‘টিম
টিম করে
শুধু খেলো
দুটো বন্দরের
বাতি। সমুদ্রর
দুঃসাহসী জাহাজ
ভেড়ে না
সেথা; —তাম্রলিপ্ত
সকরুণ স্মৃতি।’ প্রেমেন্দ্র মিত্র ওই
টিমটিমে বাতিটুকুরও
আজ কোনো
অস্তিত্ব নেই।
মহাকালের অন্ধকার
গর্ভে হারিয়ে
গেছে সে।
এমনকি তার
নির্দিষ্ট অবস্থানও
অনেকটাই অনুমাননির্ভর।
অথচ সে
ছিল, খ্রিস্টের
জন্মের অনেক
আগ থেকেই
ছিল। ছিল
আফ্রিকান ভূগোলবিদ
টলেমির মানচিত্রে
‘তমালিটিম’
নামে, চৈনিক
পর্যটক হিউয়েন
সাংয়ের হাঁসের
পালকের কলমে
লেখা ‘তান-মো-লি’
নামে। এমনকি
ইউরোপীয় পর্যটকরা
যখন শীতঘুম
ভেঙে নতুন
পৃথিবী আবিষ্কারের
নেশায় সমুদ্র
অভিযানে নেমেছিল
তখনো সেদিন
পর্যন্ত তাদের
লগবুকে লেখা
ছিল এ
বন্দরের নাম।
কারণ, তাদের
প্রাচীন পূর্বপুরুষদের
এ বন্দরের
সঙ্গে যোগসূত্র
ছিল আরো
বহু শতাব্দী
আগে থেকেই।
বিশেষত রোমের
সঙ্গে এ
বন্দরের যোগাযোগ
মগধের উত্থানের
সময় থেকেই।
প্রাচীন ভারতের
বিশেষত ষোড়শ
মহাজনপদকালে মগধসহ
বেশকিছু রাজার
যেসব শ্বেতাঙ্গ
উপপত্নীদের কথা
বিভিন্ন কাব্যকাহিনীতে
পাওয়া যায়
তারা অনেকেই
ভারত ভূখণ্ডের
মাটিতে পা
রাখতেন এই
তমালিকা বন্দর
হয়ে। মাঝে
মাঝেই বাঘের
গর্জনে কেঁপে
উঠত বন্দর।
সিজারের আমলে
রোমের কলোসিয়ামে
গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে
লড়ার জন্য
‘সমতটের’
অর্থাত্ বাংলার
বাঘের চাহিদা
ছিল প্রচুর।
তমালিকা বন্দর
থেকেই তারা
পাড়ি জমাত
সুদূর রোমান
কলোসিয়ামে। তমালিকা
বন্দরে শার্দূল
সুন্দরীদের বিনিময়
হতো শ্বেতাঙ্গ
সুন্দরীদের সঙ্গে।
সিন্ধু সেচে
আনা মুক্ত
থেকে শুরু
করে মহামূল্যবান
রত্নরাজি, হাতির
দাঁত থেকে
সুগন্ধি মসলা,
রেশম, কথা
বলা পাখি
থেকে যুদ্ধের
ঘোড়া, অগুনতি
বিচিত্র সব
পণ্যসম্ভার যাওয়া-আসা
করত অর্ণবপোতে।
দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার প্রাচীনতম
বন্দর ছিল
তাম্রলিপ্ত বা
তমালিকা বন্দর।
আর তাকে
ঘিরে এক
বৃহত্ বাণিজ্যিক
জনপদ। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় তো
বন্দরের অভাব
ছিল না।
তবে কেন
একদিন শ্রেষ্ঠত্বের
শিরোপা গ্রহণ
করেছিল এই
বন্দর? তাহলে
আমাদের ফিরে
যেতে হবে
সেই ষোড়শ
মহাজনপদের কথাতেই।
ভারত ভূখণ্ডে
যে ষোলটি
মহাজনপদ বা
শক্তিশালী রাষ্ট্রের
উত্পত্তি ঘটেছিল
তার মধ্যে
সর্বাপেক্ষা শক্তিধর
ও সম্পদশালী
রাষ্ট্র হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করেছিল
কলিঙ্গ ও
মগধ। তাদের
মধ্যে সুসম্পর্ক
বিশেষ ছিল
না। একসময়
দীর্ঘকাল এ
বন্দর ছিল
কলিঙ্গপতির নিয়ন্ত্রণে।
শোনা যায়
সম্রাট অশোকের
কলিঙ্গ আক্রমণের
প্রধান উদ্দেশ্যই
নাকি ছিল
‘এই
বন্দরের ওপর
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’।
দুই মহাজনপদের
উত্থানের পর
তাদের বহু
পরিমাণ পণ্যসামগ্রীর
প্রয়োজন হয়ে
পড়েছিল। আবার
এই দুই
রাষ্ট্র নানান
মহাজনপদের নিয়ন্ত্রক
হয়ে ওঠাতে
সেখান থেকেও
বহু পণ্য
এসে জমা
হতো মগধ
ও কলিঙ্গে।
কিন্তু এই
দুই শক্তিধর
জনপদ নিজেদের
নিরাপত্তার কারণে
একে অপরকে
নিজেদের বন্দরের
ছায়া মাড়াতে
দিতে চাইত
না। আবার
ভিনদেশী বণিকরাও
এমন এক
বন্দরের সন্ধানে
ছিল যার
মাধ্যমে এই
দুই মহাজনপদের
সঙ্গেই বাণিজ্য
করা যায়।
তাই সমতটের
এ বন্দর
ধীরে ধীরে
আত্মপ্রকাশ করতে
থাকে ‘নিরপেক্ষ’
বন্দররূপে। যদিও
কলিঙ্গ ও
মগধ বিভিন্ন
সময় চেষ্টা
করেছে এই
বন্দরে তাদের
পূর্ণ কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠা করতে।
দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় যে
দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ছিল
তারাও গঙ্গার
মোহনায় এ
বন্দরকে নানা
কারণে তাদের
ব্যবসা-বাণিজ্যের
কেন্দ্র হিসেবে
বেছে নিয়েছিল।
বিশেষ করে
ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো
তাদের বন্দরে
বিদেশী জাহাজ
ভিড়তে দিতে
চাইত না,
পাছে তাদের
দ্বীপ বিদেশীরা
দখল করে
নেয় সেই
ভয়ে। আবার
অনেক বিদেশী
জাহাজ সেসব
দ্বীপে নোঙর
করতে চাইত
না লুণ্ঠনের
ভয়ে। তাছাড়া
সেসব সমুদ্রবন্দর
অনেক আগেই
ছিল ঝঞ্ঝাযুক্ত
অথবা অগভীর
খাতসমৃদ্ধ। আর
তমালিকা বন্দর
সে অর্থে
ছিল ঝড়ঝঞ্ঝামুক্ত,
শান্ত, নিরাপদ
ও গভীর
খাতসম্পন্ন। উত্তর-পূর্বের
পার্বত্য প্রদেশগুলোর
সঙ্গে বাণিজ্য
করার জন্যও
আদর্শ অবস্থান
ছিল এ
বন্দরের। এমনকি
হিমালয়-সংলগ্ন
চৈনিক ব্যবসায়ীরাও
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নিজেদের
চৈনিক উপকূলকে
পরিহার করে
বাণিজ্যের জন্য
বেছে নিয়েছিল
তাম্রলিপ্তিকে। এ বন্দরের
গুরুত্ব বৃদ্ধি
পেয়েছিল বৌদ্ধধর্মের
উত্থানের কারণেও।
সম্রাট অশোক
যখন বহির্বিশ্বে
বৌদ্ধ ধর্ম
প্রচারে সচেষ্ট
হন তখন
তিনি এ
বন্দরকেই বেছে
নিয়েছিলেন সে
কাজে। আবার
হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান
কালে এ
বন্দরের মাধ্যমেই
নানান দ্বীপরাষ্ট্রে
উপনিবেশ গড়ে
তুলে সেসব
স্থানে হিন্দু
ধর্ম ছড়িয়ে
দেয়ার চেষ্টা
করা হয়।
সে সময়
কলিঙ্গরাজ গুহসীব
বুদ্ধের পবিত্র
ধাতুদন্তটিকে ধ্বংসের
হাত থেকে
রক্ষা করার
জন্য গোপনে
এ বন্দরের
মাধ্যমেই সিংহলে
প্রেরণ করেন।
হিউয়েন সাংয়ের
বিবরণ অনুসারে
তিনি সমতট
থেকে পশ্চিম
দিকে নয়শ
লি পথ
পাড়ি দিয়ে
তমালিকা বা
‘তান-মো-লি’-তে
উপস্থিত হয়েছিলেন।
তার বিবরণ
অনুসারে এ
বন্দরটি যে
রাজ্যের মধ্যে
অবস্থিত ছিল
তার আয়তন
ছিল পনেরোশ
লি, রাজধানীর
আয়তন দশ
লি। অনেকে
মনে করেন,
হিউয়েন সাংয়ের
বিবরণে তাম্রলিপ্তিকে
একটি আলাদা
রাজ্য হিসেবেই
বর্ণনা করা
হয়েছে, কলিঙ্গের
অংশ হিসেবে
নয়। চৈনিক
পরিব্রাজকের বিবরণে
বলা আছে
যে বহু
মূল্যবান বস্তু
ও রত্নের
বাণিজ্যস্থল ছিল
বন্দরটি। বাঙালি ‘ইতিহাস-সচেতন’
জাতি নয়
বলে দুর্নাম
আছে। ধারাবাহিক
ইতিহাস রচনায়
দীর্ঘকাল অনাগ্রহের
কারণে বিতর্কও
তার পিছু
ছাড়ে না।
তাই খ্রিস্টপূর্ব
চতুর্থ থেকে
অষ্টম শতাব্দী
পর্যন্ত তাম্রলিপ্তি
নামের যে
বন্দর ছিল
তার প্রকৃত
অবস্থান নিয়েও
বিতর্ক আছে।
ইতিহাস গবেষকদের
মধ্যে এমন
কথাও কেউ
বলেছেন যে
তাম্রলিপ্তি বন্দরের
অবস্থান ছিল
বুড়িগঙ্গা নদীর
মোহনায়। তবে
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের
মতে, বর্তমান
ভারত রাষ্ট্রের
পশ্চিমবঙ্গের তমলুকের
আশপাশেই কোথাও
অবস্থিত ছিল
সেই বন্দর। কিন্তু এমন
কেন হলো
যে মহাকাল
আর তার
কোনো চিহ্নমাত্র
রাখল না?
অষ্টম শতাব্দী
পর্যন্তও এ
বন্দরের উপস্থিতির
সুস্পষ্ট প্রমাণ
মেলে দুধপানি
প্রস্তরলিপিতে। কিন্তু
তারপর কী
হলো? যে
সমৃদ্ধিশালী বন্দরের
জন্য পাটলিপুত্র
থেকে তাম্রলিপ্তি
পর্যন্ত সড়ক
নির্মাণ করেছিলেন
মৌর্য সম্রাট,
ভারত ভূখণ্ডের
অর্থনীতির অন্যতম
প্রধান নিয়ন্ত্রক
তমালিকা বন্দর
কোন জাদুমন্ত্রবলে
পুরোপুরি মুছে
গেল? অদ্ভুত
ব্যাপার হলো
এ প্রশ্নের
কোনো সুস্পষ্ট
জবাব নেই।
যা আছে
তা সবই
অনুমাননির্ভর। কেউ
কেউ মনে
করেন যে
পথে তাম্রলিপ্তি
বন্দরের উত্থান
ঘটেছিল সে
পথেই হারিয়ে
গিয়েছিল এই
বন্দর। ষোড়শ
মহাজনপদগুলো ভেঙে
টুকরো টুকরো
হয়ে জন্ম
নেয় বহু
স্বাধীন রাজ্যের।
নতুন এ
রাজ্যগুলো আপন
আপন সুবিধামতো
রচনা করে
বাণিজ্যের নানা
অভিমুখ। প্রাচীন
যুগের শেষ
পর্যায় বা
মধ্যযুগের পদার্পণলগ্নে
স্থাপিত হতে
থাকে নানান
নতুন বন্দর।
কালিকট থেকে
সপ্তগ্রাম বা
সাতগাঁও বন্দর।
স্থল বাণিজ্যেরও
প্রভূত উন্নতি
হতে শুরু
করে। পঞ্চদশ
শতকে যখন
পর্তুগিজ ভাস্কো-ডা-গামা
ভারতে আসে
তখন তাম্রলিপ্তি
বন্দর তার
কৌলীন্য হারিয়েছে।
ভাস্কো পনেরোশ
চব্বিশ খ্রিষ্টাব্দের
ফেব্রুয়ারি মাসে
গোয়ার গভর্নর
হিসেবে শপথ
গ্রহণের কিছুদিন
আগে তার
অনুচরদের তমালিকা
বন্দরে পাঠিয়েছিলেন।
তখন তমালিকা
বন্দর পর্যবেক্ষণ
করে তারা
ভাস্কোর কাছে
যে রিপোর্ট
পেশ করেন
তাতে বলা
হয় তমালিকা-তাম্রলিপ্তি
বন্দর তখন
মৃতপ্রায়। শুধু
বণিকদের আকর্ষণ
করার জন্য
বন্দর বেশ্যালয়গুলো
সেখানে টিকে
ছিল। টিম
টিম করে
জেগে থাকা
তাম্রলিপ্তি বন্দরে
তখন শুধু
দেহবাণিজ্যই হতো।
নাব্যতা কমে
যাওয়ায়, বাণিজ্যেরও
তেমন সম্ভাবনা
না থাকায়
সেখানে থিতু
হতো না
কোনো বাণিজ্যপোত।
বরং তখন
এ বন্দরকে
পাশ কাটিয়ে
নদীপথ বেয়ে
চলে যেত
উদীয়মান সপ্তগ্রাম
নদীবন্দরের দিকে।
তমালিকা বন্দরের
শেষ বাসিন্দা
সমুদ্রবেশ্যার দল
উদার নয়নে
চেয়ে থাকত
সেসব অর্ণবপোতের
দিকে। তাম্রলিপ্তিতে
আর তরী
ভিড়ত না।
তারা চলে
যেত সাতগাঁওয়ে।
পর্তুগিজ নাবিকরাও
তাম্রলিপ্তিকে পরিহার
করে গিয়ে
উপস্থিত হতো
সপ্তগাঁওয়ে। বর্তমানে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের
হুগলি জেলার
ব্যান্ডেল নগরী
থেকে তিন
কিলোমিটার দূরে
অবস্থিত ছিল
নতুন এ
বন্দরটি। সরস্বতী
নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম
তীরে সরস্বতী
ও হুগলি
নদীর সঙ্গমস্থলেই
ছিল সাতগাঁও
বন্দরের অবস্থান।
মধ্যযুগে ইসলামী
শাসকরা প্রভূত
উন্নতি সাধন
করল সাতগাঁও
বন্দরের। নানা
সুযোগ-সুবিধা
লাভের কারণে
ইউরোপীয় ও
আরব নাবিকরা
যাওয়া-আসা
শুরু করল
এ বন্দরে।
সাতগাঁও পরিণত
হলো বাংলার
প্রধান বন্দরে।
আর ক্লান্ত-নিঃসঙ্গ
তমালিকা-তাম্রলিপ্ত
বন্দর ইতিহাসের
পাতায় শুধু
রয়ে গেল
সকরুণ স্মৃতি
হয়ে। সাগরের
দুঃসাহসী জাহাজ
আর কোনোদিন
ভিড়বে না
সেখানে।
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত: কথাসাহিত্যিক