অনুবাদ: কাওছারা বেগম একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ফারসি ভাষা ভারতে তার স্থান করে নিতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীর খুব কাছাকাছি সময়ে ঘুরীদের উত্তর ভারত বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চল প্রথম ফারসিভাষী বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উত্থানের সাক্ষী হয়। সুলতান মুহাম্মদ বিন সামের সিপাহসালাররা সবাই ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত দাস। তারা খুব অল্প বয়সে দাস হিসেবে ইরানে আসেন এবং ইরানি সংস্কৃতির মধ্যে থেকে ইরানীকৃত হয়ে বেড়ে ওঠেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী ফারসিভাষী এলাকা খোরাসান, ট্রান্সঅক্সিয়ানা থেকে এসে প্রচুর লোক এসব গভর্নরের (পরবর্তী সময়ে সুলতান) দরবারে উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ভাগ্যান্বেষী এসব লোকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল যোদ্ধা, পণ্ডিত, কবি, আর্টিস্ট, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশাজীবী। এ সময়ের ধর্ম, ইতিহাস ও রাজনীতিবিষয়ক অধিকাংশ সাহিত্য ছিল আরবি ভাষায় রচিত। ফারসিভাষী মানুষের ব্যাপক আনাগোনার কারণে এসব সাহিত্য ফারসি ভাষায় অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ভারতের সুলতান ফারসিকে অফিশিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পণ্ডিতদের এ ভাষায় লেখার জন্য উৎসাহিত করলে ফারসি ভাষার উত্থান আরো বেগবান হয়। একাদশ শতকের শেষভাগ থেকে ফারসি ভাষা ইতিহাসচর্চা ও কবিতা লেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছিল, দ্বাদশ শতকে এসে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিজ্ঞান ও ধর্মীয় দর্শনসম্পর্কিত আরবি ধ্রুপদি সাহিত্যগুলোর অনুবাদ। এ সময়ের কিছু ফারসি অনুবাদ ও আরবি মূল গ্রন্থ গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শুধু পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজনে আরবি থেকে ফারসি ভাষায় জ্ঞানের স্থানান্তরণ ঘটেনি, বরং সিন্ধু ও মুলতানের হিন্দুদের সঙ্গে বিজয়ী আরবদের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে জানার জন্যও এসব অনুবাদ করা হয়। বিদেশী বংশোদ্ভূত মুসলিম শাসকদের জন্য এটা জানা প্রয়োজন ছিল যে বাহির থেকে এসে মুসলিম শাসন অতীতে কীভাবে স্থানীয়দের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসবিদ আলী কুফি অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে (৭১২-১৩) আরবদের সিন্ধু ও পাঞ্জাব বিজয়ের ইতিহাস রচনা করে সুলতান নাসির উদ্দিন কুবাচাকে উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিহাস রচনার জন্য উপাদান অনুসন্ধান করে তিনি সিন্ধের আরোর শহরে আরবদের বিজয়সংক্রান্ত একটি আরবি পাণ্ডুলিপি পান। পাণ্ডুলিপিটি ফারসি ভাষায় অনুবাদের পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করা। আলী কুফির অনুবাদে মূল আরবি লেখায় প্রতিফলিত শাসক ও শাসিতের মধ্যকার সম্পর্কের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। রায়, ঠাকুর এবং রানাদের কথা উল্লেখ করার ক্ষেত্রে আলী কুফির উদ্দেশ্য ছিল সুলতান নাসির উদ্দিন কুবাচাকে এটা জানানো যে স্থানীয় ভূমিপূত্র নেতৃত্বের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন, কেননা তারা স্থানীয় ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইঙ্গিত করেন একজন মুসলিম শাসককে হিন্দু নেতাদের ওপর তাদের বিজয়কে ধ্বংস নয় বরং মীমাংসার প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এটি এই বার্তা দেয় যে এখানে ক্ষমতা সুসংহতকরণের জন্য রাষ্ট্র ও ভূমিপুত্র অভিজাতদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। আলী কুফির দৃষ্টিতে পাণ্ডুলিপিটির আবিষ্কার ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা। আলী কুফি দুর্ভাগ্যতাড়িত হয়ে নিজ শহর থেকে রাজধানী উচ্-এ আসেন এবং এখানে তিনি ইতিহাসের বই পড়ে সময় কাটান। ইতিহাসের এসব বইয়ে বিভিন্ন দেশে আরবদের বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া গেলেও মুহাম্মদ বিন কাসিমের অধীনে আরব সাগর থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত হিন্দুস্তানে আরব বিজয়ের কোনো বিবরণ পাননি। ফলে তিনি নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে মুসলিমদের বিজয় এবং মোহাম্মদ ইমাদ-উদ দৌলা ওয়াদ-দিন মুহাম্মদ বিন কাসিম আল সাকাফি এবং তার অনুসারীদের অর্জন সম্পর্কে ইতিহাস রচনার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ইতিহাস রচনা শুরু করেন ‘হযরত-ই-উচ্’ থেকে ‘আরোর-ই-ভাক্কার’ পর্যন্ত, যেখানে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিখ্যাত আরব বংশধররা বসবাস করতেন। তিনি কাজী ইসমাইল আল সাকাফির কাছে হেজাজের অপ্রচলিত আরবি ভাষায় রচিত সিন্ধু ও পাঞ্জাবে আরব বিজয়সম্পর্কিত একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। এ ভাষা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা ও পাঠোদ্ধার করা কঠিন ছিল বলে এটি অজানা থেকে যায়। আলী কুফি এটিকে ফারসি ভাষায় অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেন যেন স্থানীয় পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ তা পড়তে পারেন। যদিও আলী কুফি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এ গ্রন্থের সংকলকের নাম উল্লেখ করেননি। লেখক তার নিজের পরিবার সম্পর্কেও কোনো তথ্য প্রদান করেননি। শুধু এটুকু উল্লেখ করেন যে নিজ শহরে সম্পদ হারিয়ে তিনি নাসির উদ্দিন কুবাচার উজির হুসাইন আল আশারীর (যিনি হোসাইন-উল-মুলক আল আশারী নামেও পরিচিত এবং জ্ঞানচর্চার একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন) কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে এটি ছিল আরবি ভাষায় লিখিত সিন্ধু ও পাঞ্জাবে আরবদের বিজয় বিবরণীর ফারসি অনুবাদের প্রস্তুতি। ইতিহাসবিদ আলী কুফি তার পূর্ববর্তী আবু আলি আল বালামি বা গজনার গার্দেজির মতো আরবি থেকে ফারসিতে অনুবাদের সময় বর্ণনা সংক্ষিপ্ত না করে সিন্ধুতে রাজা দাহিরের ব্রাহ্মণ রাজবংশের ক্ষমতায় আরোহণের বিষয়ে আরো উপাদান যুক্ত করেছেন বলে মনে হয়। দাহিরের পিতা চাচ ব্রাহ্মণ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। চাচের ক্ষমতায় উত্থানের বর্ণনার পাশাপাশি সিন্ধুর রানী ও চাচের মধ্যকার প্রণয় এবং প্রেমিকের জন্য সিংহাসন সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে তার বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কেও বিশদ বিবরণ দেন। এসব বিষয় কাজী ইসমাইল সাকাফির কাছ থেকে আলী কুফির পাওয়া পাণ্ডুলিপি মূল আরবি পাণ্ডুলিপির অংশ হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ তৈরি করে। এছাড়া ধ্রুপদি যুগের আরব ঐতিহাসিকদের এবং চাচনামার সংকলকের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যও দেখা যায়। প্রাথমিক যুগের আরব ঐতিহাসিকরা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে উৎস নির্বাচন করতে সক্ষম ছিলেন। ফলে তাদের রচিত আখ্যানগুলো সাহিত্যিক কৃত্রিমতা, বিচার-বিশ্লেষণের অভাব বা ইচ্ছাকৃত অসত্য থেকে মুক্ত ছিল। আরব ইতিহাসবিদরা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বর্ণনার সময় জাগতিক বিষয়গুলোকে বাদ দিয়েছেন, এমনকি তা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও। ইতিহাসবিদ আল বালাজুরির ফুতুহ আল বুলদানে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের বিবরণীর সঙ্গে চাচনামার তুলনা করলে দেখা যায়, সিন্ধুর হিন্দু শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাথমিক অংশটি আলী কুফি তার আরবি পাঠের অনুবাদে যুক্ত করেছিলেন। কেননা ধ্রুপদি যুগের আরব সাহিত্যিকরা আরব বিজয়-পূর্ব শাসকগোষ্ঠীর উত্থান-পতন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেননি। এটি হতে পারে যে চাচনামার মূল আরবি পাঠ্যের বেনামি লেখক মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয়ের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যা আল বালাজুরি বা অন্যান্য আরব ইতিহাসবিদ করেননি। এখানে আমরা চাচনামার বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে রাজকুমার ও রাজকন্যার প্রণয় কাহিনীকে দেখব ঐতিহাসিক ঘটনাবলির আলোকে। হিন্দু শাসকদের অধীনে সিন্ধুসম্পর্কিত শুরুর অংশটি কিংবদন্তির ওপর নির্ভর করে রচিত বলে অনুমিত হয়, যা জ্যোতিষীরা পুঁথির মাধ্যমে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। রোমান্টিক কাহিনী এবং অন্যান্য তুচ্ছ উপাদানগুলোকে বাদ দিলেও আরব বিজয়-পূর্ববর্তী সময়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করে গ্রন্থটি। প্রথম অংশটিতে হিন্দু রাজা সাহিসির পুত্র সাহরসের রাজত্বকালের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। রাজা সাহরস একটি বিশাল রাজ্য শাসন করতেন যার পূর্বে কাশ্মীর, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে মুলক-ই-নিমরোজ বা সিস্তান এবং দক্ষিণে আরব সাগর অবস্থিত। ‘কুহ-ই-কাইকানান’ বা কালাতের পর্বতশ্রেণীও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাহরাস তার রাজধানী আরোরে বসবাস করতেন। রাজ্যটি চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল, যার প্রতিটি একেকজন গভর্নর বা কোনো বংশগত প্রধানের অধীনে ছিল, যারা সামন্ত হিসেবে শাসন করতেন। দক্ষিণ ভাগের সদর দপ্তর ছিল ব্রাহ্মণাবাদ, যার সীমানা উপকূল থেকে লোহানা এবং সামোনা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নেরুন ও দাইবুল বন্দর শহরগুলো এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় ভাগে ছিল কেন্দ্রীয় অঞ্চল, যার সদর দপ্তর হিসেবে ছিল সিস্তান। সিস্তান শহরের পাশাপাশি মাকরানের সীমান্ত পর্যন্ত জানকান ও রোজাবানের আশপাশের এলাকাগুলো এ ভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তৃতীয় ইউনিটের রাজধানী দুর্গশহর ইস্কালান্দা এবং এ প্রদেশ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল যার মধ্যে বাটিয়া, চাচপুর ও দেহরপুর অন্তর্ভুক্ত ছিল। চতুর্থ ইউনিট ছিল মুলতান ও কাশ্মীরের আশপাশের এলাকা। এর শাসক সিন্ধু রাজার সামন্ত হিসেবে শাসন করছিলেন বলে অনুমিত হয়। চাচনামার বিবরণ অনুযায়ী উত্তর প্রদেশটি খোরাসান থেকে আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল। সিস্তানের রাজা একবার আক্রমণ করেন। গভর্নর প্রতিরক্ষায় দুর্বল হওয়ায় রাজা সাহরস তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। রাজা সাহরস সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে সিন্ধুদের পরাজিত করেন। রাজা সাহরসের পর তার পুত্র সাহাসি আরোরের ক্ষমতায় বসেন এবং চারটি আঞ্চলিক ইউনিটের গভর্নর তার অধীনতা স্বীকার করেন। রাজা সাহাসি শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় রাম তার রাজসরকার (হাজিব) এবং রাজপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চাচ ব্রাহ্মণ, যিনি কেরানি হিসেবে কাজ করতেন এবং রামকে কাজে সহায়তা করতেন, তিনি লেখক হিসেবে দক্ষতার কারণে রাজার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ফলে যথাসময়ে রামের পরিবর্তে চাচ ব্রাহ্মণ হাজিব এবং উজির পদে অধিষ্ঠিত হন। সিন্ধুর রানী চাচের প্রেমে পড়েন। পরিণতির কথা বিবেচনা করে চাচ উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকলেও রানীর ক্রমাগত অনুরোধে একসময় চাচ রাজি হয়ে যান এবং তার সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেন। রাজা সাহাসির মৃত্যু হলে রানীর নির্দেশ অনুযায়ী চাচ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিয়ে সিংহাসন দখল করেন এবং রানীকে বিয়ে করেন। এভাবে চাচ বংশের ভিত্তি স্থাপিত হয়। কথিত আছে চাচ ৪০ বছর রাজ্যশাসন করেন। চাচের মৃত্যুর পরে তার ভাই চন্দর সিংহাসন দখল করে সাত বছর রাজ্য পরিচালনা করেন। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত হন চাচপুত্র দাহির। স্পষ্টতই এ আখ্যানের বেশির ভাগ অংশ কল্পকাহিনীর সঙ্গে মিশ্রিত, তবুও এটিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা যায় না। কেননা যে পরিস্থিতি চাচদের ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল তা বিবেচনায় ঘটনা সম্পূর্ণ সত্যবিবর্জিত বলে মনে হয় না। একইভাবে পাণ্ডুলিপির শেষে বর্ণিত মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর গল্পটিও কিংবদন্তির সঙ্গে জড়িত এবং প্রায় কয়েক শতাব্দী পরে সাজানো। বলা হয়ে থাকে যে মুহাম্মদ বিন কাসিম লুণ্ঠিত দ্রব্যের সঙ্গে রাজা দাহিরের দুই কন্যাকে বাগদাদে খলিফার কাছে প্রেরণ করেন। খলিফা ভারতীয় রাজকন্যাদের প্রাসাদে থাকার নির্দেশ দেন। কিছুদিন পর খলিফা দাহিরের বড় মেয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গ কামনা করেন। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে যে মহারাজ দীর্ঘজীবী হোন! আমরা মহারাজের ভালোবাসার যোগ্য নই, কেননা মুহাম্মদ বিন কাসিম এখানে পাঠানোর আগে তিনদিন আমাদের সঙ্গে তার বিছানা ভাগ করে নিয়েছিলেন। এটা কি তোমাদের প্রথা? খলিফা তার এ বক্তব্য বিশ্বাস করেন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ডেকে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর পর রাজকন্যারা তাদের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ হিসেবে মিথ্যা অভিযোগের বিষয়ে স্বীকার করলে খলিফা তাদেরও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল উমাইয়াদের রাজধানী দামাস্কাস এবং বাগদাদের তখন অস্তিত্বই ছিল না। মুহাম্মদ বিন কাসিমের পতন ঘটে তার পৃষ্ঠপোষক খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যুর পর, কেননা উত্তরাধিকারী খলিফা সুলাইমান ওয়ালিদের লোকদের বিশ্বাস করেননি এবং তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর তাদের অপসারণ করেন। ফলে এ সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমকেও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এই কিংবদন্তিটিও আলী কুফি দ্বারা যুক্ত করা হয়েছে বলে মনে হয়। চাচনামায় উল্লেখিত রোমান্টিক গল্প, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, যুদ্ধের বিবরণ, যোদ্ধাদের পরিচয়সংক্রান্ত বিষয়গুলো আল বালাজুরি এবং অন্যান্য আরব ইতিহাসবিদের দ্বারা শুধু প্রমাণিত হয় না, বরং চাচনামা এসব রচনাবলিতে প্রাপ্ত তথ্যের পরিপূরকও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বালাজুরি সংক্ষেপে মাকরানের গভর্নর সাইদ বিন আসলাম কিলবিকে তার অনুসারীদের দ্বারা হত্যার কথা উল্লেখ করেন। বিদ্রোহীদের মধ্যে ইলাফি ভাইরাও ছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৈন্য নিযুক্ত করলে তারা পালিয়ে গিয়ে সিন্ধুতে আশ্রয় নেয়। ইলাফি ভাইদের যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতির কারণে রাজা দাহির তাদের আশ্রয় প্রদান করে। তারা রাজা দাহিরকে তার শত্রুর বিরুদ্ধে এমনকি আরবদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সমরকৌশলে সহায়তা প্রদান করে। সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও ভারতীয়রা পরাজিত হয়। বালাজুরি এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ না দিলেও চাচনামার লেখক যুদ্ধ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ প্রদান করেন। চাচনামায় যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য দাহিরকে যথাযথ কৃতিত্ব দেয়া হয়। দাহিরের পতনের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইলাফি ভাইরা কাশ্মীরে পালিয়ে যায়। এছাড়া ইলাফি ভাইদের প্রতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের মনোভাব সম্পর্কেও আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া যায় চাচনামায়। ভারতীয় প্রদানদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং স্থানীয় রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞানের কারণে মুহাম্মদ বিন কাসিম ইলাফি ভাইদের তার দরবারে আমন্ত্রণ জানান। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার নিজের বিবেচনায় ইলাফি ভাইদের ক্ষমা করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা খলিফা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে এ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করতেন, কারণ ইলাফিরা মাকরানের গভর্নরকে হত্যার দায়ে দোষী ছিল। ইলাফিরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরব সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে এবং স্থানীয় প্রধানদের মুহাম্মদ বিন কাসিমের মাধ্যমে খলিফার আধিপত্য স্বীকার করতে প্ররোচিত করতে থাকে। ইসলামের শিক্ষা এবং এর অনুসারীদের আচার-আচরণ ধারা প্রভাবিত হয়ে কিছু ভারতীয় প্রধান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, যারা পরবর্তী সময়ে মাওলা-ই-ইসলাম নামে পরিচিতি লাভ করেন। এভাবে আরব বিজেতা এবং স্থানীয় প্রধানদের মধ্যে একটি সৌহার্দ ও বন্ধুত্বের পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা যথাক্রমে বিজিত অঞ্চলে মুসলিম শাসনকে সুসংহত করতেই সাহায্য করেনি বরং ইসলামী বিশ্বের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রক্রিয়াকেও গতিশীল করেছিল। চাচ ব্রাহ্মণদের ক্ষমতায় আরোহণের আগে সিন্ধুর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী বৌদ্ধদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ শাসকদের সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে চাচনামা। চাচের ক্ষমতায় আরোহণের পর বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করলে নির্মমভাবে দমন-পীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হয়। ফলে আরব আক্রমণের সময় বৌদ্ধরা দাহিরের পরিবর্তে তার শত্রুদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এসব প্রধানের মধ্যে নেরুনের সামানি প্রধান দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে খলিফাকে সহযোগিতা করবেন জানিয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে দূত প্রেরণ করেন বলে জানা যায়। মোকাহর ভাইও একই কাজ করেন। এ সহযোগিতার জন্য তাদের দুজনকেই মোহাম্মদ বিন কাসিম পুরস্কৃত করেন। বালাজুরির ফুতুহ-উল-বুলদান এবং তাবারির তারিখের সংক্ষিপ্ত বিবরণীর বিপরীতে চাচনামায় মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মধ্যে আদান-প্রদানকৃত চিঠিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এ চিঠিগুলো অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নীতি, এমনকি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ধর্মীয় নীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। বালাজুরি বা অন্যান্য আরব ইতিহাসবিদের তুলনায় চাচনামার লেখক ভারতীয় বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা প্রদানের অর্থ সামাজিক জীবন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করা। ব্রাহ্মণ্যবাদের ব্রাহ্মণরা বশ্যতা স্বীকার করলে মুহাম্মদ বিন কাসিম তাদের বিশ্বস্ত বলে ঘোষণা দেন। তিনি তাদের পূর্বে অধিষ্ঠিত পদে পুনর্বহাল করেন, বিশিষ্টদের রানা উপাধি দেন এবং মন্দির নির্মাণের জন্য অনুমতি প্রদান করেন। যাই হোক, পূর্ববর্তী ব্রাহ্মণ শাসকদের ঐতিহ্য, অপরাধীদের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের পুড়িয়ে মারা সম্পর্কে ফ্রিডম্যানের বক্তব্যের সমর্থন চাচনামায় পাওয়া যায় না। জাটদের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দেয়া উপদেশ মুহাম্মদ বিন কাসিম মেনে নিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বা তার আরব সঙ্গী-সাথীরা তাকে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ইসলামী আইনকে অমান্য করার অনুমতি দেয়নি। একইভাবে ফ্রিডম্যানের বক্তব্য, “It is fascinating to observe
the way in which sharia injunctions were projected into the past, transposed into the Indian milieu and
probably blended with local customs.” এটি একটি কষ্টকল্পনীয় এবং বাস্তব ভিত্তিহীন বক্তব্য। বরং ভারতের শহরকেন্দ্রগুলোতে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতরা ইসলামের সমতাবাদী সংস্কৃতি থেকে উপকৃত হয়েছে বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামী সমাজে শরিয়াকেন্দ্রিকতা বিশ্বাসীদের সমতার বোধকে উন্নীত করেছিল এবং ইসলামী সংস্কৃতি, সামাজিক বাস্তবতা ও বর্ণ সমাজের শ্রেণীবদ্ধ ধারণাগুলোর তুলনায় বৈপরীত্যের মধ্যে সাম্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, বর্ণপ্রথায় নিষ্পেষিত মানুষের মনে মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছিল। ফলে ধর্মান্তরিতরা কেবল তাদের প্রথা-পদ্ধতি পরিবর্তন করেনি, বরং তারা আরবদের সঙ্গে মিশেছে, তাদের দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্মকেও ইসলামী ঐতিহ্যে শিক্ষিত করেছে, যাদের মধ্য থেকে অনেকে কোরআন-হাদিসে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সিন্ধের পণ্ডিতরা ভারতীয় বিজ্ঞানকে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। গণিত, জ্যোতিষ শাস্ত্র এবং চিকিৎসার ওপর রচিত সংস্কৃত গ্রন্থগুলো আরবদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করেছিল। উপসংহারে এটা মনে হয় বলা যেতে পারে যে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সামরিক অভিযান এবং জয়ের পর তার আচরণসম্পর্কিত আবুল হাসান আল মাদাইনির হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে কেননা আলী কুফি তার তথ্যের উৎস হিসেবে এটির কথা উল্লেখ করেছেন। এটি আরব ইতিহাসগ্রন্থের প্রতিনিধি, যা প্রাক-ইসলামী পারস্য ইতিহাস গ্রন্থগুলো থেকে আলাদা ছিল। আরব ইতিহাসবিদরা ঐতিহাসিক তথ্যগুলোকে সাধারণ তথ্য থেকে আলাদা করে সাবধানতার সঙ্গে উপাদান নির্বাচন করেন। পাঠকের নান্দনিক সন্তুষ্টির জন্য তারা রোমান্টিক গল্প বা অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে যুক্ত করেননি। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার জন্য তারা একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গড়ে তোলেন এবং তাদের রচনাশৈলী ছিল সহজ, শান্ত, সাহিত্যিক কৃত্রিমতা এবং অলংকারমুক্ত। অনুবাদকের জনপ্রিয় কিংবদন্তি যুক্ত করা এবং কাজের ভূমিকা প্রদান করার কারণে আমরা সুলতান নাসির উদ্দিন কুবাচা ও তার উজির কৃতিত্ব হিসেবে ভারতের কয়েকটি শহরকে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা সম্পর্কে জানতে পারি। সুলতান এবং তার উজির আইনুল মুলক আশারি উভয়েই ছিলেন বিদ্বান এবং জ্ঞানচর্চার পৃষ্ঠপোষক। চাচনামায় আমরা উচ্ এবং ভাক্কারের শহর সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য পাই যেগুলো সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। আলী কুফি প্রথম সমসাময়িক লেখক যিনি আমাদের জানান যে উচ্ ছিল নাসির উদ্দিন কুবাচার রাজধানী, যাকে তিনি হযরত-ই-উচ্ বলে উল্লেখ করেছেন। সবশেষে বলা যায়, চাচনামা হলো ভারতে রচিত প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ যাতে, প্রাক-ইসলামিক ইরানি এবং ধ্রুপদি আরব সাহিত্যের মতো দুটি ভিন্ন ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে।