সিল্করুট

আরবের সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ও সিন্ধের রাজা দাহির

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন

রাজা দাহিরের অনুমিত চিত্রকর্ম। ইন্ডিয়ান স্কুল

আরবদের সিন্ধু বিজয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটিকে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের আগমনের সূচনালগ্ন ধরা হয়। আর ঐতিহাসিক ঘটনার প্রধান কুশীলব ছিলেন দুজন। আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর তৎকালীন রাজা দাহির। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে দ্বৈরথে আবির্ভূত হওয়া দুই নায়কের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরাই লেখার উদ্দেশ্য।

ইমদাদ উদ্দিন মুহাম্মদ। এটিই তার প্রকৃত নাম। পিতার নাম আল কাসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল হাকাম। মায়ের নাম হাবিবাত আল উজমা। পিতার নামের সঙ্গে মিলিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম নামেই তিনি ইতিহাসে পরিচিত হয়েছেন।

শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। সংসারের হাল ধরেন তার মা। তিনি একজন শিক্ষিতা সম্ভ্রান্ত মহিলা ছিলেন। তিনি পুত্রকে নৈতিক চারিত্রিক প্রশিক্ষণ দেন। তার লেখাপড়ার যথাযথ বন্দোবস্ত করেন। ছোট থেকেই মুহাম্মদ বিন কাসিম সমরশাস্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালানো ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। পুত্রের আগ্রহ বুঝে মা তাকে সমরশাস্ত্রে প্রশিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি তাকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দেন। হাজ্জাজ তখন উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের একজন সেনাপতি ছিলেন। সম্পর্কে তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের আপন চাচা খালু হতেন। তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে খুবই আদর স্নেহ করতেন। হাজ্জাজ দূরদর্শী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যথাযথ প্রশিক্ষণ উপযুক্ত সহায়তা পেলে কালক্রমে মুহাম্মদ বিন কাসিম একজন বড় যোদ্ধা হবেন। তাই তিনি প্রতিটি যুদ্ধে তাকে সঙ্গে রাখতেন। ফলে সমরশাস্ত্রের প্রতিটি দিক মুহাম্মদ বিন কাসিম হাতে-কলমে আয়ত্ত করার সুযোগ পান। একপর্যায়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের গভর্নর নিযুক্ত হন। মুহাম্মদ বিন কাসিম যথারীতি তার সঙ্গেই থাকেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম নিজেকে প্রমাণের একটি সুযোগ খুঁজছিলেন। সে সময় মুসলমানরা খোরাসানে যুদ্ধ করছিলেন। সে বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন কুতায়বা বিন মুসলিম। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার সঙ্গী হন। প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল আকবর খান রচিত মুহাম্মদ বিন কাসিম বইয়ে উল্লেখ আছে, সে সময় খুরাসানে মুসলিম ফৌজ জিহাদে মশগুল ছিল এবং হাজ্জাজ সেই চিন্তায় ছিলেন বিভোর। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমও নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবনে হাঁপিয়ে ওঠেন। কুতায়বা বিন মুসলিম যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে খুরাসান, খাওয়ারিজম তুর্কিস্তান অভিমুখে রওয়ানা হন, তখন মুহাম্মদ বিন কাসিমও এই খ্যাতিমান জেনারেলের সঙ্গী হন। সেখানে তিনি তার মেধা, প্রতিভা, সাহসিকতা, বীরত্ব শৌর্য-বীর্যের এমনই পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন যে সেনাপতি কুতায়বা তাকে পদোন্নতি দিয়ে স্বীয় সহকারী নিযুক্ত করেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স তখন মাত্র ষোল কিংবা সতেরো। এর মধ্যেই সম্মুখ সমরে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের যোগ্যতায় অত্যন্ত খুশি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তিনি তখন আরেকটি ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সিন্ধুর রাজা দাহির সে সময় আরব বণিকদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করেন। হাজ্জাজ রাজা দাহিরের সঙ্গে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য উবায়দুল্লাহ নামে একজনকে পাঠান। কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়। খবরটি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কানে পৌঁছলে তিনি রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সিন্ধুতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক প্রেরিত বাহিনীর সেনাপতি নির্বাচিত হন মুহাম্মদ বিন কাসিম।

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম। অল্প কথায় তার জীবনের একটি মূল্যায়ন আমরা মেজর জেনারেল আকবর খানের লেখায় পাই। মুহাম্মদ বিন কাসিম বইয়ে তিনি লিখেছেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম খুবই যোগ্য উস্তাদের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। অল্প বয়সেই তিনি নিজের ওপর এতখানি আস্থাশীল ছিলেন যে হাজ্জাজ কুতায়বার মতো খ্যাতিমান অধিনায়কদের সামনে স্বীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কীয় মতামত অত্যন্ত নির্ভীকভাবে প্রকাশ করেন। তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, ভাষার ক্ষেত্রে নির্ভীক এবং দৈহিক শারীরিক দিক দিয়ে পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি বিলাসিতাকে পছন্দ করতেন না। সৈনিক জীবনের জন্য যেসব অভ্যাস স্বভাবের দরকার, তার সম্মান কদর বুঝতেন। হাজ্জাজের শিক্ষানবিশি করার ফলে তিনি ফৌজের শাসন-শৃঙ্খলা, প্রশিক্ষণ বিন্যাস এবং মূলনীতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

এবার রাজা দাহির প্রসঙ্গে আসা যাক। তাকে বলা হয় সিন্ধুর সর্বশেষ হিন্দু রাজা তিনি ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চাচ। দাহির ছিলেন সিন্ধুর পুষ্কর্ণ ব্রাহ্মণ সাম্রাজ্যের রাজা। দাহিরের পিতা চাচের বর্ণনা দিতে গিয়ে মেজর জেনারেল আকবর খান লেখেন, ৬২০ ঈসায়ীতে সিন্ধু এলাকার রাজা ছিলেন রায়সিংহ। রাজা রায় চাচ নামীয় একজন ব্রাহ্মণকে তার পরামর্শদাতা নিযুক্ত করেন। চাচ সায়িজ নামক জনৈক গরিব ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন। তিনি (চাচ) ছিলেন খুবই সুপুরুষ, ধী-শক্তিসম্পন্ন যোগ্য। ৬৩০ ঈসায়ীতে রাজা রায়-এর মৃত্যু হলে তার তরুণী সুন্দরী বিধবা স্ত্রী রানী শুদ্ধানী চাচের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। অতঃপর চাচ নিজেকে সিন্ধুর রাজা বলে ঘোষণা করেন। চিতোরে সে সময় রাজা মহতরাজ রাজত্ব করছিলেন। তিনি ছিলেন রাজা রায়ের ভাই। স্বাভাবিকভাবেই চাচের রাজা হওয়া এবং তার মৃত ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করা মহতরাজের বিরক্তি উৎপাদন করে। তিনি রাজা চাচের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। কিন্তু যুদ্ধে রাজা মহত মারা যান এবং পরিণামে রাজা চাচ ৪০ বছর যাবৎ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য শাসন করেন। তার সাম্রাজ্য বিপাশা নদীর তীর ধরে বাবীহ, মুলতান, সিন্ধু প্রভৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ৬৭০ ঈসায়ীতে রাজা চাচের মৃত্যু হলে তদস্থলে তার ভাই চন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৬৭৮ ঈসায়ীতে রাজা চন্দ্র মারা গেলে চাচের কনিষ্ঠ পুত্র দাহির সিংহাসনে উপবেশন করেন।

রাজা দাহিরের সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। সেগুলো হলো আলোর, সুস্তান, কারওয়ান, ব্রাহ্মণাবাদ, স্কালিন্দা মুলতান। রাজা দাহিরের অধীনে থাকা করদ রাজ্যগুলো হলো দেবল, নীরুনকোট, সহওয়ান, বাহমনাবাদ সিবী।

ইতিহাসের নির্মোহ রচনা পাঠ বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে যিনি লিখছেন আর যিনি পড়ছেন, তার দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই ইতিহাস নির্ভরশীল। তাই মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরকে নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। সেসব এক পাশে সরিয়ে রেখে লেখার মাধ্যমে ইতিহাসের দুই নায়কের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠক জানতে পারবেন, সে কামনায় এখানেই ইতি টানছি।

 

মোহাম্মদ রবিউল হোসাইন: লেখক