সিল্করুট

মিষ্টি চিনির তেতো কথা

মাসুদুজ্জামান

অ্যান্টিগুয়ায় বায়ুকলে আখ পেষাই হচ্ছে, ১৮২৩। সূত্র: ব্রিটিশ লাইব্রেরি

চিনি নেই তো উপনিবেশ নেই, উপনিবেশ নেই তো নৌবহর নেই, কথাগুলো ১৮৪১ সালে বলেছিলেন ফরাসি লেখক পল দব্রি। প্রায় ৪০০ বছর ধরে এটাই ঘটেছে। চিনি মানেই উপনিবেশ। চিনি মানেই দাসত্ব। চিনি মানেই পুঁজির সঞ্চয়। চিনি মানেই পরিবেশের বিপর্যয়। ষোলো শতকে ডাচ ব্রিটিশরা লক্ষ্যেই সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিল। সে অভিযানের লক্ষ্য ছিল, যেখানে যত সম্পদ আছে, কুক্ষিগত করো। যে মাটিতে সোনা ফলে, তাকে দখল করো। যারা ফসল ফলায়, তাদের নিয়ন্ত্রণ করে চাষাবাদে বাধ্য করো। এভাবেই এশিয়া, আফ্রিকা, আরববিশ্ব, ক্যারিবীয় অঞ্চল, লাতিন আমেরিকাসর্বত্র চিনির সাম্র্রাজ্য স্থাপন করেছিল পশ্চিমের বাণিজ্যপুঁজির আগ্রাসী ব্যবসায়ীরা। মসলা, বস্ত্র, চিনি ইত্যাদির মাধ্যমেই ঘটেছিল উপনিবেশের প্রতিষ্ঠা এবং পুঁজিবাদের উত্থান বিকাশ। চিনির সঙ্গে আরেকটু প্রসারিত করে যুক্ত করতে হবে গুড় মিসরি কথা। শুধু আখ অথবা ইক্ষু নয়, বিট চিনির কথাও বলা দরকার। কেননা এগুলো একই ধরনের পণ্য। কিন্তু চিনি ছাড়া কি এখন আমাদের জীবন চলতে পারে? উত্তরে বলব, না। চিনি ছাড়া আমাদের জীবন অচল। বাজারে যেসব প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য পাওয়া যায় সেসব খাবার কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি, সে তালিকাটা পড়লেই বোঝা যাবে কত কত খাবারে চিনির ব্যবহার ঘটছে।

সুকুমার রায়ের একটা বিখ্যাত ছড়ার শেষ দুটো পঙিক্তর কথা আমরা কেউ ভুলিনি: এটা ভালো, ওটা ভালো বলার পর তিনি লিখছেন—‘কিন্তু সবার চাইতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুড়। রবীন্দ্রনাথ মেঘ রৌদ্র গল্পে লিখছেন—‘গ্রামের মধ্যে আর সকলেই দলাদলি, চক্রান্ত, ইক্ষুর চাষ, মিথ্যা মকদ্দমা এবং পাটের কারবার লইয়া থাকিত, ভাবের আলোচনা এবং সাহিত্যচর্চা করিত কেবল শশিভূষণ এবং গিরিবালা। দুটি উদ্ধৃতির একটিতে গুড়, আরেকটিতে ইক্ষু কথা আছে। ইক্ষু বা আখের চাষের জন্য বঙ্গদেশ ভারতবর্ষের বেশ খ্যাতি ছিল। সুকুমার রায়ের লেখায় শিশুতোষ ভাবনাই প্রকাশ পেয়েছে। এতে চিন্তার কোনো জটিলতা নেই, আছে সারল্য আর মুগ্ধতা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখায় সামাজিক অস্থিরতার একটা ছবি পাওয়া যায়। যে অস্থিরতার সঙ্গে যোগ আছে ঔপনিবেশিক রাজনীতির। ইক্ষু, চিনি, গুড়, মিসরিএসবের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক মাত্রা আরো গভীর। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সভ্যতার বিকাশ, সামাজিক বিন্যাস, সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা আর মানুষের সামগ্রিক ইতিহাস।

শ্রেণী বিভাগ অনুসারে চিনিজাতীয় খাবারটি তিন ভাগে বিভক্ত: সাদা, হলুদাভ কালো। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর পর কোনো এক সময়ে উত্তর ভারতে প্রথম আখ চাষের সূচনা হয় আর তা থেকেই উৎপাদিত হয় গুড়। আর ৫০০ বছরে তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে খুবই লাভজনক লোভনীয় সর্বজনীন বাণিজ্যিক খাদ্যপণ্য। কীভাবে এটি রকম একটি বিশ্বপণ্য হয়ে উঠল, তার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ইতিহাস দাসত্বের ইতিহাস, প্রযুক্তির ইতিহাস। যেসব দেশে চিনি উৎপাদন হতো, সেসব দেশের অভিজাত শ্রেণীর উত্থান বিকাশের পেছনেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে চিনি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। সেটা পরে ঘটেছে। চিনির উৎপাদন ভোগের রূপও নানা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পেয়েছে। বিচিত্র ব্যবহার ঘটেছে এর। যেহেতু এটি খাদ্যপণ্য, ফলে এর সঙ্গে পুষ্টি স্বাস্থ্যগত দিকটিও জড়িত ছিল। সমগ্র পৃথিবীতে চিনির অভিঘাত নানা দিক থেকে তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। রকম সঞ্চরণশীল পণ্য মানব ইতিহাসে খুব বেশি দেখা যায়নি। চিনির মিষ্টত্বে মজেনি রকম একটি জনপদও খুঁজে পাওয়া যাবে না। লক্ষ-কোটি মানুষচাষী থেকে শুরু করে সামান্য ভোক্তাএর মাঝখানে কত শ্রেণী যে চিনির সঙ্গে যুক্ত ছিল, সে কথা বলে শেষ করা যাবে না।

চিনির সঞ্চরণশীলতার ইতিহাস ভীষণ চমকপ্রদ। এর উত্পত্তিস্থল ভারতবর্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে পাণিনি পতঞ্জলির রচনায় গুড় বা চিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। আলেকজান্ডারের এক সেনাধ্যক্ষ নেয়ারচুস সিন্ধু নদ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো এক ভারতীয় মৌমাছির সাহায্য ছাড়াই মধু (প্রকৃতপক্ষে রস) এনে দিয়েছিল বলে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি কথা আলেকজান্ডারকে জানিয়েছিলেন। ক্যারাভানে করে হিন্দুকুশ থেকে মধ্য এশিয়ার দিকে যেতে যেতে ক্লান্ত ব্যবসায়ীরা পথে আখচাষীদের অতিথি হয়ে এক টুকরো গুড় মুখে দিয়ে একটু জিরিয়ে আবার পথচলা শুরু করত।

তেরো শতকেই মার্কো পোলো দেখেছেন, বাণিজ্যিক কারণে বঙ্গে প্রচুর আখ চাষ হয়। দিল্লিতে আখের বড় বাজার বসত। আঠারো শতকে ফ্র্যান্সিস বুকানন জানাচ্ছেন, চিনির উৎপাদকরা নিজেদের পরিবারের মধ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়াটি গোপন রেখে বংশপরম্পরায় চিনি উৎপাদন করত। বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে তখনই চিনির বৈশ্বিক আবির্ভাব ঘটে। মার্কো পোলো চীন ভ্রমণ করে বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আখের বাজার ছিল চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে। দেড় হাজার বছর আগে চিনি পূর্ব দিকে ভারত থেকে যেমন চীন, জাভা, জাপানে গিয়েছিল, তেমনি পশ্চিমে যায় পারস্য, মিসর মেসোপটেমিয়ায়। এরপর আটলান্টিক পেরিয়ে পৌঁছে যায় দক্ষিণ আমেরিকায়।

মধ্য আঠারো শতকে পূর্ব এশিয়ার তাইওয়ান সবচেয়ে বেশি চিনি রফতানি করত। চীনা ডাচদের যৌথ উদ্যোগে জাভায় আখ উৎপাদন এবং চিনির বিশাল কেন্দ্র গড়ে ওঠে। গুজরাট বঙ্গ ছিল চিনি উৎপাদনের আরো দুটি বড় কেন্দ্র। বিপুল পরিমাণ চিনি ভারত থেকে আমেরিকা, ব্রিটেন, পারস্য আরবে যেত। ১৮২০ সালে একমাত্র কলকাতা বন্দর থেকেই ১২ হাজার ৮০০ টন কেপ টাউন অস্ট্রেলিয়ায় এবং ৭০০ টন গেছে ব্রিটেনে। বেশকিছু কোম্পানি তখন বিশ্বজুড়ে চিনির বাণিজ্য করত। অন্যদিকে কিউবা আমেরিকা ছিল চিনি উৎপাদনের বড় দুটি দেশ।

গুড় ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। মিসরিও বানাতে শিখেছিলেন চাষীরা। মিছরি প্রথম তৈরি হয় পারস্যে। সেটা পাঁচ শতকের কথা। ষষ্ঠ শতাব্দীতে চীন গুড় উৎপাদন শুরু করে। প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে সমগ্র এশিয়ায় আখ চাষ গুড় তৈরির প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে। এরও ২০০ বছর পর ইউরেশিয়ায় এটি বাণিজ্যপণ্য আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির অংশ হয়ে ওঠে। পরে কয়েক শতক ধরে তা পুবে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে। পুবে এটা গেছে একটু ধীরে, চীনের মিং কিং সাম্রাজ্য পেরিয়ে পৌঁছেছে জাপানের ওকিনাওয়ায়। কিন্তু পশ্চিমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়েছে দ্রুত। নবম-দশম শতাব্দীতে পৌঁছে গেছে ইরান, ইরাক, মিসর, জর্ডানে। সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে, পশ্চিম আফ্রিকা, আন্দালুসিয়া, ক্যারিবিয়া, ব্রাজিল, উত্তর আমেরিকা ইউরোপে।

দানাদার চিনির (গুড়) বয়স হাজার ৫০০ বছর। এর এক হাজার বছর পরে স্ফটিকস্বচ্ছ চিনি প্রস্তুত করতে পেরেছে মানুষ। প্রাচ্য পাশ্চাত্য সর্বত্রই চিনি ছিল বিলাসদ্রব্য, ক্ষমতা সম্পদের প্রতীক। প্রথম দিকে চিনির ভূমিকা খুব বেশি ছিল না। রাজকীয় অনুষ্ঠান উৎসবে এটি ব্যবহার হতো। মিসরি দিয়ে ভাস্কর্য তৈরির কথাও জানা যায়। ওষুধেও এর ব্যবহার ঘটত। ইউরোপে পৌঁছার আগে চিনির এই যে রাজকীয় ব্যবহার, সেটা দেখা গেছে চীন, ভারত, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকায়। তেরো শতকের মধ্যে চিনি তৈরির দক্ষতায় অনেক উন্নতি ঘটে। সমগ্র ইউরেশিয়ার বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়। এরই সূত্র ধরে চিনি সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে এশিয়াতেই। অঞ্চলেই ১৮৭০ দশক পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন হতো। প্রযুক্তির ব্যবহার চিনির মূল্য অনেক কমিয়ে দেয়। ৭০০ বছর ধরে পৃথিবীজুড়ে নতুন-পুরনো শত শত পণ্যে ক্রমেই এর ব্যাপক ব্যবহার ঘটেছে। চিনি এখন বেশকিছু খাবারের মধ্য দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন ডায়েটের অংশ। ইউরোপীয়রাই একে বৈশ্বিকভাবে উৎপাদিত বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করে। কিন্তু ইউরোপে ইক্ষু উৎপাদন হয় না। সেখানে চিনি উৎপাদন শুরু হয় বিট উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। ইউরোপ তার চাহিদা মেটাত আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত চিনি দিয়ে। আমেরিকায় তো চিনি উৎপাদন হতোই। বিশ্বজুড়ে চিনির ব্যাপক চাহিদাই বিশ্বসভ্যতায় কলঙ্কজনক নির্মম ট্র্যাজেডির জন্ম দেয়। সেটা হলো আফ্রিকা থেকে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষকে জাহাজে করে দাস হিসেবে উত্তর দক্ষিণ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। আখ উৎপাদনের সূত্রে দাস ব্যবসা এক ধরনের ব্যবসায় পরিণত হয়। কার্ল মার্ক্স যখন ১৮৬০ দশকের শেষ দিকে তার পুঁজি বইটি লিখছিলেন, তখন দাসদের দ্বারা উৎপাদিত চিনির অর্ধেকই ভোগ করছিল অথবা খেয়ে ফেলছিল ইউরোপ উত্তর আমেরিকার শিল্প-কারখানাগুলোয় কাজ করা প্রোলেতারিয়েতরাই। ইতিহাসের কী নির্মম কূটাভাস!

আবিষ্কারের শুরু থেকেই গুড় বা চিনি হয়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যবিশেষ। খাদ্য হিসেবে চিনি ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। চিনির সঙ্গে যুক্ত ছিল নানা শ্রেণীর মানুষ। বয়স, লিঙ্গ, শ্রেণী-অবস্থান, সংস্কৃতি, এমনকি পেশার দিক থেকে বিচিত্র ধরনের মানুষ চিনির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। চিনির এই যে নৃতত্ত্ব, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের শরীর সংস্কৃতি দুই-ই। চিনির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেকারা কীভাবে চিনি বা গুড় উৎপাদন করেছে, সরবরাহ ব্যবস্থার ধরন কেমন ছিল, কোন খাবারে এর ব্যবহার ছিল, কারা ব্যবসাটা করেছে, কোন এলাকা বা উপনিবেশে চাষাবাদ হতো, কারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, প্রযুক্তির ব্যবহার কেমন ঘটেছে, মালিক চাষীদের সম্পর্ক কেমন ছিল ইত্যাকার নানা বিষয়। তবে ইক্ষু চাষ খুব সহজ নয়। অনেক শ্রম দিয়ে আখের চাষ করতে হয়। চিনি যখন বাণিজ্যের অংশ হয়ে ওঠে, তখন প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কীভাবে অধিক পরিমাণে আখ চিনি উৎপাদন করা যায়, সেদিকে উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা গুরুত্ব দিয়েছিল। চিনির উৎপাদন বাণিজ্য নিয়ে বিশ্বজুড়েই ছিল প্রতিযোগিতা। উপনিবেশের জমি মানুষকে ব্যবহার করা হতো বলে এর রাজনৈতিক মাত্রাটিও ছিল গভীর। ১৮৪০ দশকের পর পরিবহন প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে চিনি মূলত বৈশ্বিক পণ্য হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গে জাপানের একজন উদ্যোক্তার অভাবনীয় সাফল্যের কথা বলি।

১৮৮৪ সাল। জাপানের হোক্কাইদোতে স্ফটিকস্বচ্ছ চিনি উৎপাদনে জার্মানির প্রযুক্তিবিদরা কারখানা স্থাপন করে সাহায্য করতে চাইছে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এদিকে জাপানের বাজারে চিনির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তোশিবুতো সুজুকি নামে একজন হকার রাস্তায় বসে ক্যান্ডি-চকোলেট বিক্রি করতেন। খুবই দরিদ্র ছিলেন সুজুকি আর লেখাপড়াও তেমন জানতেন না। একদিন কাগজের একজন হকারের কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে পড়তে গিয়ে তার চোখে পড়ে জাপানে জার্মানির স্বচ্ছ চিনি উৎপাদনের সহায়তার কথা। তার মাথায় এল, তিনিও চিনি উৎপাদন করবেন। কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গিয়ে সংগ্রহ করলেন চিনিসংক্রান্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা, নির্দেশিকা ইত্যাদি। কিন্তু তিনি তো লেখাপড়া তেমন জানেন না। সাহায্য নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরই। তাদের দিয়ে অনুবাদ করিয়ে বুঝতে চাইলেন কোন প্রক্রিয়ায় চিনি উৎপাদন হয় আর কীভাবে স্ফটিকস্বচ্ছ চিনি উৎপাদন করা যায়। বুদ্ধিটা ব্যবসায়িক, কিন্তু মানুষটি মাত্র কয়েক বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সালে তৈরি করালেন তার প্রথম চিনি পরিশোধিত মেশিন। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন নিহোন চিনি পরিশোধন কোম্পানি। চীন গ্রিসের বৃহৎ পরিশোধন কোম্পানির সঙ্গে মিলে তিনি প্রবেশ করলেন জাভার চিনি সাম্রাজ্যে। প্রথমে একটি বড় কারখানা এবং পরে ১৯২০ সালের মধ্যে পাঁচটি বড় কারখানার মালিক হলেন তিনি।

শিল্পবিপ্লব চিনি উৎপাদনের সনাতন ধারাটাকেই এভাবে পুরোপুরি বদলে দেয়। চিনি যাতে গণমানুষের কাছে পৌঁছে যায়, শুরু থেকেই সে চেষ্টা ছিল। কিন্তু এটা সফল হয় শিল্পবিপ্লবের পর। পরিবহন বিপ্লব, বিশেষ করে ট্রেনের পরিবহন ব্যবস্থা চিনি উৎপাদনে সহায়তা করে।

মধ্য উনিশ শতকে চিনিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে প্রভাবশালী দামি রফতানি পণ্য, এখন যেমন হয়ে উঠেছে তেল। পার্থক্য ছিল একটাই, প্রায় প্রতিটি দেশই আখ-চিনি উৎপাদন করতে পারত, তেলের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন ক্যারিবিয়া থেকে ইউরোপে চিনি আসার পথ রুদ্ধ করে দেয়, তখন বিকল্প হিসেবে বিট চিনি উৎপাদনে যায় ইউরোপ। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্রের যৌথ ব্যবস্থাপনায় চিনির দাম কমে যায়। শাপে বর হিসেবে ব্যাপকভাবে শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যপণ্য পানীয়তে শুরু হয় চিনির ব্যবহার। চিনির ইতিহাসই বলে দেয় কীভাবে আধুনিককালে ভোগ্যপণ্যের মধ্য দিয়ে আমাদের ভোগের প্রবণতাটি গড়ে উঠেছে। কীভাবে বৈশ্বিক বৈষম্য দেখা দিয়েছে। গড়ে উঠেছে আধুনিক পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ আসলে দ্বিমুখীএকদিকে বস্তুগত বিপুল অগ্রগতি ঘটেছে, অন্যদিকে দেখা দিয়েছে অবর্ণনীয় সামাজিক দুর্দশা, অস্বাস্থ্যকর নিয়ন্ত্রণহীন ভোগবাদিতা আর পরিবেশ বিপর্যয়।

রাজনৈতিক দিক থেকেও চিনি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়। বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ স্থাপনে চিনি প্রধান ভূমিকা পালন করে। গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিক চিনিকেন্দ্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী। চিনি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের তারা নির্মমভাবে ব্যবহার করেছে, শোষণ করেছে। চিনি সাম্রাজ্যের রকম কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী হলো মিসরের কারিমিরা, সাইপ্রাসের ভেনেসীয় পরিবার, বার্বাডোজের লেসেলেরা, আমেরিকার হ্যাভমেয়ার ফানজুলরা এবং ভারতের বিরলা পরিবার। চিনি সাম্রাজ্যের ইতিহাসটি দুই হাজার বছরের পুরনো। সময়ের পরিক্রমায় মানুষ শিখেছে চিনি উৎপাদনের শৈল্পিক কলাকৌশল। রসায়নবিদ্যা থেকে শিল্পবিদ্যা বাণিজ্যকৌশল রপ্ত করেছে। ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ আমেরিকার চিনি উৎপাদনকে ঘিরে দাসত্বের নির্মম এক অধ্যায়ের শুরু। উনিশ শতকের শেষ দিকে চিনিকে কেন্দ্র করে জাতীয় পরিচয় নির্মিত হতে থাকে। কিউবা তখন স্পেনের উপনিবেশ। কিউবার চিনি উৎপাদকরা স্পেনের শাসনকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। শুরু হয় যুদ্ধ (১৮৬৮-৭৮) রকম আরো দুবার কিউবা স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তৃতীয় চূড়ান্ত যুদ্ধে স্পেনের সঙ্গে যোগ দেয় আমেরিকা। ফলে যুদ্ধটি স্পেন-আমেরিকার বিরুদ্ধে কিউবার যুদ্ধে রূপ নেয়। জয়ী হয় কিউবার আখ উৎপাদনকারীরা।

লাতিন আমেরিকার নানা দেশে নানাভাবে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। চিনি শিল্পকে কেন্দ্র করে সমাজও নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ নারী দাসীরা শ্বেতাঙ্গদের যৌনদাসীতে পরিণত হয়। এতে আবির্ভাব ঘটে মিশ্রবর্ণের মানুষের। আমেরিকার চিনি সাম্রাজ্যে এটা স্বাভাবিক বলে গণ্য হতো। দাসরা একসময় বিদ্রোহ করে এবং দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু বর্ণবৈষম্যের অবসান সহজে ঘটেনি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে চিনি শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শ্রমিক মালিকদের মধ্যে নতুন সম্পর্কের সূচনা ঘটায়। শিল্প বাণিজ্যের বিষয়টি করপোরেটের হাতে চলে যায়। কোনো কোনো দেশে অবশ্য চিনির নিয়ন্ত্রণ সরকারই গ্রহণ করেছে, যেমন বাংলাদেশে ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু ভারতে বৃহৎ পুঁজিপতিরাই চিনি শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মিষ্টির মধুর মৌতাত নয়, তিক্ততারই স্বাদ পেয়েছে চিনি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক বা শ্রমদাসরা।

চিনি যতটা মিষ্টি, এর ইতিহাস ততটাই তেতো। তবু তিক্ততাকেই আস্বাদন করে চলেছে মানুষ। মানবসভ্যতার কাঠামোই অনেকখানি নির্মাণ করে দিয়েছে চিনি। সব মিলিয়ে শ্বেদ, অশ্রুরক্ত, অর্থ, ক্ষমতা, দাসত্ব, আধিপত্য, পুঁজি আর অমানবিকতার ইতিহাসই চিনির ইতিহাস।

 

মাসুদুজ্জামান: লেখক কবি