সিল্করুট

লুট কত পুরনো?

এস এম রশিদ


আরবের উদ, ইউরোপীয় ভায়োলিন, চীনা পিপা, ভারতীয় বীণা, ইন্দোনেশিয়ার রেবাব, পশ্চিম আফ্রিকার কোরাস কিংবা আমেরিকার ইলেকট্রিক গিটার ব্যাঞ্জোসবারই উদ্ভব লুট থেকে। সরলভাবে লুট এমন একটি বাদ্যযন্ত্র যার কয়েকটি তার আছে, সেগুলো সমতল সাউন্ডবোর্ডের ওপর দিয়ে মাথার দিকে একটি বাঁকা নেকের সঙ্গে যুক্ত থাকে। লুটের অস্তিত্ব দুনিয়ায় চার হাজার বছরের, সময়কালে দুনিয়ার নানা প্রান্তে লুটের অসংখ্য প্রকারভেদ তৈরি হয়েছে। কোথাও পরিবর্তন এসেছে তারের সংখ্যা, কোথাও সাউন্ডবোর্ড নেকের আকার-আকৃতিতে। তবে মূল সূত্রটি সবখানে একই রকম।

ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে যাত্রা করলে দেখা যায় সবচেয়ে পুরনো যে লুটটি আজ অবধি টিকে আছে সেটি তৈরি হয়েছিল মিসরে, খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯০ সালে। সিডার কাঠের একটি টুকরো থেকে এটি তৈরি করা হয়েছিল। এর সাউন্ডবোর্ড উপবৃত্তাকার, লম্বায় ৪৩ সেন্টিমিটার, প্রস্থে সাড়ে ১১ সেন্টিমিটার উচ্চতায় সেন্টিমিটার। এটি কোনো বড় পশুর চামড়া থেকে তৈরি হয়েছিল।

লুট অনেক পুরনো তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এই লুট আরো প্রাচীন কোনো বাদ্যযন্ত্রের উত্তরসূরি। গবেষকরা মনে করেন, ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে মেসোপটেমিয়ার অনেক সাংস্কৃতিক বিষয় মিসরের মানুষ গ্রহণ করতে শুরু করে। তার মধ্যে লুটও ছিল। আর্কিওমিউজিকোলজিস্টরা অবশ্য নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি মেসোপটেমিয়ায় কখন থেকে লুট ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তবে তারা একমত হয়েছেন যে সময়টা ২৩৩০-২২৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেকার ঘটনা। সে সময়ের একটি সিল পাওয়া গেছে যেখানে খোদাই করা আছে একটি পৌরাণিক দৃশ্য। এতে দেখা যায় কোনো একজন স্বর্গীয় সত্তা লুটসদৃশ একটি যন্ত্র বাজাচ্ছেন, তার এক হাত তারে অন্য হাতে যন্ত্রের নেক ধরা। আবার প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ান যুগের (১৫৯৫-৮৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একটি মাটির ট্যাবলেটে দেখা যায় একজন বাদক লম্বা নেকের লুট বাজাচ্ছেন। ফলকটি পাওয়া গেছে বাগদাদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট তেল ইসচালিতে। সে কালে লুটের তারের সংখ্যা ছিল তিন কি চার আর সেটা কাঠের প্লেকট্রাম দিয়ে বাজানো হতো।

রিচার্ড ডামব্রিল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব নিয়ার ইস্টার্ন আর্কিওমিউজিকোলজির সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি ওপরের খোদাই দৃশ্যটির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেযন্ত্রের গোল অংশটি একটা কুমড়ার খোল, এর ওপরে আছে চামড়া। হাত দিয়ে এটাকে ঢোলের মতো বাজানো যায়। এর সঙ্গে ব্রিজ, নেক যুক্ত করে দিলেই হয়ে যায় স্ট্রিং ইনস্ট্রুমেন্ট। ডামব্রিল প্রাচীন যন্ত্রটির যে ব্যাখ্যা করেছেন তাতে একে আধুনিক সময়ের ব্যাঞ্জোর মতো মনে হয়।

কার্ট স্যাচের তার দ্য হিস্ট্রি অব মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট গ্রন্থে লিখেছেন, খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার অব্দে মেসোপটেমিয়ায় লুটের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা যায়। একই গ্রন্থে আরো জানা যায়, অনেক গবেষক লুট আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে চান অ্যাসিরীয় সভ্যতাকে। আবার অনেকে দেন কাপ্পাডোসিয়ানদের, এমনকি মিসরীয়দের। মিসরের সম্ভাবনাকে কার্ট স্যাচ উড়িয়ে দিয়েছেন, কারণ গ্রিকরা যা কিছু নতুন, ভিন্ন ধরনের তার সবকিছুর উৎস হিসেবে ঘোষণা করত রোমান্টিক প্রাচীন মিসরকে। কার্টের মতে, অ্যাসিরীয়রা লুট গ্রহণ করেছিল কাপ্পাডোসিয়ানদের কাছ থেকে। অ্যাসিরীয়দের ধর্ম মন্দিরের কোনো অনুষ্ঠানে লুটের দেখা মেলে না। তাই মনে করা যায় এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, বিশেষত মেষপালকদের কাছে।

ভারতীয় গ্রিকদের মিলিত গান্ধারা যুগে ছোট লুটের দেখা মেলে। এটা প্রথম খ্রিস্টীয় শতাব্দীর ঘটনা। ছোট লুটে মূল শরীরের চেয়ে যন্ত্রের ঘাড় ছোট হয়। ছোট লুট প্রথম দেখা গেছে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের পারসিক নিদর্শনে।

আরব হয়ে ইউরোপে আবির্ভাবের পর লুট ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে সংগীতের নানা বিকাশের হাত ধরে। এর বেশির ভাগ হয়েছে তারের সংখ্যা দৈর্ঘ্য নিয়ে। মধ্যযুগে তার ছিল চারটি আর ব্যারোক যুগের শেষে এসে সংখ্যাটি হয় ১৩। মধ্যযুগের ইউরোপীয় লুট আর খুব বেশি টিকে নেই। কিন্তু সে সময়কার চিত্রকলা সাহিত্য থেকে সমসাময়িক লুটের বিবরণ পাওয়া যায়।

চতুর্দশ শতকে লুটের বিবরণ থেকে দেখা যায়, লুটের তার চারটি, যা প্লেকট্রাম দিয়ে বাজানো হতো। সাহিত্য ভিন্ন লুটের উল্লেখ থাকা সবচেয়ে পুরনো যে দলিলটি পাওয়া যায় সেটি ১৩৭২ সালের। শিক্ষকরা লুট বাজানো শিখিয়ে কত পারিশ্রমিক পাবেন তার চুক্তিপত্র। থেকে বোঝা যায় চতুর্দশ শতকের ইউরোপে লুট শেখানোর স্কুল ছিল।

কালে লুটের ভূমিকা ছিল ভোকাল মিউজিকের সহায়ক হওয়া। রেনেসাঁ আমলে পলিফোনির (একাধিক সুর) উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে লুটের তারের সংখ্যা বেড়ে হয় ছয়। সময় প্লেকট্রামের পরিবর্তে সরাসরি আঙুল ব্যবহার করে লুট বাজানো শুরু হয়।

ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ইউরোপের লুট তৈরির রাজধানী বলা হতো জার্মানির বাভারিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম ফুসেনকে। এখানে লুট তৈরির ওয়ার্কশপের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে সবার কার্যক্রম, মান মূল্য নজরদারি করতে লুট নির্মাতাদের গিল্ড তৈরি হয়। এই গিল্ড ফুসেন গ্রামে শুধু ২০টি কারখানার অনুমতি দেয়। আর ঘটনা লুটের ইতিহাসে বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ। নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর অনেক লুট নির্মাতা অন্যত্র চলে যায়। প্রথমে তারা বাভারিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর অনেকে ভেনিসে চলে যায়। কেউ যায় বোলোগনা পদুয়ায়। এই দুই শহর সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে লুট তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তবে উল্লেখ করা যেতে পারে আমল পর্যন্ত লুট তৈরির সব সেরা কারিগর ছিলেন বাভারিয়ার অধিবাসী বা তার পূর্বপুরুষ সেখান থেকে এসেছিলেন। সেকালে এলাকায় তৈরি লুটের একটি অনবদ্য নিদর্শন ছিল ১৫৯৬ সালে সিক্সটাস রশোলফের তৈরি করা। এটির শৈল্পিক উত্কর্ষ এখনো দৃশ্যমান হয়ে আছে। ভেনিস আফ্রিকার মধ্যে আমলে হাতির দাঁত, আবলুস কাঠসহ আরো কিছু মূল্যবান কাঠের বাণিজ্য গতি পায়। এগুলো সবই ছিল লুট তৈরির জন্য পছন্দের উপকরণ।

সপ্তদশ শতকের শেষভাগে ফ্রান্সে লুট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভোকাল মিউজিকের অংশ হিসেবে এবং দরবারে একক পরিবেশনায়। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দশকে লুট মিউজিক নতুন প্রাণ পায় জার্মান লুটবাদক কম্পোজার সিলভিয়াস লিওপোল্ড ওয়েইসের হাতে। ওয়েইসের ভাবনা থেকে আরো তার যুক্ত হয় লুটে, এবার তারের সংখ্যা হয় ১৩। ফলে অনেক পুরনো লুট সংস্কার করে নতুন দুনিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু লুটে যতই তার যুক্ত হতে থাকল ততই সেটা বাজানো সংরক্ষণ কঠিন হতে থাকে। স্বভাবতই লুটবাদকের সংখ্যা কমতে থাকে। অন্যদিকে ভায়োলিন কি-বোর্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ধীরে ধীরে রেনেসাঁর রানি লুট হারিয়ে যেতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে একসময় জার্মানিতে ছয় বা সাত তারের সরল চেহারার লুট ফিরে আসে। এটি ম্যানডোরা নামে জনপ্রিয় হয়।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ ছিল লুটের ক্ষয়ের কাল। নেক সরু করে অনেক পুরনো লুটকে গিটারে রূপান্তরিত করা হয়। উনিশ শতকের শুরুতেও ফ্রান্সে কিছু লুট তৈরি হতো। তারপর লুট-গিটার হাইব্রিড যন্ত্রটিও একসময় আবেদন হারায়। লুট কাল আর স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যায়।

গত শতকের শেষভাগে ইউরোপে আবার লুট চর্চা শুরু হয়েছে। তবে সেটা মূলত একাডেমিক চর্চা হিসেবে। আর ফুসেনের সেই জমজমাট লুট তৈরির ইন্ডাস্ট্রি এখন ক্ষুদ্র কুটির শিল্প হয়ে ইউরোপে টিকে আছে।

 

এস এম রশিদ: লেখক