ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাসের নাম মহররম। বিভিন্ন কারণেই এ মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহররম মাসের একটি অন্যতম ঘটনা হলো কারবালার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ইসলামিক বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১০ মহররম ৬১ হিজরি এবং ইংরেজি ১০ অক্টোবর ৬৮০ সালে, বর্তমান ইরাকের কারবালা নামক প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল। এদিন হজরত মুহাম্মদের (সা.) নাতি ইমাম হোসেনকে হঠাৎই এক অসম যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয় এবং এ যুদ্ধে মরুপ্রান্তরে অবরুদ্ধ অবস্থায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বেশ কয়েকজন শিশু ও মহিলাসহ সপরিবারে, সপার্ষদে তিনি শক্রপক্ষের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। মুসলিমরা ১০ মহররম ৬১ হিজরির বিশেষ দিনটি স্মরণে শোক পালনের মধ্য দিয়ে কারবালা প্রান্তরের সেই নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদারক ঘটনাকে ফিরে দেখেন। তবে এ রীতি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষভাবে পালিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মতো বাংলাতেও নবাবি আমল থেকে নিয়মিত মহররম পালন হয়ে আসছে। কথিত রয়েছে যে নবাব মুর্শিদ কুলি খান মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করতেন। আরো পরবর্তীকালে বাংলার মসনদে বসেন নাজাফি বংশের নবাবরা (নবাব মীরজাফর ও তার বংশধররা)। এ নাজাফি বংশীয় নবাবদের আমলে মহররম পালিত হতো নবাবি পৃষ্ঠপোষকতায় অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে। মহররম উপলক্ষে নিজামাত পরিবারসহ মুর্শিদাবাদের শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় দুই মাস আট দিনব্যাপী শোক পালন করত। এ দুই মাসের প্রথম ৪০ দিন পূর্ণ হলে সেই দিনটিকে বলা হতো ‘চল্লিশা’, এভাবে ৫০ দিনে ‘পঞ্চাশা’ ও ৬০ দিন পূর্ণ হলে বলা হতো ‘ষাটা’। মহররমের শোক পালনের শেষ দিনটিকে বলা হয় ‘আসগরিয়া’। আসগরিয়া পালনের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় শোক পালন। মহররম উপলক্ষে নবাবি আমলে হাজারদুয়ারিসংলগ্ন ইমামবাড়া খুলে দেয়া হতো জনসাধারণের জন্য। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রচুর মানুষ মহররমে যোগ দেয়ার জন্য মুর্শিদাবাদ শহরে আসত। মহররমে আগত সব অতিথির থাকার ব্যবস্থা হতো ইমামবাড়ায়। কিছু যাযাবর শ্রেণীর মানুষ ইমামবাড়ার সামনেই তাঁবু খাটিয়ে থাকত। মহররম উপলক্ষে মুর্শিদাবাদে আগত এসব মানুষের ভরণপোষণের জন্য খোলা হতো ‘লঙ্গরখানা’, যেখান থেকে বিনামূল্যে পরিবেশিত হতো ‘শাহি নবাবি খাবার’। তৎকালীন সময়ে মহররম উপলক্ষে মুর্শিদাবাদের শিয়া মুসলিমরা সব ধরনের বিলাসিতা থেকে দূরে থাকত। এমনকি দুই মাস শোক পালনের সময় তারা খালি পায়ে হাঁটাচলা করত, তেল মাখত না, এমনকি মহররম মাসের ১৩ দিন তারা মাছ খাওয়াও বন্ধ রাখত। মহররম উপলক্ষে মুর্শিদাবাদ শহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও এ শোকে শামিল হয়ে এ ১৩ দিন মাছ খেত না। শোকের প্রতীক হিসেবে এ সময় শিয়া সম্প্রদায়ের সব মানুষ কালো পোশাক পরিধান করত এবং প্রার্থনা ও উপবাসের মধ্য দিয়ে এ দিনগুলো কাটাত। মহররম মাসজুড়েই কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা স্মরণ করে শোক পালন করা হতো। সমগ্র মাসজুড়েই চলত নিজামত ইমামবাড়ায় শোক সমাবেশ। সেখানে কারবালার ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা হতো। সেই সঙ্গে গাওয়া হতো শোকগীত। ইমামবাড়ার নহবতখানা থেকে বাজানো হতো করুণ সুর। শুধু নিজামাত ইমামবাড়াই নয়, শিয়া সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষের বাড়িতেই থাকত একটি করে ছোট ইমামবাড়া, সেখানেও চলত আলোচনা সভা। মহররমের বিশেষ দিনগুলোয় বের হতো শোক মিছিল। হিজরি মহররম মাসেই যেহেতু ইমাম হোসেনসহ তার আত্মীয়-স্বজন ও পারিষদদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাই সেদিনের কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনসহ বাকিদের কষ্ট অনুভবের জন্য মহররম মাসের বিশেষ দিনগুলোয় শিয়া মুসলিমরা বিভিন্ন মাতম বা শোক পালন করত। এ মাতম বিভিন্ন ধরনের হতো। যেমন ‘আগ-মাতম’ বা উত্তপ্ত কাঠকয়লার আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে চলা। ‘জঞ্জির (লোহার শিকল) মাতম’ বা শিকলের সামনে-পেছনে ছোরা বেঁধে নিজের শরীরে আঘাত করে রক্তপাত ঘটানো। ‘কামা মাতম’ বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করা। এছাড়া ‘হাত মাতম’ বা বুক চাপড়ানো। শুধু মুসলিমরাই নয়, মুর্শিদাবাদ শহরের বহু হিন্দুও মহররমের মাতমে বিশেষ করে আগ মাতম, এমনকি জঞ্জির মাতমেও অংশগ্রহণ করত। তাদের অনেকেই মুসলিমদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহররম পালন করত। ১০ মহররম বা আশুরার দিনটি হলো মহররম মাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিন সকালবেলায় নিজামাত ইমামবাড়া থেকে বড় জুলুস বা মিছিল বের হতো মুর্শিদাবাদের কারবালার উদ্দেশে। জুলুসের প্রথমদিকে থাকত নবাবি বাদ্যকারের দল। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্রে করুণ সুর তুলত। এছাড়া মিছিলে ধ্বনিত হতো ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’। মিছিল চলাকালীন সময়েই মাতম বা শোক পালনকারীরা লোহার চেনের মাথায় ছোরা বেঁধে তা দিয়ে নিজেদের পিঠে ক্রমাগত আঘাত করত। এভাবে আঘাতের পর আঘাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাতম পালনকারীদের পিঠ রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠত। সেই সময় মাতমকারীদের রক্তাক্ত পিঠে ঢালা হতো গোলাপজল। এ গোলাপজল ও রক্তের গন্ধ বাতাসে মিশে সমগ্র পরিবেশ বিষণ্ণতায় ভরে উঠত। মিছিলে একদল মানুষ মিলিতভাবে শোকগীত গাইতে গাইতে এগিয়ে চলত মুর্শিদাবাদ শহরের কারবালা প্রান্তে। মহররম শোক পালনের মাস হলেও তাতে ধর্মীয় সম্মিলনের উৎসব আমেজ যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে মহররম উপলক্ষে মুর্শিদাবাদ শহরের কেল্লা নিজামাত ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো নতুন সাজে সেজে ওঠে। হাজারদুয়ারি ও ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী মাঠে মেলা বসে। নিজামাত ইমামবাড়া রঙিন আলো দিয়ে সাজানো হয়। আজও মুর্শিদাবাদের মহররম উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ মুর্শিদাবাদে আসেন। মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন ইমামবাড়া সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। সেখানে মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষরাও ধূপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন। শুধু তা-ই নয়, আজও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মহররম পালনে তাদের মুসলিম ভাইদের সব সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। এমনকি তারা জুলুসে এবং মাতমেও অংশগ্রহণ করে। ১০ মহররম আশুরার দিন সকাল থেকেই নিজামাত ইমামবাড়া থেকে বড় ‘জুলুস’ বা মিছিল শুরু হয়। জুলুসটি শেষ হয় মুর্শিদাবাদ শহর থেকে কিছুটা দূরে কারবালার প্রান্তে। জুলুসে অংশগ্রহণকারীরা মুর্শিদাবাদের কারবালা যাওয়ার পথেই রাস্তার মাঝে জঞ্জির মাতম, হাত মাতম পালন করতে থাকে। এছাড়া জুলুসে একদল মানুষ গাইতে থাকে শোকগীত। এভাবেই জুলুস এগিয়ে যেতে থাকে কারবালার দিকে। জঞ্জির মাতম পালনকারীদের রক্তে লাল হয়ে যায় রাস্তা। এভাবেই জুলুস গিয়ে থামে মুর্শিদাবাদের কারবালায়। এভাবেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ মুর্শিদাবাদের মহররমকে মহতী করে তোলে। তথ্য সহায়তায়: ১) ক্ষেত্র সমীক্ষা ২) সৈয়দ মোহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা (সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী মুর্শিদাবাদের নবাব পদের বৈধ উত্তরাধিকারী। পরিবারের প্রবীণ সদস্য) ৩) সৈয়দ রেজা আলি মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের প্রবীণ সদস্য) ৪) সৈয়দ আতাহার আলি (মুর্শিদাবাদ ওয়াসিফ মঞ্জিলে কর্মরত) ৫) সৈয়দ দানিস মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের সদস্য) ৬) সৈয়দ ফাহিম আলি মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের সদস্য) ৭) সৈয়দ ওয়াকার আব্বাস (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের সদস্য) ৮) সৈয়দ শারাফাত আলি মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের প্রবীণ সদস্য) ৯) সৈয়দ রিজওয়ান আলি মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের প্রবীণ সদস্য) ১০) সৈয়দ ওয়াকিল মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের সদস্য) ১১) সৈয়দ আসিফ আব্বাস মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের সদস্য) ১২) সৈয়দ জামিল মির্জা (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের প্রবীণ সদস্য) ১৩) সৈয়দা তারাৎ বেগম (মুর্শিদাবাদ নিজামাত পরিবারের প্রবীণ সদস্যা) ফারুক আব্দুল্লাহ: মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গবেষক
মুর্শিদাবাদে মহররম উদযাপন ছবি: লেখক