্নিরা দারুণ সম্প্রীতির সঙ্গে এ অঞ্চলে পাশাপাশি বসবাস করেছে। নবাব সিরাজউদদৌলাও নিজের শিয়া পরিচয়ের কারণে সুন্নি বা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি অবিচার করেছেন কিংবা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন, এমন কোনো নজিরও ইতিহাসে নেই। ফলে ব্যক্তিগত বিশ্বাসে শিয়া হলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার নবাব।

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক