বিশেষ সংখ্যা

মালিতে ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা

নূর ইসলাম হাবিব

মালির নাইজার নদীতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রিভারাইন ইউনিটের প্যাট্রলিং ছবি: আইএসপিআর

মালি পশ্চিম আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত একটি দেশ। এর আয়তন ১২ লাখ ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা কোটি ৪০ লাখ। রাজধানী বামাকো। মালির দক্ষিণ অঞ্চলে অধিকাংশ লোক বাস করে। দেশের অর্ধেকের বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। শতকরা ৯০ ভাগ লোক মুসলমান। দেশটির জনগণের প্রধান পেশা কৃষি মত্স্য আহরণ। প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ স্বর্ণ লবণ। প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস ইত্যাদি।

মালি একসময় শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ ছিল। সে সময় গণিত, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা শিল্পকলার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। ১৯ শতকের শেষ দিকে ফ্রান্স মালি দখল করে। ফ্রান্সের কাছ থেকে ১৯৬০ সালে মালি স্বাধীনতা লাভ করে। দীর্ঘদিন একদলীয় শাসনের পর ১৯৯০ সালে দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চা শুরু হয়।

২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে মালির উত্তরাঞ্চলে তুয়ারেগ বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এপ্রিলে তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা আযোয়াদকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। তারা উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয় এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মালি সরকারের অনুরোধে ফ্রান্স সরকার ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে তুয়ারেগ ইসলামী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করে। এক মাসের মধ্যে অঞ্চলের অধিকাংশের নিয়ন্ত্রণ মালি সরকার ফ্রান্স সেনাবাহিনীর হাতে চলে আসে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি এবং নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইব্রাহিম বোবাকার কিয়েতা প্রেসিডেন্ট মোদিবো কিয়েতা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর দি লিবারেশন অব আযোয়াদ মৌলবাদী ইসলামী গ্রুপগুলোর কাছে বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারায়। তবে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মালি ফ্রান্সের যৌথ বাহিনী ইসলামী গ্রুপগুলোর কাছ থেকে পুনরায় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তবে এখনো বিদ্রোহী গ্রুপগুলো মাঝেমধ্যে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে মালিতে প্রথম শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে। পরের বছর মালিতে মোতায়েন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ছিল হাজার ৭২২। এর মধ্যে সেনাবাহিনী হাজার ৩১০, নৌবাহিনী ১৩৩, বিমান বাহিনী ১২৩, পুলিশ ১৪০ স্টাফ অফিসার ১৬ জন। ২০১৭ সালে সংখ্যা দাঁড়ায় হাজার ৬৭৪-এ।

মেজর জেনারেল মো. সালাহ্ উদ্দিন মিয়াজীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি শুভেচ্ছা দল শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালের -১২ মে পর্যন্ত মালি ভ্রমণ করে। দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া, লে. কর্নেল মো. মোতাহার হোসেন, লে. কর্নেল মো. জাহেদুর রহমান, মেজর মোহাম্মদ ফিরোজ আহম্মেদ, মেজর মুনতাসির রহমান চৌধুরী, যুগ্ম সচিব কাজী মাহবুব হাসান, যুগ্ম সচিব শফিকুল আহম্মদ, সার্জেন্ট মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। আইএসপিআরের প্রতিনিধি হিসেবে আমিও সফরে ছিলাম। মে ভোরে আমরা মালির রাজধানী বামাকো পৌঁছাই। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান মালির সংসদ সদস্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মামাদো এনফা সিমপারা।

ওইদিন সকালে আমরা যাই লামিতি হোটেলে, যেটি এখন মালিতে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের ফোর্সেস হেড কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। শুভেচ্ছা দলটি দেখা করে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মালিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি মংগী হামদির সঙ্গে। তাছাড়া আমরা দেখা করি ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল মাইকেল ললেজ গার্ড চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান থিউভোল্টের সঙ্গে। পরে শুভেচ্ছা দলের প্রধান মেজর জেনারেল মো. সালাহ্ উদ্দিন মিয়াজী দেখা করেন মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এনজিও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুসা মারার সঙ্গে। তারা সবাই বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা বাংলাদেশী সেনাদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা, শৃঙ্খলা, সাহস পেশাদারির প্রশংসা করেন।

আমরা মে তারিখে গাও এবং কিদাল ভ্রমণ করি। কৌশলগত দিক থেকে এই শহর দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বামাকো থেকে কিদালের দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটার এবং গাওয়ের দূরত্ব ১৩০০ কিলোমিটার। নয়টি দেশের প্রায় ৩৪০০ শান্তিরক্ষী গাও সেক্টরে নিয়োজিত আছে। ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১৩৩ জন শান্তিরক্ষী এখানে নিয়োজিত আছে। তারা মালির ওপর দিয়ে প্রবাহিত নাইজার নদীর প্রায় ৯০০ কিলোমিটার নৌপথের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে এই নৌপথে নিরাপত্তার অভবে নৌ চলাচল বন্ধ ছিল। নৌ কন্টিনজেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর নৌপথে নিরাপত্তা ফিরে আসে এবং রুটে পুনরায় নৌ চলাচল শুরু হয়। মালিতে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস দর্শক ছয়টি স্পিডবোট কাজ করছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্যের একটি সিগন্যাল কন্টিনজেন্ট গাও সেক্টরে নিয়োজিত আছে। তারা সেক্টর ইস্ট, সেক্টর নর্থ সেক্টর হেডকোয়ার্টারের মধ্যকার টেলিযোগাযোগ স্থাপন, পরিচালন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন। এছাড়া গাও শহরের সরকারি কর্মকর্তা স্টাফদের যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করে যাচ্ছেন। গাও সেক্টরে ব্যানব্যাট- নিয়োজিত আছে। তারা বামাকো থেকে কিদালগামী রসদবাহী যানবাহন ব্যক্তিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তারা বেসামরিক জনগণ এবং গাও বিমানবন্দরের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করছেন।

কিদাল সাহারা মরুভূমিতে অবস্থিত। এখানকার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির ওপরে। এখানে ১৪০ সদস্যের ব্যান ইঞ্জিনিয়ার (বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার) কন্টিনজেন্ট নিয়োজিত আছে। তারা এখানে বিরূপ আবহাওয়া বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মরু অঞ্চল হওয়ায় এখানে রয়েছে তীব্র পানির সংকট। তারা দিনে জনপ্রতি মাত্র ১০ লিটার পানি পেয়ে থাকেন। বামাকো থেকে কিদালে রসদসামগ্রী সরবরাহ করা খুবই কঠিন। রাস্তাঘাট তেমন একটা নেই। যা আছে, তা খুবই বালুময় পাহাড়ি। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার কন্টিনজেন্ট এখানে বাংকারের নিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, রাস্তাঘাট নির্মাণ সড়কপথে টহলের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

কিদালে নিয়োজিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১২৩ সদস্যের ব্যানএয়ার কন্টিনজেন্ট। এখানে তারা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এয়ারফিল্ড ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তারা র্যাম্প কন্ট্রোল, মুভকন, আবহাওয়া সতর্কীকরণ, সীমিত পর্যায়ে অগ্নি নির্বাপণ ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এয়ার অপারেশন এয়ারফিল্ড ম্যানেজমেন্ট কাজে দক্ষতার জন্য এরই মধ্যে প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

ব্যানব্যাট--এর চিফ অপারেশন্স অফিসার লে. কর্নেল কাজী মো. জাকারিয়া মালিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেকগুলো সফল অভিযান সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন। একদিন লার্নেব এলাকায় বিবদমান দুটি বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের অবস্থান ছিল দিয়াবালি। এখান থেকে লার্নেব ৮০ কিলোমিটার দূরে। নিকটবর্তী বুরকিনা ফাসো ব্যাটালিয়নকে দুই দলের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে তাদের বাধ্য করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বুরকিনা ফাসো নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। অবস্থায় ফোর্সেস হেড কোয়ার্টার বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নকে দায়িত্ব পালনের জন্য সরাসরি নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পেয়ে জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাফার হিসাবে দুই দলের মাঝখানে অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত ব্যানব্যাট দুই দলকে নিবৃত করতে সক্ষম হয়। এভাবে তারা এখানে সৃষ্ট চরম উত্তেজনা হ্রাস করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।

তাবানকোট এলাকায় আযোয়াদ গ্রুপের পক্ষ-বিপক্ষ দুই দলের উদ্দেশ্য গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যানব্যাটকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সময় দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছিল। পেট্রল কমান্ডার দুই পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে বিদ্রোহীরা শান্তিরক্ষীদের ওপর গুলি চালায়। প্রতিউত্তরে শান্তিরক্ষী গুলি না চালিয়ে ধৈর্যের পরিচয় দেয়। সময় চারদিক থেকে গোলাগুলি আসছিল। কিন্তু মেজর সায়াদাত তার সৈন্যদের প্রত্যাহার করলেন না। তিনি জানতেন এখান থেকে তারা চলে গেলে বিদ্রোহীরা গ্রামে ঢুকে পড়বে এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। অবশেষে তারা গোলাগুলি থামাতে সক্ষম হয় এবং গ্রামের বেসামরিক জনগণের জীবন রক্ষা পায়। অভিযান প্রায় ৭৮ দিন ধরে চলে। অভিযানের সাফল্য বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের সাহস, ধৈর্য দৃঢ় মনোবলের পরিচয় বহন করে।

যুদ্ধোপযোগী যানবাহন না থাকায় সেক্টর নর্থ তাদের দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হয়ে পড়ে। সময় সেক্টর হেডকোয়ার্টার কোনো বিকল্প না দেখে কিদালগামী রসদবাহী যানবাহনকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার সড়কপথের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ব্যানব্যাটের ওপর ন্যস্ত করে। রুটকে সড়ক বলা যায় না। বরং এটি ছিল মরুময় পর্বতসংকুল পথ। তাছাড়া পথে রয়েছে মাইন বিস্ফোরণের আশঙ্কা, পানি প্রাপ্যতার অভাব, নৈশ বিরতিকালের আশ্রয়স্থলের অভাব ইত্যাদি। মাইন পুঁতে রাখার কারণে আনাফিস কিদালের মধ্যবর্তী পথটি ছিল খুবই বিপজ্জনক। ব্যানব্যাটের কাছে কোনো মাইনরোলারও ছিল না। এভাবে তারা অন্যের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে এবং সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি গাও শহরে অ্যান্টি আযোয়াদ গ্রুপগুলো সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে যাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল জাতিসংঘ মিশনের বিভিন্ন স্থাপনা। তারা একপর্যায়ে শান্তিরক্ষীদের ওপর ইটপাটকেল ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তাব্যূহ ভেঙে ফেলার উপক্রম করে। সময় দায়িত্বরত শান্তিরক্ষীরা ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। তারা বিভিন্ন উসকানির মধ্যেও পাল্টা হামলা না করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আলোচনা নন-লেথাল পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ফলে কোনো রকম জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই তাদের নিবৃত করা সম্ভব হয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

২০১৫ সালের ১০ মার্চ ৩৪টি বেসামরিক যানবাহনকে ব্যানব্যাট কর্তৃক নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রদানকালে ২০-২৫ জন দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করে। সময় তারা নৈশকালীন বিশ্রামে ছিলেন। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, মর্টার আইইডি। ব্যানব্যাট বিচক্ষণতার সঙ্গে তাদের হামলা বানচাল করে দেয় এবং বেসামরিক যানবাহন সংশ্লিষ্ট লোকদের রক্ষা করে।

কর্মদক্ষতা নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্যানব্যাট- জাতিসংঘ কর্তৃক প্রিমিয়াম অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে। জাতিসংগ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একমাত্র বাংলাদেশ ধরনের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেল। ব্যানব্যাট--এর ৮৫০ জনের সব সদস্য পুরস্কার পেয়েছেন।

বামাকোতে নিয়োজিত আছে ১২০ সদস্যের বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। তারা বামাকো থেকে ১৬০০ কিলোমিটার দূরে কিদালে রসদবাহী যানবাহনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। বিপত্সংকুল দুর্গম পাহাড়ি পথে রয়েছে মাইন বিস্ফোরণ সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলার ভয়। তাছাড়া বিরূপ আবহাওয়াও ছিল তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।

বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা অন্য দেশের শান্তিরক্ষীদের সাহায্য সহযোগিতার জন্যও প্রশংসিত হয়েছে। বামাকোর শান্তিরক্ষীদের ক্যাম্পে আমাদের কথা হয় মিসরের সেনা কর্মকর্তা কর্নেল হামদি এল গামালের সঙ্গে। বামাকোতে আসার প্রথম দিকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য তিনি বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য মেজর হাবিব ইবনে জাহানের কথা বিশেষ করে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাদের কাছ থেকে আমরা রেশনসামগ্রী, পানি, অন্যান্য খবার, বাসস্থান ইত্যাদি পেয়েছি। তারা সত্যিই আন্তরিক সহযোগিতামূলক। আমি হূদয় থেকে বলছি, বাংলাদেশীরা আমার ভাই। প্রথম দিকে আমাদের কিছুই ছিল না। তখন সবই পেয়েছি বাংলাদেশী ভাইদের কাছ থেকে।

বাংলাদেশের সেনাসদস্যরা স্থানীয় গরিব বেসামরিক জনসাধারণের পাশাপাশি অন্য দেশের শান্তিরক্ষীদেরও চিকিৎসা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। বিস্ময়করভাবে দেখা গিয়েছে, অন্য দেশের শান্তিরক্ষীরা বাংলাদেশ ক্যাম্পে আসছেন এবং চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। মেজর মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমরা অন্য দেশের শান্তিরক্ষীদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছি। আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আগত যেকোনো রোগীকেই চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি।

নরওয়ে সেনাবাহিনীর মেজর জুলসরাব বলেন, বাংলাদেশী চিকিৎসকরা খুবই আন্তরিক পেশাদার। এজন্য শুধু আমাদের দেশ নয় অন্য দেশের শান্তিরক্ষীরাও বাংলাদেশ ক্যাম্পে আসেন এবং চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন।

মালির শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেনাসদস্য এরই মধ্যে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ হয় এবং আমাদের শান্তিরক্ষীরা সফলভাবে তাদের প্রতিহত করে। এরই ধারাবাহিকতায় পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ দায়িত্ব পালন শেষে ক্যাম্পে ফেরার পথে তারা আবার আরো শক্তিশালী সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সাহসিকতা সফলতার সঙ্গে তারা পুনরায় সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করেন। তবে সংঘর্ষের একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে তিনজন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী শাহাদত বরণ করেন। শহীদ সেনাসদস্যরা হলেন সার্জেন্ট মো. আলতাফ হোসেন, ইএমই (দিনাজপুর), ল্যান্স করপোরাল জাকিরুল আলম শিকদার, আর্টিলারি (নেত্রকোনা), সৈনিক মো. মনোয়ার হোসেন, ইস্ট বেঙ্গল (বরিশাল) ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মালির রাজধানী বামাকোতে শহীদ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতিসংঘ কর্তৃক সম্মান প্রদর্শন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেনাসদস্যদের মরদেহ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বিকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে। মালিতে নিয়োজিত জাতিসংঘের ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল জ্যাঁ-পল ডিকোনিনক ওই বীর শান্তিরক্ষীদের সম্মান প্রদানের জন্য নিজেই মরদেহের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন।

পরবর্তী সময়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ভয়াবহ আইইডি বিস্ফোরণে চারজন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী নিহত এবং চারজন আহত হন। আহতদের মধ্যে আরো একজন শান্তিসেনা এপ্রিল ২০১৮ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মালিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মিশন হিসেবে বিবেচিত। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া মিশনে এরই মধ্যে ১১ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীসহ বিভিন্ন দেশের সর্বমোট ১৩৩ জন শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশে দুঃসাহসী শান্তিরক্ষীরা সর্বদা দেশের সম্মানের বিষয়টি মাথায় রেখে ঝুঁকিপূর্ণ এই মিশনে জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

নূর ইসলাম হাবিব: সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর