সিল্করুট

দাবা নিয়ে হিরাম কক্সের তত্ত্ব

নিজাম আশ শামস


যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই শীত নেমে গেল। এত ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত নয় তারা। বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হলো। স্ত্রী-পরিজনবিবর্জিত সৈন্যরা অচিরেই অস্থির হয়ে উঠল। ঘরে ফিরে যাওয়ার তাগাদা দিতে লাগল বারবার। বিপাকেই পড়ে গেলেন সেনাপতি হেমসিঙ। কিয়াংনানের রাজা হুঙ কোচির একজন মান্দারিন (রাজকর্মচারী) তিনি। রাজার নির্দেশে সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছেন সেনশি দখল করতে। অভিযান শেষ হওয়ার আগেই এমন দুর্বিপাক। হেমসিঙ ভাবতে লাগলেন, বিরূপ পরিস্থিতিতে কীভাবে সৈন্যদের চাঙ্গা রাখা যায়। তাদের অশান্ত মনকে শান্ত করার উপায় বের করতে হবে তাকে। এমন কিছু আবিষ্কার করতে হবে, যা যুগপৎ সৈন্যদের প্রশান্ত করবে এবং তাদের সামরিক উদ্দীপনাও বজায় রাখবে। হেমসিঙ কেবল দক্ষ যোদ্ধাই ছিলেন না, যথেষ্ট জ্ঞান বিচক্ষণতাও ছিল তার। আর দুয়ের সমন্বয়ে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন একটি খেলা। যেন শুধু খেলা নয়, যুদ্ধের মহড়া! খেলতে হবে যুদ্ধের মূলনীতি অনুসরণ করে। হেমসিঙের আবিষ্কৃত খেলা তার উদ্দেশ্য পূরণে শতভাগ সফল হয়েছিল। সৈন্যরা নতুন খেলা নিয়ে মেতে রইল। প্রকৃত রণাঙ্গনের একই ধরনের উন্মাদনায় মগ্ন হয়ে তারা ভুলে গেল সব প্রতিকূলতা। হাসি ফুটল হেমসিঙের মুখে। অবশেষে শীত পেরিয়ে এল বসন্ত। নতুন করে যুদ্ধের আয়োজন শুরু হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই সেনশিকে কিয়াংনান রাজ্যের অধীন করলেন হেমসিঙ। বিজয়ের পর কিয়াংনান অধিপতি হুঙ কোচি নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলেন। বিজয়ীর বেশে ফিরলেন সেনাপতি হেমসিঙ। তখনো তিনি জানেন না, তার আবিষ্কৃত খেলাটি সাধারণ মানুষ কতটা ভালোবেসে গ্রহণ করবে। যুগে যুগে তাদের অবসরযাপনের অন্যতম চমত্কার উপায় হবে খেলা। ঘটনাটি আজ থেকে হাজার ৯৬৫ বছর আগের, কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর। ততদিনে পেরিয়ে গেছে ৩৭০ বছর। ধরাধামে ঈসা মসিহর আবির্ভাব ঘটতে তখনো ১৭৪ বছর দেরি। উল্লেখ্য, কিয়াংনান সেনশি বর্তমানে চীনের দুটি প্রদেশ।

১৭৯৯ সালের ২৮ মে ব্রিটিশ প্রশাসক জন হারবার্ট হ্যারিংটনকে চট্টগ্রাম থেকে একটি চিঠি লেখেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। বিস্তৃত সে চিঠির একটি অংশে তিনি আইরিশ গবেষক আরভিনের বরাত দিয়ে দাবা খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে ঘটনার উল্লেখ করেছেন। হিরাম কক্স কেবল ব্রিটিশ প্রশাসক ছিলেন না। তিনি একজন দাবাড়ু দাবা গবেষকও ছিলেন।

অন দ্য বার্মা গেম অব চেসশিরোনামের সে চিঠির আরেকটি অংশে তিনি উইলিয়াম জোনসের দোহাই দিয়ে দাবা খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি মিথের উল্লেখ করেছেন। সে মিথ অনুসারে, দাবা খেলার ধারণাটি লঙ্কার রাজা রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর মস্তিষ্কপ্রসূত। ত্রেতা যুগে রাম লঙ্কা আক্রমণ করেন। যুদ্ধের ময়দানে রাবণের বাহিনী যখন রামের সেনাদলের মোকাবেলা করছে, তখন ঘরে বসেই যুদ্ধের স্বাদ নিতে মন্দোদরী আবিষ্কার করে ফেললেন চমত্কার বুদ্ধিবৃত্তিক খেলাটি। তবে দাবার উৎপত্তি প্রসঙ্গে দুই ঘটনার মধ্যে শেষোক্তটির পক্ষ নিয়েছেন হিরাম কক্স। তিনি লিখেন, ‘খেলাটির উৎপত্তি লঙ্কায়, মতকেই আমি প্রাধান্য দিচ্ছি। কারণ উইলিয়াম জোনসের মতো গবেষকদের মতে, এটিই দাবাসম্পর্কিত প্রাচীনতম ঘটনা। আর পারস্যের অধিবাসীরা স্বীকার করেছে, তারা খেলাটি ভারতীয়দের থেকে গ্রহণ করেছে। আমি জানি, লন্ডনের আর্কিওলজিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে ব্যারিংটন সাহেব চীনের দাবা খেলাটিকে সর্বপ্রাচীন বলে দাবি করেছেন। খেলার আবিষ্কারক হিসেবে প্রাচীন গ্রিকদের দাবিকে খারিজ করার জন্য তিনি যথেষ্ট শ্রম ব্যয় করেছেন। কিন্তু চীনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি রয়েল আইরিশ একাডেমিতে সংরক্ষিত আরভিনের প্রবন্ধ অনুসারে, চীনারা খেলাটির উৎপত্তির তারিখ নির্ধারণ করে নিজেদের দাবিকেই বাতিল করে দিয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৪ অব্দে তারা খেলাটি আবিষ্কার করেছে বলে দাবি করে।হিরাম কক্সের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, গ্রিস, চীন পারস্যের বহু আগেই ভারতবর্ষে দাবার উৎপত্তি ঘটেছে। সেখান থেকেই কালক্রমে দাবা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে নিজের মতকেই সবার ওপরে চাপিয়ে দিতে চাননি ক্যাপ্টেন কক্স। ভবিষ্যতের গবেষকদের তিনি খেলার উৎপত্তি নিয়ে অধিকতর গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বর্তমানে পাওয়া তথ্য অনুসারে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। আমার সামর্থ্য অনুসারে আমি এশিয়া অঞ্চলের দাবা খেলার চারটি প্রধান রূপ তাদের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। প্রথমত, উইলিয়াম জোনস উল্লেখিত পুরাণে প্রাপ্ত রূপ; দ্বিতীয়ত, জনাব আরভিন বর্ণিত চীনের দাবা খেলা; তৃতীয়ত, বার্মার অধিবাসীদের অনুসৃত পদ্ধতি এবং সর্বশেষ, পারসি বা বর্তমান হিন্দুস্তানিদের দাবা খেলার রীতি-নীতি পদ্ধতি। আমি দাবা খেলার এসব রূপের তুলনা করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি ইংরেজদের দাবা খেলার সঙ্গে এসব খেলার পার্থক্য মিল চিহ্নিত করেছি। এগুলোর মধ্যে কোনটি আদি রূপ, তা নির্ধারণের ভার ভবিষ্যতের অধিকতর সৌভাগ্যবান কোনো গবেষকের জন্য আমি ছেড়ে দিচ্ছি।ইংরেজদের দাবা খেলা বলতে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স দাবা খেলার বর্তমান রূপটিকেই বুঝিয়েছেন।

দাবা খেলার প্রাচীন নাম চতুরঙ্গ। এটি সংস্কৃত শব্দ। আভিধানিক অর্থে চতুরঙ্গ বলতে একটি সেনাবাহিনীর চারটি অংশকে বোঝায়গজ, অশ্ব, রথ পদাতিক বাহিনী। উইলিয়াম জোনসের সূত্রে পাওয়া তথ্য আমলে নিয়ে ক্যাপ্টেন কক্স জানান, ভারতে খেলাটি চতুরাজি নামেই অধিক পরিচিত ছিল। চতুরাজি অর্থ চার রাজা। চারজন মিলে খেলা হতো। চতুরঙ্গ বা চতুরাজির বর্ণনা দিতে গিয়ে হিরাম কক্স জানান, খেলার বোর্ড চতুর্ভুজ আকৃতির। তিনি লক্ষ করেন, ইংরেজদের দাবা খেলার সঙ্গে চতুরঙ্গের মূল পার্থক্য হলো, খেলায় চার রাজা তাদের সেনাদলের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। অথচ আধুনিক দাবায় থাকে দুই রাজা। তবে চতুরঙ্গে রাজার সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও মোট ঘুঁটির সংখ্যায় কোনো হেরফের হয় না। বরং ৩২টি ঘুঁটিই আটটি করে চার ভাগে বিভক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দাবায় রানী (কুইন) যে অবস্থানে থাকে, চতুরঙ্গে সে অবস্থানে থাকে হাতি। চতুরঙ্গের হাতি দাবার রানী সমান ক্ষমতাধর। তৃতীয়ত, বর্তমান দাবার ক্যাসলের পরিবর্তে চতুরঙ্গে থাকে নৌকা (বোট) সে নৌকার ক্ষমতা আবার বিশপের সমতুল্য। অর্থাৎ কোনাকুনি আসা-যাওয়া করতে পারে। তবে চতুরঙ্গের নৌকা প্রতি চালে কেবল দুই ঘর যেতে পারে। চতুর্থত, দাবা খেলার বর্তমান নিয়মানুসারে, কোনো বোড়ে যদি প্রতিপক্ষের শেষ সারিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে, তবে তা যেকোনো শক্তিধর ঘুঁটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। কিন্তু চতুরঙ্গের বোড়ে প্রতিপক্ষের শেষ সারির যে ঘরে গিয়ে পৌঁছায়, কেবল সে ঘরের জন্য বরাদ্দ ঘুঁটিতেই পরিণত হতে পারে। পঞ্চমত, আধুনিক দাবায় একজন দাবাড়ু স্বাধীনভাবে চাল দিতে পারেন। কিন্তু চতুরঙ্গে সে স্বাধীনতা নেই। চতুরঙ্গের প্রতিটি চাল নির্ধারিত হয় পাশার মাধ্যমে। প্রতিবার চাল দেয়ার আগে পাশা নিক্ষেপ করতে হবে। পাঁচ উঠলে রাজা কিংবা বোড়ের চাল দিতে হবে। চার উঠলে দিতে হবে হাতির চাল। তিন দুইয়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ঘোড়া নৌকা চালতে হবে। আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, আধুনিক দাবার মতো চতুরঙ্গে ক্যাসলিং (কিং ক্যাসলের পারস্পরিক স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে কিংকে অধিক নিরাপদ করার পদ্ধতি) করার কোনো নিয়ম নেই।

এবার দেখা যাক, দাবা খেলার চীনা রূপটি কেমন ছিল। আইরিশ গবেষক আরভিনের নিবন্ধের আলোকে হিরাম কক্স জানান, চীনে দাবাকে বলা হতো চোং-কি, অর্থাৎ রাজকীয় খেলা। তবে ক্যাপ্টেন কক্স খেলাটির আরেকটি চীনা নাম আবিষ্কার করেনচোকে-চুহোং-কি তথা যুদ্ধবিজ্ঞানের খেলা। দাবা খেলার বোর্ডের তুলনায় চোং-কির বোর্ডে বেশ তফাত আছে। বোর্ডের মাঝামাঝি একটি খাদ থাকে। অনেকে এটিকে নদীও বলে থাকেন। ঘুঁটিগুলোর অবস্থান, শক্তি চালেও আছে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। চোং-কি বা চোকে-চুহোং কি খেলায় প্রতি দলের পেছনের সারিতে আটটির পরিবর্তে নয়টি ঘুঁটি থাকে। আর ঘুঁটিগুলো বর্গের পরিবর্তে রেখায় অবস্থান করে। এসব রেখা ধরেই খেলাটি খেলতে হয়। দাবা খেলার চীনা রূপে রাজাকে বলা হয় চোং বা চুহোং। চোং পেছনের সারির মাঝামাঝি অবস্থান করে। তার চাল আধুনিক কিংয়ের অনুরূপ। তবে পার্থক্য হলো, চোং তার জন্য বরাদ্দ দুর্গের মধ্যেই কেবল চলাচল করতে পারে। আধুনিক কিংয়ের মতো সর্বত্র বিচরণ করতে পারে না। চোংয়ের দুই পাশে থাকে সমান ক্ষমতাধর দুই রাজকুমার। এদের বলা হয় সাও। তাদের চালও চুহোংয়ের দুর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আধুনিক দাবায় যে দুটি স্থানে বিশপ থাকে, চোং-কিতে সেখানে থাকে মান্দারিন (রাজকর্মচারী) এদের অপর নাম শং। তাদের চালও বিশপের মতোই কোনাকুনি। পার্থক্য হলো তারা বোর্ডের মাঝখানের নদী বা সাদা অংশটি অতিক্রম করে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে পারে না। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করাই তাদের দায়িত্ব। আর প্রতি চালে তারা কেবল দুই ঘর যেতে পারে। দাবার ঘোড়াকে চোং-কিতে বলা হয় মায়ি। তাদের শক্তি চালও আধুনিক ঘোড়ার অনুরূপ। তারা প্রতিপক্ষের সীমানায়ও প্রবেশ করতে পারে। দাবা খেলার চীনা রূপে ক্যাসলকে বলা হয় শে। ক্যাসল শের ক্ষমতা চাল একই রকম। চোং-কি বা চোকে-চুহোং-কিতে পাউ নামে দুটি ঘুঁটি থাকে। এরা গোলন্দাজ সৈন্য হিসেবে কাজ করে। পাউ সোজা বা তির্যকভাবে সারা বোর্ডে বিচরণ করতে পারে। চলার পথে প্রতিপক্ষের কোনো ঘুঁটি বা বোড়ে থাকলে পাউ তাকে বন্দি করে নিজেদের সীমানায় নিয়ে আসে। বোড়েকে চীনারা বলে পিং। এর অর্থ পদাতিক সৈন্য। তারা প্রতি চালে এক ঘর যেতে পারে। তবে আধুনিক দাবার বোড়ের মতো পিং কোনাকুনি প্রতিপক্ষের সৈন্যদের কব্জা করতে পারে না। বরং পাশাপাশি ডানে বা বামে থাকা শত্রুসেনাকে তারা ঘায়েল করতে পারে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো দাবার বর্তমান নিয়মানুসারে তারা প্রতিপক্ষের শেষ সারিতে পৌঁছা সত্ত্বেও অন্য কোনো শক্তিতে পরিণত হতে পারে না। আধুনিক দাবার আটটি বোড়ের পরিবর্তে চোং-কি বা চোকে-চুহোং-কি খেলায় পাঁচটি পিং থাকে। খেলার বোর্ডের মাঝখানের প্রতীকী খাদ বা নদীকে চীনারা হোয়া কি বলে। শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এটি তৈরি করা হয়। ঘোড়া, রথ পদাতিক সেনারা একটি কাঠের সেতুর (প্রতীকী) ওপর দিয়ে নদীটি পার হতে পারে। তবে সেতুটি হাতির (মান্দারিন) ভার বহন করতে পারে না। তাই তারা নিজেদের সীমানার মধ্যে থেকে আক্রমণ প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করে। তবে দাবার বর্তমান নিয়মের মতোই চোকে-চুহোং-কি খেলায়ও প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ ধ্বংস বা রাজাকে (চুহোং) বন্দি করার মাধ্যমেই খেলার সমাপ্তি ঘটে। গোলাকার ঘুঁটিগুলো কাঠ বা হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি। প্রতিটি ঘুঁটির গায়ে নাম লেখা থাকে।

চোং-কি বা চোকে-চুহোং-কির পরে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স আমাদের চিৎ-তা-রিন সম্পর্কে জানান। বার্মায় দাবাকে নামে ডাকা হয়। সাধারণত প্রধান সেনাপতি বা যুদ্ধ বোঝাতে তারা অভিধাটি ব্যবহার করে। তবে অনেকেই শব্দটিকে সংস্কৃত চতুরঙ্গ শব্দের অপভ্রংশ মনে করেন। দাবার বর্মি রূপে রাজাকে বলা হয় মিং। তার চাল শক্তি আধুনিক দাবার কিংয়ের অনুরূপ। তবে মিং ক্যাসলিং করতে পারে না। চেকয় নামে এক ধরনের ঘুঁটি আছে। সে কোনাকুনি সামনে-পেছনে চলাচল করতে পারে। কিন্তু প্রতি চালে কেবল এক ঘর যেতে পারে। বর্তমান দাবার ক্যাসেলের সমান শক্তি অনুরূপ চালের অধিকারী ঘুঁটিগুলোকে বর্মিরা বলে রথ। হাতিকে তারা বলে ছেইন। চিৎ-তা-রিনে ঘোড়াকে বলা হয় মি। তাদের ক্ষমতা চাল বর্তমান দাবা খেলার ঘোড়ার অনুরূপ। তবে আধুনিক দাবার সঙ্গে চিৎ-তা-রিনের পার্থক্য হলো এখানে স্বাধীনভাবে ঘুঁটিগুলোকে সাজানো যায়। নির্দিষ্ট স্থানে তাদের বসানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজস্ব কৌশল অনুসারে নিজেদের সীমানার মধ্যে যেকোনো স্থানে সেনা মোতায়েন করতে পারে দুটি দল।

চিঠিতে সবশেষে দাবার পারস্য সংস্করণের ওপর আলোকপাত করেছেন ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স। পারসিরা দাবা খেলা বোর্ড উভয়টিকেই শতরঞ্জ বলে। খেলার রাজা শাহ বা পাদশাহ উপাধিতে পরিচিত। শাহর ক্যাসলিং করার কোনো সুযোগ নেই। ফির্জ বা উজিরের চালের মাধ্যমে খেলা শুরু হয়। সে সামনের দিকে এক ঘর বাড়তে পারে। তার পেয়াদাও তখন সামনে এক ঘর অগ্রসর হয়। তার পর থেকে ফির্জ বা উজির কেবল কোনাকুনি চলাচল করতে পারে। তবে প্রতি চালে এক ঘরের বেশি যেতে পারে না। এক্ষেত্রে শতরঞ্জের ফির্জের সঙ্গে চিৎ-তা-রিনের চেকয়ের মিল আছে। হাতিকে পারসিরা ফিল বলে। তারা কোনাকুনি প্রতি চালে দুই ঘর যেতে পারে। তাদের চলার পথে অন্য কোনো ঘুঁটি থাকলেও তারা তা টপকে যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে চোং-কির পাউয়ের মিল আছে। ঘোড়াকে তারা বলে আসপ। তাদের শক্তি চাল বর্তমান নাইটের অনুরূপ। আধুনিক দাবার ক্যাসলের সমান শক্তিধর অনুরূপ চালসম্পন্ন ঘুঁটিকে তারা রুক বলে অভিহিত করে। বোড়েকে তারা বলে পেয়াদা। শতরঞ্জের সমাপ্তি প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স লেখেন, ‘যখন রাজাকে চেক দেয়া হয়, তারা বলেশাহ, শাহবাকিস্ত আর যখন চেকমেট হয়ে যায়, তারা বলেশাহ-মাত

দাবার প্রধান চার রূপের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা আধুনিক দাবার সঙ্গে তাদের মিল-অমিল চিহ্নিত করার পাশাপাশি ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তার চিঠিতে খেলায় ব্যবহূত বিভিন্ন শব্দ অভিধা নিয়েও কথা বলেছেন। ১৮০১ সালেঅন দ্য বার্মা গেম অব চেসশিরোনামেএশিয়াটিক রিসার্চেস’- প্রকাশিত তার চিঠি দাবা খেলার উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ রূপভেদ নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সেখানে তিনি যে তত্ত্ব হাজির করেছেন, তা দাবারকক্স-ফোর্বস তত্ত্বনামে বিখ্যাত।

 নিজাম আশ শামস: লেখক অনুবাদক