সিল্করুট

বাংলার ইমামবাড়া

বিবি কা রওজা, হোসেনি দালান ও নিজামাত ইমামবাড়া

নিজাম আশ শামস

বিবি কা রওজা ছবি: মাসফিকুর সোহান

কারবালা। নামটি শুনলেই নিশ্চয় ইরাকের একটি শহরের কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। কিন্তু আপনি কি জানেন, কারবালা নামে খোদ বাংলাতেই একটি শহর আছে? শহরটির নাম করা হয়েছে হজরত ইমাম হোসাইনের স্মৃতিবিজড়িত ইরাকের কারবালার নামেই।

বাংলার কারবালা বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় অবস্থিত। শহরটি বাংলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু কারবালা শহরের বয়ান দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হলো ভারতবর্ষের, বিশেষত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ও অভিজাতদের শিয়া সম্পৃক্ততা। ইতিহাসের দাবি অনুসারে, তাদের অধিকাংশই শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। তাদের শাসনামলে এসব অঞ্চলে শিয়া সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় শিয়াদের বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

ভারতবর্ষে সুলতানি আমলেই শিয়াদের আগমন শুরু। তাদের অনেকেই ছিলেন পারস্যের অভিজাত ব্যক্তি। বিদ্রোহসহ নানা কারণে তারা সেখানকার রাজশক্তির আনুকূল্য হারিয়ে ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। সুলতানদের, পরবর্তী সময়ে মোগল সম্রাটদের দরবারে এসব শিয়া উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন। সুলতানি আমলে বাংলায় আসা শিয়া অভিজাতদের মধ্যে সাকি সালামত নামে একজনের উল্লেখ পাওয়া যায় ইতিহাসে। তিনি খোরাসান থেকে ভারতে এসেছিলেন। দিল্লির লোদি সুলতানদের দরবারে কিছুকাল অবস্থান করে তিনি ১৪৯৯ সালে পূর্ববঙ্গের পৃথিমপাশা গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কালক্রমে পৃথিমপাশা পরিবার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। পৃথিমপাশার এ শিয়া পরিবার ‘লংলার নবাব পরিবার’ নামেও খ্যাত। পৃথিমপাশা নবাব পরিবারের অনন্য স্থাপত্য কীর্তি পৃথিমপাশা ইমামবাড়া। এটি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শিয়া নবাব, জমিদার ও অভিজাতদের বসতির ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে। পৃথিমপাশা ইমামবাড়া ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন ইমামবাড়া। ইরানের রেজা শাহ পাহলভি ইমামবাড়াটি পরিদর্শন করেছিলেন। 

ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের বহু ইমামবাড়া আছে। এসব ইমামবাড়া মোগল আমলে এ অঞ্চলে শিয়া অভিজাত ব্যক্তিদের আগমন ও বসতি স্থাপনের প্রমাণ বহন করছে। ১৬১৭ সালে বাংলার সুবাদার ছিলেন ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে এ পদে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসার সময় অনেক শিয়া তার সহগামী হয়েছিলেন। অবশ্য ঢাকার প্রাচীনতম ইমামবাড়াটি তারও আগে নির্মাণ হয়েছিল। ‘বিবি কা রওজা’ নামে ঢাকার ফরাশগঞ্জে অবস্থিত ইমামবাড়াটি ১৬০৮ সালে আমির খান নামে এক অভিজাতের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় নির্মাণ হয়েছিল। মোগল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজা বাংলার সুবাদার ছিলেন। তিনি নিজে সুন্নি মতাবলম্বী ছিলেন। কিন্তু তার মা, দুই স্ত্রী ও শিক্ষক প্রত্যেকে শিয়া ছিলেন। তার সভাসদদের অনেকেই শিয়া ছিলেন। বলা হয়, শাহ সুজা ঢাকায় আসার সময় তার সঙ্গে ৩০০ জন শিয়া এসেছিলেন। তাদের তিনি বাংলার বিভিন্ন অংশে বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার শাসনামলেই নৌবাহিনীর প্রধান সৈয়দ মুরাদ ১৬৪২ সালে বিখ্যাত হোসেনি দালান নির্মাণ করেছিলেন। এসব কারণে তার বিরোধীরা দিল্লিতে রটিয়ে দিয়েছিল যে শাহ সুজা শিয়া হয়ে গেছে। শাহ সুজার সঙ্গে যেসব শিয়া অভিজাত বাংলায় এসেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন মীর সৈয়দ শকরুল্লাহ আল-হোসাইনি। তিনি ইরাকের নাজাফ শহর থেকে ভারতে এসেছিলেন। তিনি নবাব সৈয়দ ছোটন সাহেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন। পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত সড়কে তাদের জমিদারি ছিল। সেখানে ১৭০৭ সালে এ পরিবারের তত্ত্বাবধানে ‘মোহাম্মদী বেগম ইমামবাড়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শাহ সুজার পর বাংলার সুবাদার হয়ে এসেছিলেন মীর জুমলা। তিনিও শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন।

এবার মুর্শিদাবাদের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ১৭১৭ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার তিনটি নবাব বংশ মুর্শিদাবাদ থেকে শাসন করেছিল। এগুলো হলো নাসিরি, আফশার ও নাজাফি। মুর্শিদাবাদের নাম আগে ছিল মকসুদাবাদ। সেখান থেকে যার নামে মুর্শিদাবাদ নামকরণ হলো সেই নবাব মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন শিয়া ও নাসিরি বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। ১৭১৭-২৭ সাল পর্যন্ত তিনি নবাবি পরিচালনা করেছিলেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের দাবি অনুসারে, মুর্শিদ কুলি খান ১৬৭০ সালে দাক্ষিণাত্যের একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। তার পারিবারিক নাম ছিল সূর্য নারায়ণ মিশ্র। ১০ বছর বয়সে হাজি শফি নামে মোগল দরবারে কর্মরত পারস্যের এক অভিজাত ব্যক্তি তাকে কিনে নেন। তিনি তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তার নতুন নাম দেয়া হয় মুহাম্মদ হাদি। ১৬৯০ সালে হাজি শফি মুর্শিদ কুলি খানকে নিয়ে পারস্যে ফিরে যান। তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর মুর্শিদ কুলি খান ভারতে ফিরে আসেন। খুব সম্ভবত হাজি শফির প্রভাবে এবং পারস্যে অবস্থানকালে তিনি শিয়া হয়ে ওঠেন। তার একমাত্র স্ত্রীর নাম নাসিরি বানু বেগম। প্রিয়তমা স্ত্রীর নামানুসারেই এ নবাব বংশের নামকরণ হয়েছিল। মুর্শিদ কুলি খানের পর নবাব হন তার জামাতা সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান। তিনিও একটি শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মুর্শিদ কুলি খানের মেয়ে জিন্নাত-উন-নিসার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তাদের ঘরেই জন্ম নিয়েছিল পরবর্তী এবং নাসিরি বংশের শেষ নবাব সরফরাজ খান। তিনিও পারিবারিকভাবে শিয়া মতকেই আপন করে নিয়েছিলেন।

সরফরাজ খানের পর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হন মির্জা মুহাম্মদ আলী ওরফে আলিবর্দি খান। নামেই তার পরিচয়। আলিবর্দি শব্দের অর্থ আলীর ফুল। এমন নাম তার শিয়া পরিচয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। ইতিহাসও তার এমন পরিচয়ের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। তিনি সৈয়দ মুহাম্মদ আলী নামের একজন শিয়া বুজুর্গ ও আলেমের মুরিদ ছিলেন। আলিবর্দি খানের মা ছিলেন আফশার গোত্রীয় তুর্কি। সে কারণে তার প্রতিষ্ঠিত নবাব বংশের নাম হয় আফশার। আলিবর্দি খান তার নাতি মীর্জা মুহাম্মদ সিরাজউদদৌলাকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যান।

নবাব সিরাজউদদৌলা মাত্র ২০ বছর বয়সে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শাসনভার গ্রহণ করেন। তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানেই ১৭৪০ সালে নির্মাণ হয় মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ‘নিজামাত ইমামবাড়া’। তিনি নিজ হাতে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। নবাব সিরাজউদদৌলা নির্মিত ইমামবাড়াটি ছিল কাঠের তৈরি। ১৮৪২ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে এটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৮৪৬ সালে আবার এতে আগুন লাগে। সে সময় ইমামবাড়াটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে ভাগীরথী নদীর তীরে যে নিজামত ইমামবাড়াটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি নবাব মনসুর আলী খান ১৮৪৭ সালে নির্মাণ করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের নিজামাত ইমামবাড়াকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ইমামবাড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব বংশের নাম নাজাফি। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মীর জাফর আলী খান। তার পিতা সৈয়দ আহমদ নাজাফির নামানুসারে এ বংশের নামকরণ। সৈয়দ আহমদ ইরাকের নাজাফ শহর থেকে জীবিকার অন্বেষণে ভারতে এসেছিলেন। পারিবারিক সূত্রে মীর জাফর আলী খান শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন।

লখনৌর নবাবরাও শিয়া মতের অনুরাগী ছিলেন। বিশেষ করে নবাব আসাফউদদৌলার সময়ে লখনৌতে এ মত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার শাসনামলে শিয়া সংস্কৃতির পীঠস্থান ইরান ও ইরাকের সঙ্গে লখনৌর যোগাযোগ বেশ নিবিড় হয়। পারস্যের বিভিন্ন শহর থেকে অনেক শিয়া সে সময় লখনৌতে এসে বসতি স্থাপন করে। লখনৌকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নবাব আসাফউদদৌলা ১৭৭৫-৯৭ সাল পর্যন্ত লখনৌর মসনদে ছিলেন। তার নির্দেশে লখনৌর বিখ্যাত ‘আসাফি ইমামবাড়া’ নির্মাণ হয়েছিল। এটি ‘বড় ইমামবাড়া’ নামেও পরিচিত। ১৭৮০ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৭৯৪ সালে। লখনৌর শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ। তিনি ১৮৪৭ সালে ‘সিবতাইনাবাদ ইমামবাড়া’ নির্মাণ করেন।

ইতিহাসের আলোকে উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে সুলতানি আমল থেকেই বাংলা মুলুক ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অভিজাত শিয়াদের বসতি ছিল। সুলতানি, মোগল ও নবাবি আমলে তারা প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার, নবাব ও অভিজাত ব্যক্তিদের অনেকেই শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায়গুলো তাদেরই উত্তরাধিকার বহন করছে। 

নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক