সিল্করুট

মধ্যযুগে বাংলার চিনিকথন

শহিদুল হাসান

১৭৯০-এর দশকে ভারতে আখের খেত ও পাশেই চিনি তৈরির আয়োজন। শিল্পী: বালথাজার সলভিন (১৭৬০-১৮২৪)

নদীর উজানে যাওয়ার সময়ে প্রথম রাতটা কাটল একটা গাছের তলায়, কারণ থাকার মতো আর কোনো জায়গা ছিল না। এভাবে আমরা পরবর্তী টি দিন কাটালাম নদীর দুই দিকে ছোট ছোট গ্রামে। এখানে অনেক আখ চাষ হয়, তা থেকে খুব সুন্দর চিনি উত্পন্ন হয়। তার দাম কম।

বক্তব্যটি ষোলো শতকের বাংলার সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের দরবারে আসা পর্তুগিজ রাজপ্রতিনিধি দলের জনৈক নাম না জানা সদস্যের বর্ণনার কিয়দংশ। পর্তুগিজ ভাষায় লেখা বিবরণটি বাংলা ভাষ্য থেকে নেয়া। উদ্ধৃতাংশের শেষ বক্তব্যটি বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। উত্কৃষ্ট মানের চিনি অল্প দামে পাওয়ার আশায় টাইম মেশিনে চড়ে ৪০০ বছর আগে ফিরে যাওয়ার কোনো সূত্র এখন আমাদের হাতে নেই। তাই সমকালীন প্রমাণাদির আলোকে মধ্যপর্বের বাংলায় চিনি উৎপাদন তত্সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল, কারিগর শ্রেণী মূল্যমানবিষয়ক কিছু তথ্যাদি পাঠকের নজরে এনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যেতে পারে। ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী কালপর্বে আসা বিদেশীদের বর্ণনায় উঠে আসা তথ্যাদির পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যকে ভর করে রচনার কাঠামো বিনির্মাণ করা হবে। প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদ মমতাজুর রহমান তরফদার, এমএ রহিম সৈয়দ এজাজ হোসেনের গবেষণাকর্মের প্রতি ঋণ স্বীকার না করলে পাঠকের সঙ্গে অন্যায় করার অপরাধ এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। (আগ্রহী পাঠকের সুবিধার্থে ব্যবহূত গবেষণাগুলোর তালিকা লেখার শেষে সংযুক্ত করা হলো)

লেখার শুরুতেই উপস্থাপিত দৃশ্যপটটির স্থানিক পরিচয় দেয়া আবশ্যক। ১৫১৯ সালে তিনটি সরকারি জাহাজে পর্তুগিজ রাজদরবারের প্রতিনিধি দল বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। কিছুদিন অবস্থান করার পর দলটি ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্র উপকূল ধরে রাজধানী গৌড়ের উদ্দেশে রওনা করে। দলটি মিয়ামগড় নামক একটি দ্বীপের কাছাকাছি নদীর দুই তীরের গ্রামগুলোয় অবারিত আখের খেত দেখেছিল। এটি মেঘনার উপকূলবর্তী কোনো এলাকা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উল্লেখ্য, দলটিই চট্টগ্রাম থেকে লিগ ( লিগ= নটিক্যাল মাইল) দূরে আলুইয়া দ্বীপেও ধান চাষের পাশাপাশি আখ চাষের জমি দেখেছে।

ষোলো শতকের দ্বিতীয় দশকে দুয়ার্তো বারবোসা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। পর্তুগিজ ব্যবসায়ী পূর্ব ভারতের সমুদ্র উপকূল ধরে ওতিসা বা ওডিশা  দেশ থেকে সমুদ্রতট ধরে বেঙ্গালা রাজ্যে পৌঁছান। বারবোসার বর্ণনার সুখময় মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদকৃত কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো:

রাজ্যের ভেতর দিকে সমুদ্রতটে অনেক শহর আছে। ভেতরের শহরগুলোয় পৌত্তলিকরা বাস করে। তারা বাংলার রাজার প্রজা, তিনি (বাংলার রাজা) একজন মুর (মুসলমান) সামুদ্রিক বন্দরগুলোয় মুর পৌত্তলিকরা বাস করে। তারা বহু জিনিসপত্রের ব্যবসা করে। এর অভ্যন্তরে প্রত্যন্ত দেশে একটি বিরাট শহর আছে। তার নাম বেঙ্গালা শহরে (বেঙ্গালায়) খুব ভালো জাতের সাদা চিনি তৈরি হয়, কিন্তু (সাদা) চিনি দিয়ে কী করে পাউরুটি তৈরি করতে হয়, তা এরা জানে না। তাই এরা তাকে গুঁড়া করে ভালোভাবে সেলাই করে, কাঁচা পশুচর্মে ঢাকা কাপড়ে প্যাক করে। তারা দিয়ে বহু জাহাজ বোঝাই করে এবং সব দেশে বিক্রির জন্য রফতানি করে। (পৃষ্ঠা ৬২৯-৩০)

বাংলা থেকে রফতানি পণ্য হিসেবে চিনির স্থান সুবিদিত। মমতাজুর রহমান তরফদার সৈয়দ এজাজ হোসেনের গবেষণায় বাণিজ্য পণ্যের তালিকায় চিনির স্থান হলো দ্বিতীয়; প্রথমটি ছিল সুতিবস্ত্র। চৈনিক কূটনীতিবিদ কাম দোভাষী মাহুয়ানের বরাত দিয়ে বাংলায় উৎপাদিত তিন রকম চিনির উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদ মমতাজুর রহমান তরফদার। মাহুয়ানের দেখা চিনিগুলো হলো () কণা সমষ্টির আকারে তৈরি চিনি বা গুড়, () সাদা চিনি () দানা বাঁধা চিনি বা মিসরি। রফতনি পণ্যের তালিকায় শীর্ষ অবস্থান স্পষ্টতই ইঙ্গিত করছে বাংলায় উৎপাদিত পণ্যের আন্তর্জাতিক মান চাহিদা সমকালীন বাণিজ্যবলয়ে সুখ্যাত ছিল। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পরই কি উদ্বৃত্ত চিনি বহির্বিশ্বে রফতানি হতো? অর্থনীতির সূত্রে ফেলে সেটি অনুমান করা যায়। কিন্তু সমকালীন সূত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো নজরটান সম্পর্কে পাওয়া যায় না।

ইক্ষু রস থেকে চিনি উৎপাদনের প্রযুক্তির উল্লেখ আদিপর্বের লেখনীতেই পাওয়া যায়। কবি বিদ্যাকর সংকলিত বাচস্পতির একটি সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়েছে, হাতে ঘুরানো চাপ যন্ত্রের সাহায্যে পুন্ড্রবর্ধনে আখের রস বের করা হতো। জাপানি ইতিহাসবিদ তুগিতাকা সাতো Sugar in the Social Life of Medieval Islam গ্রন্থে অস্কার ভন লিপম্যানের গবেষণার সূত্র ধরে মন্তব্য করেন, sugar cane production clearly originated from Northeast India, especially from Bengal province. (পৃষ্ঠা ১৫) চিনি উৎপাদনের কাঁচামাল ছিল আখ। বাংলার উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া ছিল আখ উৎপাদনের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র। ফলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় আখ চাষ হয়েছে। বক্তব্যের সমর্থন-চিত্র পাওয়া যায় সদুক্তিকণামৃত কাব্যসংকলনের নিম্নোক্ত শ্লোকে:

শালিচ্ছেদ-সমৃদ্ধ হালিকাগৃহাঃ সংসৃষ্ট-নীলোত্পল-

স্নিগ্ধ-শ্যাম-যব-প্ররোহ-নিবিড়ব্যাদীর্ঘ -সীমোদেরাঃ।

মোদন্তে পরিবৃত্ত - ধেন্বনড়ুহচ্ছাগাঃ পলালৈর্নটবঃ

সংসক্ত - ধ্বনদিক্ষুযন্ত্রমুখরা গ্রাম্য গুড়ামোদিনঃ।।

বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব গ্রন্থে নীহাররঞ্জন রায় শ্লোকটির গদ্যরূপ সাজিয়েছিলেন নিম্নোক্ত শব্দজালে:

কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধান্যে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে [আঁটি আঁটি কাটা ধান আঙিনায় স্তুপীকৃত হইয়াছে ...]; গ্রাম সীমান্তের ক্ষেত্রে যে প্রচুর যব হইয়াছে তাহার শীষ নীলোত্পলের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম; গোরু, বলদ ছাগগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নূতন খড় পাইয়া আনন্দিত; অবিরত ইক্ষুযন্ত্র ধ্বনি মুখর [আখ মাড়াই কলের শব্দে মুখরিত] গ্রামগুলি [নতুন ইক্ষু] গুড়ের গন্ধে আমোদিত। (পৃষ্ঠা ১০৫)

বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে চিনি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত কারিগর শ্রেণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি খেজুরের রস থেকে চিনি উৎপাদনে দক্ষ কারিগর গোষ্ঠীকে শিউলী জাতির অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া মোদক শ্রেণীভুক্ত জনগোষ্ঠী ছিলেন ইক্ষু চাষ চিনি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বহির্বাণিজ্য পণ্য হিসেবে চিনির মূল্য কেমন ছিল? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মমতাজুর রহমান তরফদার হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ একটি সামাজিক রাজনৈতিক পর্যেষণা গ্রন্থে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ব্যবসায়ী দুয়ার্তো বারবোসার দেয়া তথ্যের বিশ্লেষণ করেছেন। তরফদারের মতে, এক কুইন্টাল (বর্তমান ওজন ১২৮ পাউন্ড) চিনির মূল্য ছিল হাজার ৩০০ রি; যার বর্তমান মূল্য প্রায় পাউন্ড শিলিং। মূল্যমান ছিল মালাবারের বাজারে বিক্রীত বাংলার চিনির মূল্য। তরফদারের অনুমান, সম্ভবত বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনি আরো কম দামে বিক্রিত হতো (পৃষ্ঠা ১২২-২৩) বাংলার কারিগরদের প্রযুক্তি দক্ষতায় উত্কর্ষের কারণেই কণার আকৃতিতে গুড়ের দানা তৈরি, শুভ্র চিনির কণা উৎপাদন স্ফটিকীকরণ সম্ভব হয়েছিল। ফলে স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি বাংলার চিনি স্থান দখল করে নিয়েছিল মালাবার উপকূলের বাণিজ্যবলয়ে।

বাংলার উৎপাদিত পণ্য ফসলের তালিকা প্রদান করতে গিয়ে ইতালীয় পর্যটক ভারথেমা বলেন, দেশে শস্য, সব রকমের মাংস, চিনি, আদা এবং তুলা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। (সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৫৭৬, পৃ ৬২৮) প্রাচুর্যই মধ্যযুগে পূর্ব পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোয় নানা রকমের পণ্য রফতানির প্রক্রিয়াকে গতিশীল করেছিল। এমনকি ১৭৫৬ সালেও শতকরা ৫০ ভাগ হারে সুবা বাংলা থেকে ৫০ হাজার মণ চিনি রফতানি করা হয়েছিল। বাংলার চিনি শিল্পের রফতানি বাণিজ্য অবনতির জন্য দায়ী ছিল ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জাভায় প্রস্তুতকৃত চিনির ভারতে আমদানি কর্মকাণ্ড। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কাব্যে মিষ্টান্ন মিষ্টিজাত খাবারের উল্লেখ ইঙ্গিত করে যে বাঙালির খাদ্যতালিকায় চিনির স্থান ছিল সরব।

সময়ের পরিক্রমায় হাজারো হারানোর তালিকায় যুক্ত হয়েছে চিনি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। আদি মধ্যপর্বের বাংলার আখ আখজাত চিনি সুলভ পণ্যের তালিকাভুক্ত হলেও তা যেন আজ নাগালের বাইরে। ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়ের বিস্মৃতির সমুদ্র থেকে তুলে আনা তথ্যগুলো কেবলই আগামীর আশ্বাসের স্বপ্ন।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

. মমতাজুর রহমান তরফদার, হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ (মোকাদ্দেসুর রহমান অনূদিত), ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০১।

. সৈয়দ এজাজ হোসেন, শিল্প অর্থনীতি: সুলতানি বাংলা, আবদুল মমিন চৌধুরী সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস সুলতানি মোগল যুগ (আনু. ১২০০-১৮০০ সা. অব্দ), দ্বিতীয় খণ্ড সমাজ অর্থনীতি সংস্কৃতি, ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০২০, পৃষ্ঠা ১২৩-৩৮।

. মমতাজুর রহমান তরফদার, মধ্যযুগের বাংলার প্রযুক্তি সমাজ বিবর্তন, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩।

. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব, কলকাতা: দে পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ, ১৩৫৬, চতুর্থ সংস্করণ ১৪১১।

. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৫৭৬, ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, প্রথম প্রকাশ ২০০০, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৫।

. এমএ রহিম, বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস (মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত), প্রথম খণ্ড ১২০৩-১৫৭৬, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮২।

. Syed Ejaz Hussain, The Bengal Sultanate Politics, Economy and Coins (AD 1205-1576), Delhi: Manohar, 2003.

 

শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়