সিল্করুট

চীনকে আবিষ্ট করেছিল যে যন্ত্রের সুর

আহমেদ দীন রুমি


যেহেতু আগের সুরটা রপ্ত করে ফেলেছে কনফুসিয়াস, উস্তাদ চাচ্ছিলেন নতুন সুর শেখাতে। কিন্তু একটার অর্থ না বুঝেই অন্য সুরে প্রবেশ করতে নারাজ শিষ্য। আর তার জন্য প্রয়োজন আরো চর্চার। উস্তাদ মেনে নিলেন আবদার। চিনটা তুলে নিয়ে বাজাতে থাকল কনফুসিয়াস। কিছুক্ষণ পর ফের নতুন সুরের প্রসঙ্গ তোলা হলো। কিন্তু এবারো আপত্তি শিষ্যের। সুরের বাইরের অর্থ পুরোপুরি বুঝলেও ভেতরের অর্থটা এখনো অধরা রয়ে গেছে। ফলে আরো কিছু সময় চর্চা করতে হবে। বাধা দিলেন না সংগীত প্রশিক্ষক। চেয়ে দেখলেন শুধু চিনের সুরে শিষ্যের বুঁদ হয়ে যাওয়া। নির্ধারিত সময় পর স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে ফের অপারগতা প্রকাশ করল শিষ্য। সুরের বাইরে ভেতরের অর্থ বুঝলেও তাতে নিহিত উদ্দেশ্যটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকল চর্চা। তারপর একসময় মাথা উঁচু করল কনফুসিয়াস। বন্ধ চোখ উন্মিলিত করে জানাল, সুরটায় সম্রাট ওয়েনকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। উস্তাদ অবাক হলেন। তিনি তার উস্তাদের কাছ থেকেও শুনেছিলেন, সুরটা সম্রাট ওয়েনের জন্য সৃষ্ট। আড়াই হাজার বছর পর এখনো প্রাচ্যের পুরোধা পুরুষ হিসেবে অক্ষত কনফুসিয়াসের (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নাম। সমান্তরালে বেঁচে আছে বাদ্যযন্ত্র চিনের সংস্কৃতি। চিনের সৌন্দর্য কেবল অনুকরণে না, নিহিত সুরের ভেতরের অর্থ অনুধাবনে।

চিনকে বলা হয় চাইনিজ লুট চীনে লুটের কাছাকাছি বা সমগোত্রীয় আরো কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র আছে। এরহু, পিপা, উয়েচিন ইত্যাদি। দুই তারবিশিষ্ট এরহু, চার তারবিশিষ্টি পিপা কিংবা উয়েচিনের সুর অনেক শ্রুতিমধুর। সেদিক থেকে চিনের সুর অতটা শ্রুতিমধুর না। কেউ চাইলে মাস খানেকের মধ্যে এরহু রপ্ত করতে পারে। পিপা শিখতে খুব জোর কয়েক মাস। কিন্তু চিন শিখতে পেরিয়ে যেতে পারে বছরের পর বছর। কাছাকাছি শ্রেণীর যন্ত্র। কিন্তু চিন যেন সংগীতকে ছাপিয়ে গিয়ে তৈরি করেছে স্বতন্ত্র বলয়। প্রতিষ্ঠা করেছে আধ্যাত্মিক দার্শনিক পাটাতন।

চিনের উদ্ভাবন চীনের পৌরাণিক যুগে। কিংবদন্তি পণ্ডিত শেননং, ফুশি হুয়াংদির মাধ্যমে প্রথম আবিষ্কৃত হয় বাদ্যযন্ত্রটি। যদিও ঐতিহাসিকভাবে চিনের নজির মেলে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১০৪৬ অব্দের শাং রাজবংশের সময়কালে। পরবর্তীকালে চৌ সাম্রাজ্যের (১০৪৬-২৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রাপ্ত নথিতে প্রায়ই চিনের প্রসঙ্গ এসেছে মোহনীয় সংগীত যন্ত্র হিসেবে। শাং আমলে চিনের সুর পবিত্র সংগীত আকারেই চর্চিত হতো। তবে চৌ আমলে যুক্ত হয় পার্থিব দ্যোতনা। অভিজাত মানুষরা ক্রমে মুগ্ধ হতে থাকে চিনের সুরে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে জাদুকরী শক্তির প্রভাব। এমন সময় আগমন করলেন পণ্ডিত কনফুসিয়াস। তার দার্শনিক প্রতিষ্ঠা যেন চিনকেই দার্শনিক পাটতন তৈরি করে দিল। প্রাচীন পুণ্যবান রাজাদের প্রিয় সংগীত যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকে যন্ত্রটি। হান আমল (২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-২২০ খ্রিস্টাব্দ) জুড়ে পৌরাণিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার প্রবণতা ছিল স্পষ্ট। যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা। সে অভিযাত্রায় চিন পরিগণিত হয় নিখুঁত পরিপূর্ণতার রূপক হিসেবে। চিন সম্পর্কে কিছু লেখাও পাওয়া যায়। পণ্ডিত ইয়াং সিয়ুংয়ের লেখা চিন-চিং-ইং, হুয়ান তানের লেখা চিন-তাও সা-য়ের লেখা চিন-সাও তাদের মধ্যে অন্যতম। দেখা মেলে পেশাদার চিনবাদকের। চিন চিনের সুরের ওপর লেখা হতে থাকে বই। চিন (২২১-২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) উত্তর ওয়েই (৩৮৬-৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ) আমলে চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রসারিত হতে থাকে। সে সঙ্গে বিস্তার লাভ করে নয়া-তাওবাদ। মহামতি লাওেস প্রচারিত তাওবাদের পুনর্জাগরণ চলছে। বাদ্যযন্ত্র চিন কিন্তু বিলুপ্ত হলো না। তবে অর্থের পরিবর্তন ঘটল ব্যাপকভাবে। পরিগণিত হলো ধ্যান দীর্ঘ জীবনের সহায়ক হিসেবে। চিনের সুর মানুষকে অপার্থিব জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। ঠিক সময়টাতে সি কাং রচনা করেন তার বিখ্যাত সৃষ্টি চিন-ফু। চিনের বিশেষত্ব গুণ কীর্তিত হয়েছে পঙিক্ততে পঙিক্ততে। খুব সম্ভবত চিন নিয়ে শ্রেষ্ঠ রচনা এটি। এভাবে একদিকে কনফুসীয় তাও মতবাদ দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের নীতিমালার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চিন তৈরি করে ফেলেছে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অবস্থান। সুই (৫৮১-৬১৮ খ্রিস্টাব্দ) তাং বংশের দুই দফা শাসনামলে (প্রথমে ৬১৮-৬৯০ খ্রিস্টাব্দ, দ্বিতীয় ৭০৫-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) সংগীত বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। আর সংগীত সংস্কৃতির বিস্তার মানেই চিনের বিস্তার। ফলে কেবল বাদ্যকার না, চিন প্রস্তুতকারকদের নামও পাওয়া যেতে থাকে গুরুত্বের সঙ্গে। সাধু-সন্ন্যাসীদের পাশাপাশি চিনের সুর মোহিত করতে থাকে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত। চিন বাজানোর জন্য দুটি রূপ। প্রথমটা একা নিভৃতে বসে আত্মিক অনুসন্ধান যাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবে। দ্বিতীয়ত নিকট পরিজনদের সামনে আসর জমিয়ে পরিবেশন। চিনের প্রথম দিকটার পাশাপাশি অপর দিকটা প্রাধান্য পেতে থাকে সং সাম্রাজ্যের সময় (৯৬০-১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) তখন চিন বাজানো হতো বড় পরিসরে। দরবারি মেজাজ নিয়ে। সময়টাতে হাজারো কবিতা গদ্য লিখিত হয়েছে কেবল চিনকে কেন্দ্র করে। পণ্ডিত চু চাং-ওয়েন তার বিখ্যাত গ্রন্থ চিন-শি রচনা করেন। ১২৭১ সালে চীনে প্রতিষ্ঠিত হয় উয়ান সাম্রাজ্য, যা টিকে ছিল ১৩৬৮ সাল পর্যন্ত। প্রায় একশ বছরের সময়কাল পৃষ্ঠপোষকতা লাভ বন্ধ হয় চিনের ওপর থেকে। জনগণের মাঝে চর্চিত হলেও দরবারে ক্ষীণ হতে থাকে প্রভাব। কবি সাহিত্যিকরা তখনো সরব। মিং সাম্রাজ্যে (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) চীনকে আবারো একত্র করা হয় ঐতিহ্য চেতনায়। প্রতিষ্ঠিত করা হয় পৌরাণিক পরিচয়। সংস্কৃতির অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে ফিরে আসে চিন চিনের সুর। চিনের শিক্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রসারিত করতে ছড়িয়ে দেয়া হয় বই লেখা। চলতে থাকে পদ্ধতিগত পর্যালোচনা তাত্ত্বিক পুনর্গঠন। সাংস্কৃতিক জয়জয়কার ছিল চারদিকে। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধরত দেশে কিছুটা ফিকে হতে থাকে চিন। চিং শাসনের সময় (১৬৩৬-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ) আধুনিকতার জয়যাত্রায় কিছুটা কমতে থাকে প্রভাব। তবে সেটাও হারাতে দেয়নি ঐতিহ্য। চিন তার শক্তি ফিরে পেয়েছে ক্রমে। বর্তমান সময় পর্যন্ত জারি রয়েছে প্রভাব। কনফুসীয়, তাও মহাযান বৌদ্ধ পণ্ডিতরা চিনের সুর ভালোবাসতেন। ফলে খুব সহজেই জনগণের ওপর সম্মোহন শক্তির মতো বিস্তার করে বাদ্যযন্ত্রটি।

ইতিহাসের প্রথম দিকে চিনগুলো ছিল বর্তমানের চেয়ে অনেক দিক দিয়েই আলাদা। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাওয়া চিনগুলো আকারে বেশ ছোট। তাদের দশটি তার। স্বাভাবিকভাবেই সুরের তৈরিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকত। পশ্চিম জিন সাম্রাজ্যের সময়েই (২৬৫-৩১৬ খ্রিস্টাব্দ) মূলত চিন বর্তমানের রূপ লাভ করে। পুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয় ভিন্ন ভিন্ন সাতটি তার। যন্ত্রটির পরিমাপ বছরের ৩৬৫ দিনের সঙ্গে ভারসম্যপূর্ণ করে তৈরি করা হয়। মূল তার পাঁচটি যেন চীনা দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ মূল উপাদানের প্রতিনিধিত্ব করে। উপাদানগুলো জিন (ধাতু), মু (কাঠ), শুই (পানি), হুও (আগুন) তু (মাটি) চীনা সংস্কৃতিতে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি বিষয়কেই পাঁচ উপাদান দ্বারা গঠিত হিসেবে পাঠ করা হয়। যাহোক, পাঁচটি মূল তারের বাইরে বাকি দুটি তার দিয়ে যথাক্রমে প্রশাসনিক সামরিক দক্ষতাকে বোঝানো হয়। প্রতিটি অংশের নাম রূপকও বেশ অদ্ভুত। তাতে যেন অন্য কোনো জগতের ঘ্রাণ জড়িয়ে আছে। চিনের উপরের অংশ প্রতীকায়িত করত স্বর্গকে। আর নিচের অংশ যেন পৃথিবী। চিন বাজানোকে তুলনা করা যায় শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার সঙ্গে। প্রতিটা নোটই যেন এক জীবন্ত সত্তা। এর সুরকে বুঝতে হলে কানকে খুব সূক্ষ্ম পরিবর্তনকেও আলাদা করার জ্ঞান রপ্ত করতে হবে। একই নোট ভিন্ন তারে বাজালে ভিন্ন রঙ নিয়ে হাজির হয় চিনের ক্ষেত্রে। ফলে সামান্য পরিবর্তনও অর্থের দিক থেকে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, চীনা সংস্কৃতিতে চিন বাজাতে পারা কোনো সাধারণ কাজ ছিল না কখনই। চিনকে মনে করা হতো উচ্চ আধ্যাত্মিক বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের চর্চা। বিশ্বাস করা হয়, চিনের চর্চা মানুষের চরিত্র গঠনে সহযোগিতা করে। ব্যক্তির ভেতরে নৈতিক প্রাচুর্য নিয়ে আসে ঈশ্বরের প্রতি বিনয়ী হিসেবে তৈরি করে। চিন অন্তরে জীবনীশক্তি দেয়, মানুষকে পরিশীলিত করে তোলে বিশ্বাসী বানায়। হান শাসনামল থেকে এখন পর্যন্ত টিকে আছে বিশ্বাস। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার দর্শন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত তাও মতবাদ। মহাবিশ্বের ঐকতানে নিজেকে স্পন্দিত করার দর্শন। বিশ্বাস অনুসারে, চিনের সুরের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় বিশ্বজগতের ঐকতান, যা হূদয়কে শীতল করে। ১৩৬৮-১৬৪৪ সালে মিং সাম্রাজ্যের সময় চিন বাজানোর জন্য প্রায়ই একটা দৃশ্যের বর্ণনা করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে একটা বাগানের পাশে ছোট তাঁবুর সামনে বসে চিন বাজানো। সামনে থাকবে পাইন গাছ। যেন মৃদুমন্দ বাতাসের মধ্যে কেউ তার প্রিয় কারো জন্য অপেক্ষমাণ। চিন বাস্তবিক অর্থেই নিঃসঙ্গতা আত্মমগ্নতার সুর তৈরি করে। তাই শান্ত চাঁদনী রাতকে মনে করা হতো চিন বাজানোর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। চিন যেন একান্তই ব্যক্তিক। তার সুর যেন কেবল নিজের জন্য। বড়জোর খুব কাছের বন্ধুর সামনে। পরবর্তী সময়ে দরবারে উঠলেও কখনই ব্যক্তিক আবেদনটা বিলীন হয়নি চিনের পাশ থেকে।

১৯৭৭ সালে নাসার ভয়েজার টু পাঠানো হয় মহাশূন্যে। সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয় একটা ফনোগ্রাফ। সেখানে বাজছিল একটা চিনের সুর, নাম ফ্লোয়িং স্ট্রিমস বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে সুরটি অবশ্য অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। চীনা কিংবদন্তি অনুসারে, হাজার হাজার বছর আগে বোয়া নামের একজন চিনবাদক বাড়ি ছেড়ে চলছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে। সেখানে এক অপরিচিত বাজিয়ে শোনান তার সুর। শ্রোতা জিচি তা শুনে নিজের অভিব্যক্তি জানিয়েছিলেন, সমুদ্রের মতো স্রোতধারা তারপর বোয়া চিন বাজাতে লাগলেন আর জিচি বলে যেতে থাকলেন সুরের অর্থ। এভাবেই একসময় মারা যান জিচি। অমন শ্রোতা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না ভেবে নিজের চিনকে ভেঙে ফেলেন বোয়া। আর চিন বাজাবেন না তিনি। তখন থেকেই ফ্লোয়িং স্ট্রিমস বন্ধুত্বের সুর হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে চীনা সংস্কৃতিতে। ২০০৩ সালে ইউনেস্কো চিনের সুরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মানুষের মধ্যে বেড়েছে চিনের প্রতি আগ্রহ। ২০০৩ সালের পর থেকে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ চিন বাজানো শিখেছে। সংখ্যাটা ক্রমেই বর্ধমান। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় বর্তমানেও দৃশ্যমান চিনের জয়যাত্রা। চিনকে এখনো গণ্য করা হয় সব যন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে। চীনের ঐতিহ্য মিশে গেছে চিনের ঐতিহ্যের সঙ্গে।

 

আহমেদ দীন রুমি: লেখক