বাংলার আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। এ ঘটনা তৎকালীন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জনের জীবনেও বড় প্রভাব রেখেছিল। তবে সে বছরের শুরুতে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন অন্য একটি বিষয় নিয়ে। তার প্রথম স্ত্রী মেরি লেইটার তখন গুরুতর অসুস্থ। কলকাতায় কার্জন তখন নিঃসঙ্গ। একদিকে ভারতে ব্রিটিশ সেনাদলের কমান্ডার ইন চিফ কিচেনারের সঙ্গে বিবাদ তাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। অন্যদিকে লন্ডনে তখন মেরির অসুস্থতা বাড়ছে। সেন্ট জেভিয়ার্সে মেরির জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা হচ্ছে। মেরির স্মৃতি কার্জনকে কাতর করে রেখেছে, এমনকি মেরির শয়নকক্ষে প্রবেশ করতেও তখন তার ভয়, বেদনার অশ্রুপাতের ভয়। জানুয়ারিতে তিনি মেরিকে বললেন, সে চাইলে তিনি ভাইসরয়ের পদে ইস্তফা দিয়ে লন্ডন চলে আসবেন। অন্যদিকে আশা করছিলেন এপ্রিল নাগাদ সুস্থ হয়ে মেরি হয়তো সন্তানদের নিয়ে ভারতে চলে আসতে পারবেন। তারপর ১৯০৬ সালের শুরুতে সবাই একসঙ্গে লন্ডন ফিরবেন। মার্চে তিনি কলকাতা ফিরলেন। কলকাতা ক্যাথেড্রালে বিশেষ থ্যাংকসগিভিং অনুষ্ঠান হলো। আড়ম্বর আয়োজনে বরণ করে নেয়া হয় মেরিকে। কার্জন আবার জীবনের ছন্দ খুঁজে পান। মেরির জন্য একটা কবিতাও লিখে ফেলেন। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে দুটি নতুন প্রদেশের ঘোষণা দেন। ক. পশ্চিমবঙ্গ এবং খ. পূর্ববঙ্গ ও আসাম। মোটাদাগে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী এ সিদ্ধান্তে আনন্দিত হয়েছিলেন তাদের অবস্থা পরিবর্তনের আশায়। অন্যদিকে হিন্দুরা এ সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেন। শুরু হয় স্বদেশী অন্দোলন। ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন— বঙ্গভঙ্গ রদ
আন্দোলন স্বদেশী
ও সন্ত্রাসবাদী
আন্দোলনে রূপ
নেয়। বলা
বাহুল্য, এ স্বদেশী
ও বিপ্লবী
আন্দোলন ভারতে
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
ভিত কাঁপিয়ে
দিয়েছিল। ভারতীয়দের
মোকাবেলায় তিনি
সিদ্ধহস্ত, এ
বলে লর্ড
কার্জন গর্ববোধ
করতেন। এমনকি
তিনি একবার
কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী
নেতাদের সম্পর্কে
মন্তব্য করেছিলেন
যে তারা
‘গঙ্গায়
তো আর
আগুন লাগাতে
পারবে না’।
সে আত্মবিশ্বাসী লর্ড
কার্জন বঙ্গভঙ্গকে
ঘিরে জ্বলে
ওঠা স্বদেশী
ও বিপ্লবী
আন্দোলনের মুখে
হতাশ ও
বিচলিত বোধ
করতে থাকেন।
এমনকি সসম্মানে
পদত্যাগের কথাও
ভাবছিলেন তিনি।
ভারতীয় বাহিনীর
প্রধান সেনাপতি
লর্ড কিচেনার
তাকে সে
সুযোগ এনে
দেন। সেনাবাহিনীর
সংস্কার প্রসঙ্গে
লর্ড কিচেনারের
সঙ্গে তার
গভীর মতপার্থক্য
দেখা দেয়।
কার্জন অনুভব
করেন, ‘ইন্ডিয়া
অফিস’ কিচেনারের
পক্ষাবলম্বন করছে।
এ পরিস্থিতিতে
লর্ড কার্জন
১৯০৫ সালের
আগস্টে পদত্যাগ
করেন এবং
ইন্ডিয়া অফিসও
তাত্ক্ষণিকভাবে তার
পদত্যাগপত্র গ্রহণ
করে। বস্তুতপক্ষে
কার্জনের এ
পরিণতির জন্য
দায়ী ছিল
বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভদ্রলোক
শ্রেণী। এদের
সম্পর্কে কার্জনের
অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য
ছিল, ‘এরা
প্রেরণাসঞ্চারী কিংবা
পুরুষোচিত জাতি
নয়।’ হিন্দু
ভদ্রলোক পরিচালিত
সফল জাতীয়তাবাদী
আন্দোলনই কার্জনের
শাসন অবসানের
প্রধান কারণ। লর্ড কার্জনের আমলে ব্রিটিশ প্রশাসন অনেক সীমান্তরেখায় পরিবর্তন টেনেছিল। তার আমলেই প্রতিষ্ঠা পায় নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স, নিজামের হায়দরাবাদ থেকে বেরার অংশটি আলাদা করা হয়। ১৯০২ সালের এপ্রিলে কার্জন নিজে হায়দরাবাদ সফরে যান এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজামের সঙ্গে সমঝোতামূলক সমাপ্তি টানেন। বেরার নিজামের শাসন থেকে আলাদা হয়ে সেন্ট্রাল প্রভিন্সে যুক্ত হয়। কিন্তু কার্জনের এ সফলতার ধারা বাংলায় অক্ষুণ্ন থাকেনি। বরং বঙ্গভঙ্গের জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বঙ্গভঙ্গ পূর্ব বাংলার মানুষকে কলকাতার নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। আর ঠিক এ কারণেই সেখানকার হিন্দু ভদ্রলোকরা এর প্রবল বিরোধিতা করেন। ১৯০৫ সালে নভেম্বরে ভারত ত্যাগের আগে নিজের শেষ দাপ্তরিক বক্তব্যে কার্জন বলেছিলেন, লেট ইন্ডিয়া বি মাই জাজ। অর্থাৎ ভারতবাসীই আমার কাজের বিচার করবে। নেহরু কার্জনের প্রশংসাই করেছেন। বাংলার মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন কার্জনকে নিয়ে। না হওয়ারও অবশ্য কারণ ছিল না। বাংলার মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা ১৯০৪ সালে কার্জন তার এক ভাষণে উসকে দিয়েছিলেন। কার্জন বলেছিলেন, মুসলিম শাসন অবসানের পর মুসলিমরা আর সেভাবে নিজেদের ঐক্যের শক্তি ধরে রাখতে পারেনি। তিনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলার মুসলিমদের জন্য এ ঐক্য ইতিবাচক হবে। কারণ এতে স্থানীয় স্বার্থ ও বাণিজ্য বিকশিত হবে, যা আপনাদের কথামতো এতদিন সম্ভব হয়নি আরেকটি প্রশাসনের অধীনে থাকায়। এ কথা পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের উৎসাহিত করে। এই আরেকটি প্রশাসন বলতে কার্জন বুঝিয়েছিলেন কলকাতার বাবুদের অধিপত্য, যারা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের। কার্জন আশ্বাস দিয়েছিলেন, হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের যে উদ্দীপনা ও প্রেরণা প্রয়োজন তা আমরা নিশ্চিত করতে পারি। তবে এসব শুনে এমন সিদ্ধান্ত টানা হয়তো খুব একটা যুক্তিযুক্ত হবে না যে কার্জন মুসলিমদের প্রতি বিশেষ সহমর্মী ছিলেন। মূলত প্রশাসনিক সংস্কার কিংবা নীতি বাস্তবায়নই ছিল তার অগ্রাধিকার। ১৯০২ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি সেক্রেটারি অব স্টেটকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত না এটা স্থানীয় সরকারগুলোর, অন্তত কয়েকটির সীমানা নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত সময় কিনা। কোনো সন্দেহ নেই বাংলার দায়িত্ব পালন একজন প্রশাসকের পক্ষে কঠিন। চট্টগ্রাম কি বাংলাতেই থাকবে? নাকি আমরা আসামকে একটা সাগর দুয়ার দেব? উড়িষ্যা কি কলকাতা থেকে শাসন করা সহজ? গানজাম কি মাদ্রাজকে দেয়া উচিত?...’ এখানে উল্লেখ করা যায়, ১৮৯৬ সালে আসামের চিফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহকে আসামে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব তুলেছিলেন। যদিও এ প্রস্তাব বাংলার হিন্দু বা মুসলিম কেউই গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। উভয় সম্প্রদায়ের ভাবনা অবশ্য ভিন্ন ছিল। এ পর্যায়ে কার্জন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফর করেন। সরেজমিন সফর থেকে প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তা তার কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। লোভাট ফ্রেজার রীতিমতো ছবি এঁকে পূর্ব বাংলার দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অনুন্নত অবস্থার বিষয়টি তুলে ধরেন। বাংলা সফরে তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনেছিলেন। সে অনুযায়ী নিজ বিবেচনা কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাগ ও সীমানা নিয়ে তিনি কাজ করেন। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই ব্রিটিশ প্রশাসন তাদের বাংলা ভাগের পরিকল্পনা প্রকাশ করে এবং ঘোষণাটি সরকারি গেজেট হয় ১ সেপ্টেম্বর। পূর্ব বাংলা ও আসাম মিলিয়ে গঠিত প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা আর এর আয়তন ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫৪০ বর্গমাইল। আর পশ্চিমবঙ্গে ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল। এ দুটি প্রদেশ ১৯১১ সালে ১২ ডিসেম্বর ব্রিটেনের রাজার ঘোষণার মাধ্যমে দাপ্তরিক রূপ লাভ করে।
এস এম রশিদ: লেখক