সিল্করুট

প্রাচীন সাহিত্য রচনায় তাম্রলিপ্ত থেকে তমলুক

বিধান হালদার


প্রাচীন সাহিত্য লেখমালায় বর্ণিত অনেক বিখ্যাত শহর বা নগরের স্থান বর্তমানের মানচিত্রে চিহ্নিত করা খুব কঠিন একটা কাজ। তবে একটা ধারণা পাওয়া যায় সেই শহর বা নগরের। বিভিন্ন সাহিত্য, পর্যটকদের বিবরণী লেখমালার ধারণা নিয়েই গাঙ্গেয় মোহনা অঞ্চলের প্রাচীন আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্তের কথা জানা যায়। ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিকরা সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই ভারতবর্ষের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকে তাম্রলিপ্ত বন্দরের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। অঞ্চলে মানব বসতির ইতিবৃত্তের কথা জানা যায় মোটামুটিভাবে চতুর্থ-তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আট খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে মধ্যে। বন্দর হিসেবে অঞ্চলের সর্বশেষ তথ্য জানা যায় হাজারিবাগ জেলায় দুধপানি পাহাড়ের আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর একটি শিলালিপিতে।

মহাভারতের তাম্রলিপ্ত হোক আর বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর তমলুক এই দুইয়ের মাঝখানে যে সময় অতিবাহিত হয়েছে তার কিছু ইতিহাস তত্কালীন সময়ের রচনায় তাম্রলিপ্তকেনানা নামে পাওয়া যায়তাম্রলিপ্তি, তাম্রলিপ্ত, তামলিপ্তি, তাম্রলিপ্তক, তমালিনী, বিষ্ণুগৃহ, স্তম্বপুর, তামালিকা, বেলাকুল, তামোলিত্তি, দামলিপ্ত, টামালিটেস (Tamalites), টালকটেই (Taluctae), তম্বুলক ইত্যাদি।

অঞ্চলের বেশ কয়েকবার প্রত্নতাত্ত্বিক উত্খনন অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, মধ্যপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতি থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়জুড়ে তমলুকে মানব বসতি, সমৃদ্ধ সমাজজীবন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।

মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে ভীম কর্তৃক মুদগগিরি, পুন্ড্র, বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত এবং সুহ্মজনপদ রাজাদের পরাজয়ের কথা আছে। শঙ্খজাতক, সমুদ্দবাণিজজাতক, মহাজনকজাতক ইত্যাদি গল্পে দেখা যায় মধ্যদেশের বণিকরা বারাণসী বা চম্পা হইতে জাহাজে করিয়া গঙ্গা-ভাগীরথী পথে তাম্রলিপ্ত আসত এবং সেখান থেকে বঙ্গসাগরের কূল ধরে সিংহলে, অথবা উত্তাল সমুদ্র অতিক্রম করে সুবর্ণভূমিতে (ব্রহ্মদেশ) যেত।

ভৌগোলিক টলেমি (১৫০ খ্রি.) তার আন্ত-গাঙ্গেয় (India Intra Gangem) ভারতবর্ষের নকশা বিবরণীতে তদানীন্তন গঙ্গা-প্রবাহের সাগরসঙ্গমে গাচটি মুখের উল্লেখ করেছেন। টলেমির নকশা বিবরণ নানা দোষে দুষ্ট এবং সর্বত্র সব বিষয়ে খুব নির্ভরযোগ্যও নয়। তবু তার সাক্ষ্য এবং পরবর্তী ঐতিহাসিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু অনুমান ঐতিহাসিকরা করেছেন এবং এসব মোহনা অবলম্বনে প্রাচীন ভাগীরথী-পদ্মার প্রবাহপথেরও কিছু আভাস দিয়েছেন। নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় মোহনাগুলোকে যথাক্রমে . তাম্রলিপ্ত-নিকটবর্তী গঙ্গাসাগর মুখ, . আদিগঙ্গা বা রায়মঙ্গল-হরিয়াভাঙ্গা মুখ, . কুমার-হরিণঘাটা মুখ, . দক্ষিণ সাহাবাজপুর মুখ এবং . সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম-মধ্যবর্তী আড়িয়ল খাঁ নদীর নিম্নতম প্রবাহমুখ বলে মনে করেন। টলেমি টামালিটেস বা তাম্রলিপ্তের কথা উল্লেখ করলেও ভারত-রোমান বাণিজ্যের কথা তেমন উল্লেখ করেননি।

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর কাং-তাই রচিত ফু-নান-চুয়ান গ্রন্থের অনুসারে গঙ্গা নদীর মোহনায় তান-মেই অর্থাত্ তাম্রলিপ্ত অবস্থিত। তত্কালীন সময় থেকে তাম্রলিপ্ত এবং চীনের সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। ফা-হিয়েনের মতে, তাম্রলিপ্ত রাজ্যের রাজধানী তাম্রলিপ্ত নগরী একটি সামুদ্রিক বন্দর। ফা-হিয়েন দীর্ঘ দুই বছর তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের অনুলিপি তৈরি বৌদ্ধ মূর্তির ছবি আঁকেন। তার বিবরণী থেকে জানা যায়, সময় তাম্রলিপ্তিতে চব্বিশটি বৌদ্ধ মঠ অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন।

বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু, পণ্ডিত, পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের (৬০২-৬৬৪ খ্রি.) মতে, তিনি যখন রাজ্য থেকে প্রায় ৯০০ লি (লি হলো চৈনিক দূরত্ব মাপার একক , বর্তমানে লি সমান ৫০০ মিটার) পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে তিনি যে রাজ্যটিতে পৌঁছান তার নাম তান-মো-লি-টি বা তাম্রলিপ্ত। রাজ্যটির আকার প্রায় ১৪০০-১৫০০ লি। রাজধানীর আয়তন প্রায় ১০ লি। তিনি যখন এখানে ভ্রমণ করেন রাজ্যে প্রায় ১০টির মতো বৌদ্ধবিহার ছিল এবং সেখানে প্রায় ১০০০ বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকতেন এবং শহরের কাছেই অশোকের তৈরি একটি স্তূপ আছে। আজ পর্যন্তও স্তুপটিকে চিহ্নিত করা যায়নি।

মহাকর্মবিভঙ্গ তাম্রলিপ্ত থেকে সুবর্ণভূমি পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রায় বণিকদের অভিজ্ঞতাকে সমুদ্রযাত্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিচর্যার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে। জৈনদের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ কল্পসূত্রে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গুরু ভদ্রবাহুর এক শিষ্য গোদান প্রাচ্য-ভারতের জৈন সন্ন্যাসীদের তিন-তিনটি শাখার উল্লেখ আছেতাম্রলিপ্ত শাখা, কোটিবর্ষ শাখা, পুন্ড্রবর্ধন শাখা। তিনটি শাখার নামই বাঙলার দুটি জনপদ এবং একটি নগর থেকে উদ্ভূত। বরাহমিহির (আনুমানিক, ষষ্ঠ শতাব্দী) গৌড়ক, পৌন্ড্র, বঙ্গ, সমতট, বর্ধমান এবং তাত্রলিপ্তক নামে ছয়টি স্বতন্ত্র জনপদের উল্লেখ করেছেন। আনুমানিক ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে সাহিত্য কীর্তি দণ্ডীর রচিত দশকুমারচরিতে তাম্রলিপ্তের নিকটবর্তী সমুদ্রে এক জবন নাবিকের দ্বারা এক অর্ণবযানের কথা বলা হয়েছে শুধুমাত্র। দশকুমারচরিতের মতে দামলিপ্তসমৃদ্ধ ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র সামুদ্রিক বন্দর, গঙ্গার তীরে, সমুদ্রের অদূরে অবস্থিত। একাদশ শতাব্দীর লেখক সোমদেবের কথাসরিত্সাগরের একটি গল্পে দেখা যায়, তাম্রলিপ্ততে সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য সবসময় ব্যস্ততা লক্ষ করা যায় এবং এখানকার বড় বড় জাহাজ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দেয় এবং প্রচুর লাভ করে।

দুধপানি পাহাড়ের লিপিতে বলা হয়েছে, বাণিজ্য উপলক্ষে তিন ভাই অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্তিতে এসে কিছুকালের মধ্যে প্রচুর ধনরত্ন উপার্জন করে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।

তাম্রলিপ্তর অবস্থান যে সমুদ্র-মোহনা থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না, সম্বন্ধে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। সে বন্দর থেকে বেশ বড় একটি সমুদ্রগামী জাহাজে চড়ে ফা-হিয়েন সিংহল এবং ইিসঙ শ্রীভোজ বা শ্রীবিজয়রাজ্যে (সুমাত্রা-যবদ্বীপ) গিয়েছিলেন। ফা-হিয়েন শীতের সময় ১৪ দিনে তাম্রলিপ্ত থেকে সিংহলে পৌঁছান।

তাম্রলিপ্তের সঙ্গে শুধু জলপথে নয়, স্থলেও বেশ ভালো যোগাযোগের রাস্তার কথা জানা যায় বিভিন্ন বিবরণে। ফা-হিয়েন ভারত ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে সীমান্ত রাজ্য চম্পার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। তার গন্তব্যস্থল ছিল সে সময়ের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বন্দর তাম্রলিপ্ত বন্দর। হিউয়েন সাংয়ের বিবরণ অনুযায়ী তিনি সমতট থেকে প্রায় ৯০০ লি পশ্চিমে তাম্রলিপ্তি রাজ্যে পৌঁছান। অর্থাত্ সেই প্রদেশ থেকে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ রাস্তা ছিল। সপ্তম শতাব্দীর শেষে আগত চৈনিক পরিব্রাজক ইিসঙ (৬৭৩ খ্রি.) তাম্রলিপ্ত থেকে বোধ গয়া পর্যন্ত একটি রাস্তার কথা বলেছেন। দুধপানি পাহাড়ের শিলালিপিতে অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ রাস্তার কথা বলা হয়েছে।

তাম্রলিপ্তর সঙ্গে নদী স্থলপথে উত্তর ভারত দাক্ষিণাত্যের যোগ থাকার ফলে বন্দর হিসেবে এর বিশাল পশ্চাদভূমি ছিল। সমুদ্রপথে সিংহল, সুবর্ণভূমি, মালেশিয়া, চীন এমনকি ফুনান (কম্বোডিয়া, দক্ষিণ ভিয়েতনাম) দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সম্রাট অশোক তাম্রলিপ্ত থেকে মহেন্দ্র সঙ্ঘামিত্রাকে বোধিবৃক্ষের চারাসহ সমুদ্রপথে সিংহল প্রেরণ করেন। মহাবংশ-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী সম্রাট অশোকের সময় থেকেই সিংহলের সঙ্গে তাম্রলিপ্তর যোগাযোগ ছিল।

রাজনৈতিকভাবে তাম্রলিপ্ত যথাক্রমে মৌর্য সাম্রাজ্য, আঞ্চলিক রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, শশাঙ্কের গৌড় রাজ্য ইত্যাদির অধীনে ছিল।

নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি দেবপালের নালন্দা লিপিতেও বঙ্গসাগর বাহিয়া এক সমুদ্রপথের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তখন তাম্রলিপ্ত বন্দর অবলুপ্ত; বাঙলার আর কোনো সামুদ্রিক বন্দরের উল্লেখও পাওয়া যায় না। অষ্টম শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে প্রাচীন ভারতের তথ্যসূত্রে তাম্রলিপ্তের উল্লেখও আর পাওয়া যায় না। সপ্তম শতাব্দীর শেষের দশক থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝির মধ্যে একমাত্র সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্তের সৌভাগ্য চিরতরে ডুবে গেল। সরস্বতী নদীর প্রাচীন খাত বন্ধ হওয়া এর একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। এর পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যবহারযোগ্য সামুদ্রিক পথ এই সময় সমন্দর (চট্টগ্রাম) বন্দরের গুরুত্ব বাড়ছিল।

আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের এক বিবরণে তাম্রলিপ্তকে চলিত ভাষায় তমলুক বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও ভাষাতত্ত্বের বিচারে তাম্রলিপ্ত থেকে তমলুক হওয়া খুব মুশকিল। প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মনে করা যেতে পারে বর্তমান তমলুক অঞ্চলই প্রাচীন তাম্রলিপ্ত। যেহেতু বর্তমান তমলুক শহরের অবস্থিতি রূপনারায়ণ-উপত্যকায়, প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিকরা মেনে নিয়েছেন যে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত নদীটির ওপর, সমুদ্র-মোহনার অনতিদূরে অবস্থিত ছিল। একটা কারণ ছিল বোধ হয় হিউয়েন সাং সাক্ষ্য, তাম্রলিপ্ত ছিল সমুদ্রের এক খাড়ির ওপরে।

অষ্টম শতাব্দীর পরবর্তী প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বন্দরের গুরুত্ব হয়তো তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উত্পাদন, স্থানীয় ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র বাজার বাজারের কাঠামোগত পদ্ধতির উন্নতি, বিনিময় মাধ্যমের প্রসার, জীবিকা অর্জনের নানা উদ্ভাবন, নানা দিক থেকে বিভিন্ন বস্তুর আমদানি, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাংস্কৃতিক বৈবাহিক সম্পর্ক, বিভিন্ন শিল্পকলায় বাইরের প্রভাব, শিক্ষায় উন্নতি বিভিন্ন পরিকাঠামোর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তাম্রলিপ্ত বন্দরের প্রভাবে। তাই পূর্ব ভারতের ইতিহাসে প্রাচীন আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অমূল্য।

 

বিধান হালদার: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ বিবেকানন্দ মিশন মহাবিদ্যালয়