সিল্করুট

আভিজাত্যের প্রতীক ছিল যে পণ্য

নিজাম আশ শামস

পাঞ্জাবের কৃষকরা চিনি তৈরি করছেন। এভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষক পর্যায়ে শত শত বছর ধরে চিনি তৈরির ঐতিহ্য রয়েছে

স্বাস্থ্যসচেতনতার দোহাই দিয়ে অনেকেই এখন চিনি ত্যাগ করেছেন। শরীরে চিনির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে নিত্যনতুন গবেষণা দৃশ্যমান। বিশেষত উচ্চবিত্তরা চিনির প্রতি এক ধরনের অনীহা প্রকাশ করেন। খাবার মিষ্টি করতে তারা চিনির নানা বিকল্প ব্যবহার করেন। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষের কাছে চিনি এখনো আদরণীয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের দেশে চিনির দামও বেড়েছে। তথাপি তা এমন মহার্ঘ কিছু নয়। কিন্তু চিনির যাত্রাকালে চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। জেনে আশ্চর্য হবেন, একসময় স্বর্ণ দিয়ে চিনির দাম শোধ করতে হতো! আর সে সময় চিনি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বহু শতাব্দী ধরে সাদা দানাদার চিনি কেবল ধনী অভিজাতদের খাদ্যতালিকার শোভাবর্ধন করেছিল। এটি ছিল বিলাসপণ্য। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরাই কেবল তা কেনার সামর্থ্য রাখতেন। চীনের সম্রাট, ভারতের রাজা-মহারাজা, মিসরের খলিফা, পারস্যের দরবার এবং ইউরোপের শাসকদের সম্পদ ক্ষমতার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল চিনি। আমজনতার সঙ্গে এর কোনো পরিচয় ছিল না। তারা জানতই না চিনি কী বস্তু! চিনির কোনো প্রয়োজনও ছিল না তাদের। তারা মধু, আঠালো ভাত কিংবা বার্লির ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে আখ থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সাদা দানাদার চিনি তৈরি হয়। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আখ থেকে চিনি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কয়েক সপ্তাহ লাগত। এটি ছিল রীতিমতো শিল্প। অধিকাংশ মানুষ শিল্প সম্পর্কে অবগত ছিল না।

চিনি তৈরির প্রধান কাঁচামাল আখ। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে আখ জন্মাত। সেখান থেকে তা উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল পশ্চিমা বিশ্বে গিয়েছিল। আর চিনির যাত্রা হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে। প্রায় হাজার ৮০০ বছর আগে উত্তর ভারতে দানাদার চিনির উদ্ভব ঘটে। তবে অনেক গবেষক দানাদার চিনির উদ্ভব আরো আগে ঘটেছে বলে মনে করেন। এক্ষেত্রে তারা সংস্কৃত সাক্কারা শব্দটির দোহাই দেন। এর অর্থ দানাদার বস্তু। চিনি বোঝাতে শব্দটি ব্যবহূত হতো। গবেষকদের মতে, ৫০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তাই তখন থেকেই ভারতে দানাদার চিনি তৈরি শুরু হয়েছিল বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন। ভারতবর্ষের সঙ্গে সাসানীয় সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। ফলে দানাদার চিনি তৈরির জ্ঞান সম্পর্কে পারস্যবাসী অবগত হয়। সেখান থেকে জ্ঞান পশ্চিমে বিস্তৃতি লাভ করে। ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শুরুতে ভারতের চিনি চীনে প্রবেশ করে। তার ৮০০ বছর পর ভারতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা চীনা সম্রাটের দরবারে চিনি তৈরির প্রক্রিয়া শেখান। সেখান থেকে তা চীনের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো বাংলায় বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদনের রমরমা অবস্থা দেখেছিলেন। তেরো শতকের শেষের দিকে তিনি অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। ততদিনে সমগ্র উত্তর ভারতে ব্যাপক আকারে আখ চাষাবাদ শুরু হয়েছে। সে সময় দিল্লিতে একটি বড় চিনির বাজার ছিল। চৌদ্দ শতকের শেষার্ধে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে চিনি উৎপাদন আরো বেড়ে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তখন গবাদিপশুচালিত পেষণযন্ত্র প্রচলিত হয়েছিল। চিনির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি সুসংগঠিত শ্রমবাজার গড়ে উঠেছিল। কেউ আখ থেকে নিঃসৃত রস জ্বাল দিতেন, কেউবা পরিশোধনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রতিটি কাজের জন্য মজুরি নির্ধারিত ছিল। শোধনাগার থেকে বের হয়ে চিনি সারা ভারতে চলে যেত। তবে ভারতে সাদা দানাদার চিনি উৎপাদন মূলত অভিজাতদের দখলে ছিল। অন্তত স্কটিশ ভ্রমণকারী, চিকিৎসক উদ্ভিদবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস হ্যামিলটন বুকাননের সময় পর্যন্ত (১৭৬২-১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ) এটি সত্য ছিল। স্থানীয় শাসকদের চিনি তৈরির নিজস্ব কারিগর ছিল বলে তিনি জানান। এসব কারিগর গোপন রেসিপি অনুসারে চিনি তৈরি করতেন। বংশানুক্রমে বিদ্যা পিতা থেকে সন্তানে সঞ্চারিত হতো। তথাপি চিনি তৈরির কয়েকটি পদ্ধতি বুকানন জানতে পেরেছিলেন। একটি পদ্ধতিতে অপরিশোধিত চিনিকে পাতলা কাপড়ের থলেতে নিয়ে বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ করে গুড় আলাদা করা হতো। আরেকটি পদ্ধতিতে চিনির পিণ্ডকে মাটির পাত্রে রাখা হতো। পাত্রের তলায় অনেক ছিদ্র থাকত। চিনি থেকে গুড় আলাদা হয়ে এসব ছিদ্র দিয়ে নিচে পড়ে যেত। অনেক সময় পরিশোধনকারীরা চিনির পিণ্ডের ওপর শৈবাল রেখে দিতেন। শৈবাল থেকে পানি চুইয়ে পড়ত। চিনির দানার তুলনায় গুড় পানিতে অধিক দ্রবণীয়। ফলে তা পানিতে মিশে নিচে পড়ে যেত। মাটির পাত্রে জমা থাকত চিনির স্বচ্ছ দানা। প্রক্রিয়ায় অপরিশোধিত চিনির পিণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ সাদা দানাদার চিনিতে পরিণত হতো। শোধনাগারের মালিকরা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অপরিশোধিত চিনি সংগ্রহ করতেন। এসব প্রতিনিধি গ্রামাঞ্চলে যেতেন। জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা আখগুলো তারা যাচাই করতেন। তারপর আখচাষীদের তারা অগ্রিম টাকা দিয়ে আসতেন।

শুরুর দিকে ভারতীয় চিনির ব্যবসা প্রধানত স্থলপথে হতো। ভারত থেকে মধ্য এশিয়ার উদ্দেশে ক্যারাভান ছেড়ে যেত। আফগানিস্তান হয়ে হেরাত, কান্দাহার অথবা কাবুলে যেত তারা। এগুলো ছিল ভারত মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। সেখানে যাত্রাবিরতির পর ক্যারাভানগুলো উজবেকিস্তানে যেত। বুখারা সমরখন্দ হয়ে তারা তুর্কমেনিস্তানে যেত। এসব বণিকের বাণিজ্যপণ্যের অন্যতম ছিল চিনি। তাদের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় চিনির বিস্তৃতি ঘটেছিল। কালক্রমে আখের চাষ আরো বাড়ল। তখন সমুদ্রপথে চিনির বাণিজ্য শুরু হলো। স্থলপথে বাণিজ্যের তুলনায় এতে খরচ কম। স্বাভাবিকভাবেই বণিকরা সমুদ্রে তাদের বাণিজ্যতরী ভাসাতে শুরু করলেন। চিনি ততদিনে বাংলার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যপণ্যে পরিণত হয়েছে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় ৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সর্বত্র আখ জন্মাত। সতেরো শতকে মোগল রাজদরবারের চিকিৎসক ছিলেন বার্নিয়ার। আখের খেত দেখে নয়ন জুড়ানোর কথা তিনি স্বীকার করেছেন। বাংলায় অসংখ্য নদ-নদী। নদীপথে নৌকায় করে চিনি সমুদ্রগামী জাহাজে বোঝাই করা হতো। জাহাজে করে চিনি দক্ষিণে শ্রীলংকা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছত। সেখান থেকে ভারতের চিনি পারস্য এডেন উপসাগরীয় অঞ্চলে যেত।

ভারতে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের দূত ছিলেন অ্যাবে বার্থেলেমি। ঔপনিবেশিক আমলে পর্তুগিজদের একটি শহরের নাম ছিল বেসিন। এটি বর্তমান মুম্বাইয়ের নিকটবর্তী ছিল। বার্থেলেমির মতে, ভারতের সর্বোত্কৃষ্ট চিনি বেসিনে বিক্রি হতো। চিনি অত্যধিক মুনাফায় পারস্য আরবে রফতানি হতো।

ভারতের পাশাপাশি চীনেও আখ চাষ বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সালে চীনে গিয়েছিলেন। তিনি সে দেশে প্রচুর আখ দেখেছিলেন। চীনের আখ মিসরের আখের তুলনায় উন্নত বলে ইবনে বতুতা তার ভ্রমণকাহিনীতে উল্লেখ করেছেন।  মার্কো পোলোও চীনে আখ চাষাবাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন। চীনের ফুজিয়ান প্রদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ আখ উৎপাদনকারী অঞ্চল বলে তিনি দাবি করেছিলেন। সে সময় দেশটিতে চিনির ব্যবসা অত্যধিক প্রসার লাভ করেছিল। ফলে চাষের দিক দিয়ে আখ ধানকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সাং সাম্রাজ্যে (৯৬০-১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) রাজদরবার থেকে নাগরিকদের মাঝে চিনির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওষুধ, পেস্ট্রি পানীয় তৈরিতে চিনির ব্যবহার শুরু হয়। মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণের সময়ে দেশটির রান্নার বইগুলোয় চিনির উল্লেখ ছিল। নগরের সর্বত্র মিষ্টি বিক্রেতাদের দেখা যেত। পর্যায়ক্রমে চীনের গ্রামাঞ্চলেও চিনির ব্যবহার শুরু হয়। চিনি দিয়ে তৈরি খাদ্য পানীয় যেকোনো উৎসব-পার্বণের প্রধান আকর্ষণ ছিল। ফুজিয়ান থেকে চীনের সুগার ক্যান্ডি জাহাজে করে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সুমাত্রা, মালয় উপদ্বীপ জাপানে রফতানি হতো। মার্কো পোলোর চীনে পা রাখার ১০০ বছর আগেই বাণিজ্যের শুরু।

মিং সাম্রাজ্যের অধীনে ফুজিয়ানে চিনি উৎপাদন দ্রুত বেড়ে যায়। ভারতের মতো চীনেও ব্যবসায়ীরা গ্রামাঞ্চলে যেতেন। আখ উৎপাদনের জন্য চাষীদের তারা অগ্রিম টাকা দিতেন। আখ চাষের প্রসার চিনি উৎপাদনের উন্নত কৌশলের কারণে ফুজিয়ান দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বড় চিনি রফতানিকারক হয়ে ওঠে। চীনাদের মাধ্যমেই জাপান চিনির সঙ্গে পরিচিত হয়। সাত কিংবা আট শতকে ট্যাং সম্রাটদের রাষ্ট্রদূত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জাপানে চিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। সতেরো শতকের শুরুর দিকে জাপানে চিনির চাহিদা বাড়ে। তখন চীনের প্রায় ১০০টি জাহাজের বিশাল বহর জাপানে চিনি নিয়ে যেত। নাগাসাকি বন্দরে এসব জাহাজ প্রতি বছর তিন হাজার টন পর্যন্ত চিনি খালাস করত। তৎকালে কেবল নাগাসাকি বন্দরে চীনা জাহাজগুলো ভেড়ার অনুমতি ছিল।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে একসময় জাপান চিনি উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। নাগিরকদের মাঝে চিনির অত্যধিক ব্যবহার দেখে দেশটির শাসকগোষ্ঠী চিন্তিত হয়। তারা চিনির দেশজ উৎপাদনকে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে চিনি আমদানি সীমিত করে। আঠারো শতকের শুরুর দিকে তাইওয়ান জাপানের মধ্যবর্তী এক সারি দ্বীপ দখল করে নেয় জাপান। এসব দ্বীপের অধিবাসীদের চীনারা আখের চাষ শিখিয়েছিল। দ্বীপবাসীকে চিনি উৎপাদনে উৎসাহিত করেছিল জাপান। এসব দ্বীপ থেকে আখবীজ নিয়ে জাপানের দক্ষিণাঞ্চলের অধিকতর উষ্ণ দ্বীপগুলোয় রোপণ করা হয়েছিল। চিনি উৎপাদনকারী জাপানি দ্বীপগুলোর অন্যতম ছিল শিকোকু। চমৎকার দানাদার চিনি উৎপাদনের জন্য শিকোকু বিখ্যাত ছিল। দ্বীপে উৎপাদিত চিনি ওয়াসানবোন নামে পরিচিত ছিল। মিষ্টি মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য প্রস্তুত করতে চিনি ব্যবহূত হতো।

জাপান মূলত নিজেদের চাহিদা মেটাতে চিনি উৎপাদন করত। অন্যদিকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধারাবাহিকতায় ভারত চীনের চিনি পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ করে।

 

নিজাম আশ শামস: লেখক অনুবাদক