সিল্করুট

শাহ সুলতান রুমী (র.)

রুমদেশের রাজকুমার নন, ছিলেন মুজাহিদ সুফি

তাহমিদাল জামি

শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.)-এর মাজার ছবি: রচি এন ফেরদৌস

শাহ সুলতান রুমী বাংলায় ইসলাম প্রসারের ইতিহাসে দুই কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলার আদি যুগে আগত ইসলাম প্রচারক বলে পরিচিত। দ্বিতীয়ত, তিনি মুজাহিদ সুফি তথা ধর্মযোদ্ধা সন্ত হিসেবে বাংলা অঞ্চলে অন্যতম আদি নমুনা। কিন্তু এই দুই দাবির প্রামাণ্যতা প্রতিপাদন মুশকিল, কারণ শাহ সুলতান রুমীর জীবন কর্ম সম্পর্কে যা কিছু প্রচলিত তা জানা যায়, কথিত আছে, শোনা যায় ইত্যাদি দায়সারা কথা ব্যবহার করে যত্রতত্র পুনরুৎপাদন করা হয়, অথচ তার সম্পর্কে প্রচলিত লোকশ্রুতির কেতাবীকরণ সম্পর্কে সতর্ক পর্যালোচনা বিশেষ দেখা যায় না।

শাহ সুলতানের পরিচয়ের কেতাবীকরণের যে প্রক্রিয়া আমরা জানি তা এই যে ১৯১৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা গেজেটিয়ারে জানানো হয় যে ১৮২৯ সালে কোম্পানি সরকার দরগা-মদনের লাখেরাজ জমি অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করলে ১৬২৯ সালের (১০৮২ হিজরি) এক পারস্য সনদ দেখানো হয়, যাতে শাহ সুলতান রুমীর কথা জ্ঞাপন করা হয়। ফলে ঔপনিবেশিক সরকার আর সেই জমি রিজাম্পশন করতে পারেনি। জায়গিরদার সৈয়দ জালালউদ্দিন মুহম্মদের অধিকারেই এটি থাকে। এই সনদেই নাকি বলা হয় যে শাহ সুলতান নিজ গুরু সৈয়দ শাহ সুরখ খুল আন্তিয়া খাদেমদের সঙ্গে ৪৪৫ হিজরিতে বা ১০৫৩ সালে এই স্থানে বসতি গাড়েন। পারস্য ভাষার এই সনদ আমরা দেখিনি। তবে বারভূঁইয়াকে দমনের পরে বাংলায় মোগল শাসন সুস্থিত হওয়ার ফলে মোগল রাজস্ব প্রশাসন এদেশে ভূমি ব্যবস্থার সুব্যবস্থিতকরণের অংশ হিসেবে যেসব কর্মকাণ্ড করে, তার উপজাত হিসেবে সে সময় রকম কোনো সনদ লেখনের সম্ভাবনা রয়েছে।

শাহ সুলতান রুমীকে আমরা জানি মুজাহিদ সুফি হিসেবে। কোচ রাজার সঙ্গে শাহ সুলতান রুমীর যুদ্ধের বিশদ ঘটনা যে আসলেই ঘটেছিল তার কোনো পাথুরে প্রমাণ নেই। তবে শাহ জালালের সঙ্গে গৌরগোবিন্দের যুদ্ধ কিংবা বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের যুদ্ধের যে কথাকাহিনী প্রচলিত, শাহ সুলতান রুমীর সঙ্গে কোচ রাজার যুদ্ধ সেই একই গল্পগতে পড়ে। আমরা যদি বাংলার নানা অঞ্চলের কিংবদন্তির পিরদের কাহিনী নিয়ে জরিপ করি, যেমনটা গিরীন্দ্রনাথ দাস তার বাংলার পীর সাহিত্যের কথা বইয়ে করেছেন, তবে দেখা যাবে এই রকম মুসলমান সুফি দরবেশের সঙ্গে স্থানীয় হিন্দু রাজার যুদ্ধের কাহিনী কতগুলো গৎ, মোটিফ বা ট্রোপ সহকারে বাংলার নানা অঞ্চলে অসংখ্য কথাকাহিনীর জন্ম দিয়েছে। এই গল্পগতের আড়ালে প্রকৃত ইতিহাস কতটুকু তা বলা মুশকিল। কারণ শাহজালালের যুদ্ধ কিংবা বাবা আদমের যুদ্ধের কোনো সমকালীন নথিবদ্ধকরণ হয়নি। নথিবদ্ধকরণ যা হয়েছে তা কথিত ঘটনার অনেক পরে। অর্থাৎ গল্পের ডালপালা মেলার মতো সময় ততদিনে যথেষ্ট পাওয়া গেছে। নূর কুতব উল-আলমের সঙ্গে রাজা গণেশের দ্বন্দ্বই সবচেয়ে প্রামাণ্য, কারণ তার বিস্তর সমকালীন প্রমাণ আছে। আবার বাবা আদম, শাহজালাল বা শাহ সুলতান রুমীর কাহিনীর সমকালীন প্রমাণ নেই বলেই তাকে নিশ্চিতভাবে ভুল বলা সম্ভব নয়।

সুফিদের জিহাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বিশেষত আজকের দিনে। একালে বৈশ্বিক রাজনীতির দ্বন্দ্বে ইসলামের যে উপস্থাপন দেখা যায়, তাতে দুটি দিক আছে। প্রথমত, ইসলামী সংস্কৃতি মুসলমান মাত্রকেই অসহিষ্ণু, যুদ্ধংদেহী পরবিদ্বেষী হিসেবে চিত্রিত করার একটি রাজনীতি আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপারটি আরো বিশেষ স্পর্শকাতরতা পরিগ্রহ করেছে। আবার এরই প্রতিক্রিয়ায় ইসলামের ভেতর সুফিবাদকে সহিষ্ণুতা শান্তিপরায়ণতার মরুদ্যান হিসেবে খাড়া করার একটা কৌশলগত প্রয়াস নানা পক্ষের তরফেই দেখা যায়।

মুসলমান সংস্কৃতিকে অসহিষ্ণু বলে প্রমাণের চেষ্টা আর সুফিবাদকে শান্তিপরায়ণ আধ্যাত্মিকতা হিসেবে শনাক্ত করা, এই দুই চিন্তাই সমস্যাজনক, কারণ প্রথমত, তা ইসলাম মুসলমানের সংস্কৃতিকে বিশেষ ধাতে (যুদ্ধ/শান্তি, পরপ্রেম/পরবিদ্বেষ, শরিয়তি/মারেফতি) পর্যবসিত করতে চায়, যা দিয়ে যেন চৌদ্দশত বছরের আফ্রিকা থেকে চীন তক মুসলমান সংস্কৃতির ইতিহাসকে পড়ে ফেলা যাবে! আদতে মুসলমান সংস্কৃতির ভেতর নানাবিধ দ্বন্দ্ব, বৈচিত্র্য পরত জারি ছিল আছে, যা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো সর্ব ঐতিহাসিক ধাতে পর্যবসিত করে তাকে বোঝা সম্ভব নয়। আবার খোদ সুফিবাদও একটি জটিল, বহুপরতি বহুজবানিক বাস্তবতা।

সুফিমাত্রই শান্তির কাণ্ডারি নন বরং দুনিয়ার যুদ্ধমুখর ইতিহাসে সুফিদের নানা রকম ভূমিকা দেখা যায়। সুফিদের ভেতর বীরযোদ্ধা বা নাইট, সন্ত, পাগল-মস্তান, জ্ঞানযোগী, লোকশিক্ষক, সমাজ-সংগঠক, পরামর্শক, সমাজবিপ্লবী ইত্যাদি বহুবিধ প্রকরণ ভূমিকার সংমিশ্রণ দেখা যায়। যুদ্ধ বা জিহাদও তাই সুফিদের আমলের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অভিব্যক্তি।

সুফিদের জিহাদের উদয় প্রসঙ্গে ডেবরাহ টরের আলোচনার সূত্র টানা যেতে পারে। তিনি বলেন, উমাইয়া খিলাফতের শেষ দিকে রাষ্ট্র প্রযোজিত জিহাদ কিছু স্তিমিত দুর্বল হয়ে এলে পরে মুতাতাওয়িয়া তথা ব্যক্তিগত পর্যায়ে জিহাদের বিস্তার দেখা যায় বাইজেন্টীয় তথা রুম সীমান্তে। এই ব্যক্তিগত যুদ্ধপ্রচেষ্টার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হাদিস অন্যান্য ইসলামী শাস্ত্রের শাস্ত্রীকরণ ঘটে, ফলে খলিফার আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব খর্ব হয় এবং সমাজে উলামা, অধ্যাত্মবাদীসহ নানা সমান্তরাল হেজেমনির উদয় ঘটে। এই হলো সুফি কর্তৃত্বের বিকাশের প্রাথমিক শর্ত, যা জিহাদের সঙ্গে যুক্ত।

হ্যারি এস নীল তার সুফি ওয়ারিয়র সেন্টস বইতে দেখিয়েছেন যে রুম সীমান্তের যোদ্ধা বা গাজী যারা গাজোয়ায় অংশ নিতেন এবং রিবাতে থাকতেন, তাদেরই সুফিদের যথার্থ পূর্বপুরুষ হিসেবে শনাক্ত করা যায়। খোদার ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতা এবং বারা ছিল তাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য। বস্তুত বাগদাদে সুফিয়ার বিকাশের আগে জুহদ বা তাপসিকতার বিকাশ ঘটে। আর এই আদি জিহাদিরা ছিলেন জুহদ বা কৃচ্ছ্রতা কঠোর তপস্যার চর্চাকারী। অর্থাৎ দুনিয়াবিরাগ যা যেকোনো অধ্যাত্মবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তার সংগঠিত অভিব্যক্তি এই আদি সংযমী জিহাদিদের মধ্যে বিকাশ লাভ করেছিল, আর এই জাহিদদের পরম্পরাতেই পরে সুফিবাদের বিকাশ ঘটে।

ইসলামের প্রসারের যে ভূগোল, তার নানা রাজনৈতিক সীমান্ত ছিল, যেমন রুম সীমান্ত, তুর্কি তাতার সীমান্ত, আন্দালুসিয়া ইউরোপের সীমান্ত, ভারত চীন সীমান্ত ইত্যাদি। হ্যারি নীল দেখিয়েছেন যে এসব সীমান্তে সুফিরা প্রায়ই মুজাহিদ হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিতেন। ইব্রাহিম আদহাম, বায়েজিদ বোস্তামি, জালালউদ্দিন রুমি, নজমুদ্দীন কুবরা, শাহজালাল মুজাররাদসহ অনেক প্রসিদ্ধ সুফির জীবনী কিংবদন্তি আলোচনা করে নীল দেখিয়েছেন যে জিহাদ তত্পরতা সুফিদের আমলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল।

নীল জিহাদকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন, একটি হলো অন্তরের প্রবৃত্তি বা নফসের সঙ্গে জিহাদ, যাকে বলে বড় জিহাদ বা মুজাহাদা। দ্বিতীয় হলো ক্ষমতাবানকে কঠোর সত্য বলার জিহাদ, যা সুফিরা খলিফা-রাজা-শাসকদের মুখের ওপর বলতেন কোনো ভয়ের পরোয়া না করে। আর তিন নম্বর হলো মাঠে-ময়দানে গায়ে-গতরে যুদ্ধ।

শাহ সুলতান রুমীর বাংলার নেত্রকোনা অঞ্চলের জিহাদের যে কিংবদন্তি চালু আছে, তাকে আমরা এই জিহাদের অংশ হিসেবেই বুঝতে পারি। তার নাম যে রুমী এটা তাত্পর্যপূর্ণ কারণ রুম সীমান্তে এগারো শতকে সীমান্ত জিহাদ বা গাজোয়া চালু ছিল। যদি আসলেই তিনি এগারো শতকের হয়ে থাকেন, তাহলে বাইজেন্টীয় সীমান্ত থেকে তিনি তল্লাটে অভিবাসন করেছিলেন কিনা সে প্রশ্ন মাথায় আসে। প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তর জানার জো নেই।

শাহ সুলতান রুমীর নাম দেখে তিনি রুমদেশের রাজকুমার ছিলেন রকম মনে করা আবশ্যক নয়। সুফিদের নামে রাজকীয় অভিধা আদিযুগে দেখা যায় না। কিন্তু আব্বাসী সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের ফলে মুসলিম জাহানে ক্ষমতা কর্তৃত্বের যে খণ্ড খণ্ডকরণ ঘটে, তার ফলে একদিকে যেমন বহু স্থানীয় রাজ্যের বিকাশ ঘটে, তারই সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য সুফি নানা অঞ্চলে প্রধান সাধক হিশেবে হাজির হন এবং এরই সঙ্গে সঙ্গে মোটামুটি আবু সাঈদ আবুল খায়েরের জমানার পর থেকে সুফিদের নামের সঙ্গে শাহ, সুলতান ইত্যাদি রাজকীয় অভিধা এবং গাউস, কুতুব ইত্যাদি আধ্যাত্মিক অভিধা সংযোজিত হওয়া শুরু করে। ধরনের রাজকীয় নাম বা অভিধা সংযুক্তির ধারায়ই আমাদের আলোচ্য সুফির নাম শাহ সুলতান রুমী হয়েছে কিনা সেই সম্ভাবনা মাথায় রাখা যেতে পারে, যদিও ব্যাপারটি নিশ্চিত নয়। মহাস্থানের শাহ সুলতান মহীসওয়ারের সঙ্গে শাহ সুলতান রুমীর কোনো সুবাদ আছে কিনা কে জানে। তবে বায়েজিদ বোস্তামিকে যে অর্থে সুলতানুল আরিফিন বলে, সে অর্থে অন্য সুফিদের নামও শাহ, সুলতান ইত্যাদি হয়।

শাহ সুলতান রুমীর সঙ্গে তরিকা সুফিবাদের সম্পর্ক আরেকটি প্রসঙ্গ। বাগদাদের সুফি বা খোরাসানের মালামাতিরা সবাই তরিকার অনুসারী ছিলেন না। তরিকার বিকাশ ঘটেছে পরে, বিশেষ করে মোঙ্গল আক্রমণের পরে এর সম্যক বিকাশ হয়।

বাংলায় সুফিবাদের বিকাশের আদিপর্ব বলে যদি কিছু থাকে, তখন তরিকাকেন্দ্রিকতা ছিল না। বাংলায় সুফি তরিকা বলে যেগুলোর নাম প্রসিদ্ধ তার মধ্যে আছে চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, কাদিরিয়া নকশবন্দিয়া। চিশতিয়া তরিকার সার্থক বিকাশ নিজামউদ্দীন আউলিয়ার শিষ্যদের দ্বারা। মুঈনউদ্দীন চিশতি, ফরিদউদ্দীন গাঞ্জেশাকর, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর যে পরম্পরা তাকেই নিজামউদ্দীন আউলিয়া এক মহীরুহে পরিণত করেন। চিশতী ধারার প্রসারের সমকালেই সমান্তরালভাবে সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার বিকাশ। কাদিরিয়া নকশবন্দিয়া এর বেশকিছু পরে বিশেষত মোগল আমলে উপমহাদেশে সম্যক প্রসার লাভ করে। ফলে উপমহাদেশে প্রকৃত অর্থে তরিকা সুফিবাদের বিকাশ চোদ্দ শতকের আগে সেভাবে হয়নি। কাজেই এর আগে যেসব সুফি ধর্মপ্রচারে অঞ্চলে এসেছেন তাদের সুনির্দিষ্ট তরিকাগত সিলসিলায় ফেলা যায় না। কারণে শাহজালাল বা শাহ সুলতান রুমী সুনির্দিষ্ট কোনো মহাতরিকার সঙ্গে যুক্ত বলে শ্রুতি নেই।

পরিশেষে রিচার্ড ইটন অসীম রায়ের আলোচনার প্রসঙ্গ টানি। ইটন দেখিয়েছেন যে মোগল আমলে অঞ্চলে কৃষির সংগঠিত বিকাশের সঙ্গে ইসলামের প্রসারের যোগ আছে। আর অসীম রায় তার কিছু আগে দেখান যে এদেশে যাদের পির বলা হয় তাদের কেউ ছিলেন প্রকৃতই পির বা সুফিসাধক, কেউ ছিলেন নেহাৎ যোদ্ধা বা প্রশাসক, যাদের মৃত্যুর পর পির বানানো হয়েছে, আর তিন নম্বরে স্থানীয় নানা চরিত্র, দেবদেবী বা প্রাকৃতিক ব্যাপারকেও পিরে পরিণত করা হয়েছে। অসীম রায় এই পির নির্মাণের প্রক্রিয়াকে পিরিফিকেশন বলে অভিহিত করেন, যাকে বাংলায় আমরা পিরায়ন বলতে পারি, রামায়ণ বা শিবায়নের মতো করে। কিন্তু ইটন অসীমের আলোচনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ বলতে চান যে বাংলায় ইসলাম প্রসারে সুফিদের ভূমিকা তত গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা বলা হয়।

আমাদের উপরের আলোচনায় আমরা প্রস্তাব করতে চেয়েছি যে সুফিবাদ বা তাসাউফ ইসলামী সমাজ সংস্কৃতির অন্য নানা পরিসর, আমল প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কে সুফি আর কে সুফি নয় সেটাকে খুব তড়িঘড়ি নির্ণয় করা সহজ নয়। কেউ জীবদ্দশায় যোদ্ধা হিসেবে মশহুর হলে তিনি সুফি ছিলেন না রকম দাবি করা ঠিক নয়। মির্জা নাথানের বাহারিস্তান গায়েবির কথাই ধরুন, যাতে মোগল বাহিনীর র্যাংকের নানা সেনাপতি সৈনিকের আধ্যাত্মিকতার ইশারা পাওয়া যায়। আর আধ্যাত্মিক জাগতিকের মধ্যে সীমানা সবসময়ই ছিল ভেদ্য। সারি আল-সাকাতি তার ভাগিনা জুনায়েদ বাগদাদি যেমন ছিলেন দোকানদার অথচ সুফি। অর্থাৎ বাংলায় যাদের মরণোত্তরকালে সুফি বা পির বলে ভক্তি করা হয়, তারা যোদ্ধা বা কৃষি সংগঠক বলেই সুফি নন এটা সাধারণ দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল।

আরেকটি দিক হলো কেউ পবিত্র কি মামুলি, পির না অপির সেটির নির্ণয় কীভাবে ঘটে। সমাজ যার পবিত্রায়ন করে তাকে অন্য কোনো মানদণ্ডে মামুলি বলে সাব্যস্ত করা অনৈতিহাসিক হতে পারে। বাংলার ইসলামের আদিজমানায় যে সময় শাহ সুলতান রুমীর আবির্ভাব, তখন জাদু বা সেহর, ইন্দ্রজাল, ভূতবিদ্যা, আবার রুকইয়া, কারামত, ইত্যাদি থেকে বিচ্ছিন্ন করে পবিত্রতাকে বোঝা হয়তো সম্ভব নয়। ফলে পবিত্রায়িত পিরদের কাহিনীতে রকম নানা অনুষঙ্গকে আমরা গৎ বা ট্রোপ হিসেবে পাই, যেগুলো সামাজিক চৈতন্যের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

 

তাহমিদাল জামি: লেখক-গবেষক