বিশেষ সংখ্যা

আগামী পাঁচ বছরে ৫০টি উপশাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে


প্রথম এনবিএফআই হিসেবে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মাইলফলক কীভাবে অর্জিত হলো সে বিষয়ে জানতে চাই?

আইডিএলসি ফাইন্যান্স ১৯৮৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ ৩৮ বছরের পথচলায় দেশের বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। লিজিং কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও দেশের অর্থনৈতিক চাহিদা অনুযায়ী করপোরেট ঋণ, এসএমই ঋণ, রিটেইল ঋণ আমানতের সময়োপযোগী আর্থিক পরিষেবা নিয়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সুশাসন, দক্ষ আর্থিক ব্যবস্থাপনা গ্রাহকদের দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়া অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আইডিএলসিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। আইডিএলসির ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পোর্টফোলিও ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে বিষয়গুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি।

ভবিষ্যতে আইডিএলসিকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?

শুরুতে আইডিএলসি করপোরেট খাতকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কৌশল পরিবর্তন করে আইডিএলসি এসএমই খাতকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করে। ১৫ বছর ধরে আমরা কৌশল অনুসরণ করছি। আমাদের ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ পোর্টফোলিওর ৪০ শতাংশ হচ্ছে এসএমই খাতে। বছর আমাদের এসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। আমরা শাখা সম্প্রসারণ করেছি। দেশব্যাপী আমাদের ৪০টি শাখা রয়েছে। ১৮টি জেলায় আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। এসএমই ঋণ দেয়ার মাধ্যমে আমরা খাতকে আনুকূল্য দেখাচ্ছি তা নয়, এর মাধ্যমে আমরাও লাভবান হচ্ছি। এসএমই রিটেইল ঋণের তুলনায় করপোরেট খাতে ঋণ দিলে স্প্রেড তুলনামূলক কম থাকে। তাছাড়া এসএমইতে খেলাপি ঋণের হারও অনেক কম। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে গ্রাহককে অনেক ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। আমাদের কর্মকর্তারা গ্রাহকদের এসব কাগজপত্র প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকেন। এতে আমাদের ঋণ প্রদান কার্যক্রম সহজ হয়ে যায়। আমরা শুধু ঋণই দিই না, পাশাপাশি যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হয়েছে সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটিও পর্যবেক্ষণ করে থাকি। করপোরেট ঋণের আকার বড় হওয়ায় কোনো কারণে এক-দুজন গ্রাহক খেলাপি হলেও আমাদের আর্থিক ফলাফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে এসএমই ঋণের আকার ছোট হওয়ার কারণে খেলাপি হলেও সামান্য প্রভাব পড়ে। শাখার পরিবর্তে আমরা আরো উপশাখা স্থাপন করতে চাই। এতে পরিচালন ব্যয় কম হবে। উপশাখার মাধ্যমে আমরা গ্রাহকের দোরগোড়ায় আরো বেশি পৌঁছাতে চাই। এটিই আমাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল আমাদের অনেক সাহায্য করছে। তহবিলের সুদের হার কম হওয়ার কারণে গ্রাহকেরা উপকৃত হচ্ছে, পাশাপাশি আমরাও উপকৃত হচ্ছি। তহবিলের কারণে আমাদের তারল্য সংকট সেভাবে নেই।

পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে অনেকেই এসএমই খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী হয় না। আপনারা বিষয়টি কীভাবে সামলাচ্ছেন?

আমি এসএমইতে ১১ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছি। অন্যদিকে আমার তহবিল সংগ্রহে ব্যয় হচ্ছে শতাংশ। ফলে এখানে আমাদের শতাংশ স্প্রেড থাকছে। অন্যদিকে করপোরেট ঋণে আমাদের স্প্রেড থাকে দুই থেকে আড়াই শতাংশ। ফলে স্প্রেড বেশি হওয়ার কারণে এসএমই খাতের বাড়তি পরিচালন ব্যয় আমরা সহজে সামলাতে পারছি। এছাড়া আমরা অটোমেশনের ওপর জোর দিয়েছি। সামনে অটোমেশনের ব্যবহার আরো বাড়বে। এতে আমরা জনবল না বাড়িয়েও এসএমই খাতের ঋণ পোর্টফোলিও বাড়াতে পারব। আগামী পাঁচ বছরে আমাদের ৫০টি উপশাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা আরো বেশি এসএমই গ্রাহককে সেবা দিতে পারব।

ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদ পাওয়ার কারণে মানুষ এনবিএফআইগুলোতে আমানত রাখতে আগ্রহী হয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার আমানতের সুদের চেয়েও বেশি। অবস্থায় বর্তমানে আপনারা কীভাবে আমানত সংগ্রহ করছেন?

এক্ষেত্রে একটু জটিলতা রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে পারে। অন্যদিকে ব্যাংকের ক্ষেত্রে ধরনের বিধিনিষেধ নেই। ফলে ব্যাংক যখন আগে কম সুদে আমানত নিত তখন কিন্তু আমরা সহজেই শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে অনেক ব্যাংকের আমানতের সুদহার শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে আমাদের পক্ষে শতাংশ সুদে আমানত পাওয়াটা কঠিন হয়ে গেছে। এটি এনবিএফআই খাতের তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ। ব্যাংক এনবিএফআইয়ের আমানতের সুদের হারে কোনো সীমা না থাকলে আমরা ব্যাংকের চেয়ে কিছুটা বেশি সুদ দিয়ে আমানত আকৃষ্ট করতে পারব। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের কারণে আইডিএলসিসহ আরো বেশ কয়েকটি শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকট তেমন একটা অনুভব করছে না। ফলে এসএমই ঋণের জন্য আমাদের আমানতের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে না।

এনবিএফআই খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই?

তারল্য সংকটের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানকেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে অনেকেরই অর্থ আদায় কার্যক্রমেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে অনেকেই ঋণ বিতরণ করা কমিয়ে দিয়েছে। এতে তাদের অর্থ আদায়ের পরিমাণও কমে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এমন কিছু খাতে ঋণ দেয়া হয়েছে যে সেখানে অর্থ আটকে গেছে। আপনার পোর্টফোলিওর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ যদি আটকে যায় তাহলে তো টিকে থাকা মুশকিল। সামনের দিনগুলোতে যদি অর্থ আদায় কার্যক্রমে গতি না আনা যায় তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়বে। তবে আমি আশাবাদী সামনের দিনগুলোতে অর্থ আদায়ের হার বাড়বে। এর কারণ হলো কভিডের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা ছিল সেটি কাটতে শুরু করেছে। ব্যবসা বাড়লে অর্থ বাড়বে এবং ঋণ পরিশোধের হারও বাড়বে।

ব্যাংকের মতো একই পণ্যের ব্যবসায় এনবিএফআইয়ের ঝোঁক বেশি। খাতভিত্তিক স্বতন্ত্র ব্যবসায়িক পরিচিতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়?

আমরা যেখানে মুনাফা পাই সেখানেই ব্যবসা করতে চাই। অনেক সময় আমাদের দক্ষতা কোথায় সেটি খুঁজে দেখি না। ৩৮ বছর ধরে ব্যবসা করার কারণে আমাদের বিভিন্ন খাতে দক্ষতা তৈরি হয়েছে। কারণে আমরা বিভিন্ন খাতে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছি। সব জায়গায় নিজেদের সম্পৃক্ত করছি এটা ঠিক না। যেখানে আমার দক্ষতা বেশি সেখানেই আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদের কথা চিন্তা করে ব্যবসা করা উচিত।

এনবিএফআই খাতের চ্যালেঞ্জ সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাই?

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তারল্য। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ। আর তৃতীয় দিকটি হচ্ছে সুশাসন। যদি তিনটি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তাহলে মুনাফা করা কোনো সমস্যাই নয়। এনবিএফআই খাতের ঋণ পোর্টফোলিওর আকার বর্তমানে ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে দেশের অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে। অবস্থায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?

আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। এটি শুধু আমাদের এখানেই নয়, বিশ্বব্যাপীই দেখা যাচ্ছে। সাপ্লাই চেইনেও একটা বড় প্রভাব দেখা যাচ্ছে। কভিডের পর পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যের ওপর প্রভাব পড়েছে। তবে আমি মনে করি এটি আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে কেটে যাবে। পদ্মা সেতুসহ সরকার অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে। আগামী বছর থেকে পদ্মা সেতুসহ এসব প্রকল্পের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে। সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কারণে গত দুই মাসে আমদানি ব্যয় কমে আসছে। ধারা বজায় থাকলে সামনে রফতানি আয় রেমিট্যান্সের অর্থ দিয়েই আমদানি দায় মেটানো সম্ভব হবে। এছাড়া রফতানির বিপরীতে যেসব আয় এখনো দেশে আসেনি সেগুলোও ধীরে ধীরে আসতে শুরু করবে। এতে সামনের দিনগুলোতে ডলারের সংকটও কেটে যাবে বলে আমি মনে করি।