সিল্করুট

আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে চাচনামা যেভাবে ‘কনকোয়েস্ট’ তত্ত্বে যুক্ত হলো

শানজিদ অর্ণব

পাকিস্তানের উচ শহরে বিবি জয়িন্দির সমাধি

কোনো কিছুর শুরু ইতিহাসের রাজনীতি যুগে প্রবল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শুরু থেকে দেশ, জাতি, ভাষা, সাহিত্যএমন নানা বিষয়ের সূচনা বিন্দু খোঁজার তত্পরতা আধুনিক যুগে প্রবল হয়েছে। শুরুর ইতিহাস একবার নিজের পক্ষে আনতে পারলেই অনেক জায়গায় নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে যায়। আবার কখনো অন্যের শুরুর ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করে নিজের দখলকে যুক্তিযুক্ত করা যায়। আর শুরু নির্ধারণ করতে পারলে সরলরৈখিক উন্নতি কিংবা সভ্যতার বিকাশের গৌরবের ঢাক পেটানো সহজ হয়।

চাচনামা এমনই এক শুরুর ইতিহাস। আলী কুফি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আরবি থেকে ফারসি ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরব তরুণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের কাহিনী বিধৃত হয়েছে গ্রন্থে। এর মাধ্যমে চাচনামা পরিচিত হয়েছে ভারতবর্ষে মুসলিম বিজয়গাথা হিসেবে। মুসলিম গৌরবের ইতিহাস লিখতে আগ্রহীরা একে দেখেছেন সরলরৈখিক যুদ্ধজয় ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হিসেবে। পাকিস্তানের পাঠ্যবইয়ে আছে প্রথম পাকিস্তানি ছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। রাজা দাহিরের নির্মম শাসন থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম শুধু বন্দি মুসলিমদের নয় বরং পুরো সিন্ধের জনগণকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এর বিপরীতে ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশ হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঘরানা চাচনামাকে ব্যবহার করেছে ভারতবর্ষে মুসলমানদের বহিরাগত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। একই সঙ্গে নিপীড়ক শাসক হিসেবে তাদের সমালোচনাও ছিল।

মানুষের মেটামরফোসিসের মতো গ্রন্থ হিসেবে চাচনামারও রূপান্তর হয়েছে। রাজনীতির ময়দানে যেমন ইতিহাস জীবিত হয়, তেমন জীবিত থাকে ইতিহাস গ্রন্থও। তেমনটা হয়েছে চাচনামার ক্ষেত্রে। আধুনিক সময়ের ঐতিহাসিক রাজনীতির ময়দানে আবির্ভাবের আগে চাচনামার জীবন বিভিন্ন কালপর্বে নানা আঙ্গিকে প্রাধান্য পেয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চাচনামা পরিচিত ছিল সিন্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস হিসেবে। এটি ছিল সিন্ধের মানুষের জীবনের গল্প। চতুর্দশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে সিন্ধে রচিত ইতিহাস গ্রন্থে বারবার চাচনামার রেফারেন্স উঠে এসেছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক মানান আহামেদ আসিফ শতকে চাচনামা নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন। তার গবেষণা নিয়ে প্রকাশ করেছেন বুক অব কনকোয়েস্ট: দ্য চাচনামা অ্যান্ড মুসলিম অরিজিনস ইন সাউথ এশিয়া গ্রন্থ। মানান চাচনামাকে খোরাসানের আবুল ফজল বেহাকি রচিত গজনভী সুলতানদের ইতিহাসের মতো আঞ্চলিক ইতিহাস হিসেবে দেখতে চান। প্রসঙ্গে মানানের তর্কটি মনোযোগের দাবি রাখে। তিনি দেখিয়েছেন সে সময় আরবি ইতিহাসতত্ত্বে রচিত ইতিহাস গ্রন্থগুলো ছিল মূলত বৈশ্বিক ইতিহাস রচনার আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ। সেগুলো শুরু হতো হজরত আদমের (.) কাহিনী থেকে, এরপর ধীরে ধীরে বছর বছর ধরে অনেক শাসকের শাসন পেরিয়ে রচনার সমকালে পৌঁছত। এগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল ভৌগোলিক। কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের ইতিহাস শুরু হতো সেখানে মুসলিমদের আগমনের মাধ্যমে। চাচনামা ভৌগোলিক কালিক প্রেক্ষাপটে সে সময়ে আরবি ইতিহাসতত্ত্বের ধারা থেকে ভিন্ন। কালকে ধ্রুবক ধরে তাতে কোনো শাসনামলকে বৈশ্বিক ইতিহাসে স্থাপন করার কোনো লক্ষণ চাচনামা কিংবা বেহাকি রচিত ইতিহাসে নেই। চাচনামায় মূলত দুই প্রজন্মের শাসকদের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে এবং সেটি সিন্ধের ভৌগোলিক সীমানাতেই। গ্রন্থের শিরোনামের বিষয়টি স্পষ্ট প্রকাশ হয়েছে। মানান বলছেন চাচনামার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই চাচনামা দিল্লিতে অবহেলিত ছিল। দিল্লির দরবারে ইতিহাসবিদরা মূলত ব্যস্ত ছিলেন বৈশ্বিক ইতিহাস কাঠামো অনুসরণে ইতিহাস রচনায়। তাই ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে পরবর্তী সময়ে দিল্লিতে রচিত ইতিহাসে চাচনামার তেমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। ঘটনাটি আজকের প্রেক্ষাপটে মনোযোগ দেয়া জরুরি। যে চাচনামা এখন ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের সূচনা বিন্দুর সাক্ষী, সেটা মধ্যযুগে খোদ মুসলিম বাদশাহীতে তেমন পাত্তা পায়নি। বিষয়টি এমন ছিল না যে তারা চাচনামা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। বরং ইনশা- মাহরু থেকে ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে চাচনামার উল্লেখ পাওয়া যায়। বতুতা ১৩৪১ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধের উচ সফর করেছিলেন। দিল্লির মুসলিম সাম্রাজ্যে চাচনামাকে তাদের নামের সঙ্গে জায়গা দিতে রাজি ছিলেন না ইতিহাসবিদরা। আবুল ফজলের রচিত আকবরনামায় ভারতে ইসলামের ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। তার ইতিহাসে চাচনামার জায়গা হয়নি।

তবে আকবরের দরবারের এমন অনেক অভিজাত ছিলেন, যারা চাচনামা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। এমন একজন ছিলেন মির মুহাম্মদ মাসুম (১৫৩৭-১৬১০) ১৫৯২ সালে আকবরের সিন্ধ অভিযানে তিনি সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে আকবর মাসুমকে সিন্ধের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এই মাসুম ১৬০০ সালে সিন্ধে ইতিহাস নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম তারিখ--মাসুমি। তিনি সিন্ধের মানুষ রাজনীতির ইতিহাস লিখতে চেয়েছিলেন। তার গ্রন্থ শুরু করেন চাচনামার সারাংশ উপস্থাপনের মাধ্যমে। বলা জরুরি, মাসুমের নিজ গ্রন্থের উদ্দেশ্য ছিল কেবল সিন্ধের রাজনীতি নিয়েই আলোচনা করা এবং কাজে তিনি চাচনামাকে আকর হিসেবে ব্যবহার করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিন্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত মির আলী শের কানির তুহফৎ উল-করিমেও চাচনামাকে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তখনো চাচনামা আঞ্চলিক ইতিহাস হিসেবেই অস্তিত্বমান।

তারিখ--ফিরিশতার সূত্র ধরে ইউরোপীয়রা চাচনামার সন্ধান পায়। ১৮৪৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিন্ধ দখল করে। চূড়ান্ত যুদ্ধটি হয়েছিল উচ-এ। সিন্ধকে বুঝতে তারা চাচনামাকে ব্যবহার করেছিল। সামরিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা সিন্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসকেও জয় করে। সিন্ধে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ উসকিয়ে তাদের পার্থক্যগুলোকে হাজির করে তারা। নিজেদের তারা সিন্ধে মুসলিমদের হাতে নিপীড়িত হিন্দুদের মুক্তিদাতা হিসেবে উপস্থাপন করে। মানান আহমেদ আসিফ লিখেছেন, এটাই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন চাচনামা ভারতবর্ষে মুসলিম বিজয়ের ন্যারেটিভ হয়ে ওঠে। চাচনামাকে হিন্দুদের রাজ্য মুসলিমদের দখল করে নেয়ার ন্যারেটিভ হাজির করার মাধ্যমে ব্রিটিশরা তাদের সিন্ধ দখলের তাত্ত্বিক কাঠামোটি গড়ে নেয়। ইতিহাসতত্ত্ব জমিন যুগপৎ দখলের ক্ল্যাসিক্যাল উদাহরণ হয়ে রয়েছে ঘটনা। ব্রিটিশ পণ্ডিতরা চাচনামাকে খুঁড়ে হাজির করেছেন তাদের সিন্ধ বিজয়ের ন্যায্যতার তত্ত্ব। মানান আহমেদ আসিফ তার বুক অব কনকোয়েস্ট: দ্য চাচনামা অ্যান্ড মুসলিম অরিজিনস ইন সাউথ এশিয়া গ্রন্থে লিখেছেন, কোম্পানি (ইস্ট ইন্ডিয়া) তাদের সিন্ধ দখলকে মুসলিমদের সিন্ধ বিজয়ের ক্ষতিপূরণ হিসেবে চিত্রিত করেঅর্থাৎ ব্রিটিশদের সিন্ধ বিজয়ের মাধ্যমে স্থানীয় হিন্দুরা বিদেশী মুসলিম শাসকদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেয়েছে।

মানান আহমেদ আসিফ চাচনামা নিয়ে তার গবেষণার সমাপ্তি টেনেছেন এমন সিদ্ধান্তে যে এটি ফারসি ভাষায় রচিত ভারতীয় ঘরানার টেক্সট। বইতে আদতে যা স্থান পেয়েছে তা হলো ন্যায় শাসন, শাসন পরিচালনার তত্ত্ব তেরো শতাব্দীর মুসলিম রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য মিত্র তৈরি। সেকালের হিন্দু ব্রাহ্মণ মুসলিম অভিজাতদের মধ্যে সংলাপমূলক সম্পর্কেরও একটি স্মারক গ্রন্থ। সবশেষে তার মূল্যায়ন, টেক্সট আবিষ্কার করে ব্রিটিশরা এবং ভুলভাবে পড়ে ভুল অনুমানের মাধ্যমে ভারতে মুসলিম শাসনকে স্বৈরাচারী হিসেবে দেখানো তত্ত্ব গড়ে তোলে।

 

শানজিদ অর্ণব: লেখক অনুবাদক