পূর্ব ভারতের উপকূলীয় অঞ্চল বা প্রাচীন বাংলার একটি অন্যতম বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তি নামটি অনন্য উচ্চতায় আসীন। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভারতীয় বণিকদের মধ্যে দূরপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক যাতায়াতের ট্রানজিট রুট রূপে বন্দরটির বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলার সরব উপস্থিতি এবং সমুদ্রবাণিজ্যের স্বর্ণযুগ সৃষ্টিতে তাম্রলিপ্তির ‘সেলুটারি রোল’ আজও সগৌরবে ধ্বনিত হয়। বিভিন্ন
সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বর্তমান মেদিনীপুরের তমলুক অঞ্চলই তাম্রলিপ্তির অভিন্ন সত্তার পরিচয় বহন করে। এক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উত্খননে প্রাপ্ত বস্তুগত নিদর্শনগুলোই এ সঠিকতা নিরূপণের অন্যতম একক। মহাভারতে একটি পৃথক রাজ্যরূপে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এ অঞ্চল ছিল বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। দশকুমারচরিত গ্রন্থে একে সূক্ষ্মের সংলগ্ন দেশরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। টলেমি তাম্রলিপ্তিকে গঙ্গা নদীর তীরের পাঁচটি শহরের একটি হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রকৃতপক্ষে তাম্রলিপ্তির অবস্থান ছিল পাটলিপুত্র থেকে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে সমুদ্রমুখের কাছাকাছি গঙ্গা নদীর তীরে। তৃতীয় শতকে কাংতাই রচিত ফু-নান-চুয়ান গ্রন্থের সাক্ষ্য অনুসারে তি-এন-চু বা হুয়াং-চি বা গঙ্গার মোহনা অঞ্চলে ছিল তানমেই (তাম্রলিপ্তি) রাজ্য। মত্স্য
ও বায়ু পুরাণ মতে, গঙ্গার অন্যতম শাখা ভাগীরথী তাম্রলিপ্তির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং সমুদ্রমুখের অতি নিকটেই গঙ্গার তীরে ছিল সুবিখ্যাত বৃহত্ বন্দরটির অবস্থান। তাম্রলিপ্তি
শব্দটি তাম্র ও লিপ্ত দুটো সংস্কৃত শব্দের সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে। সংযুক্ত শব্দটির অর্থ তামায় পরিপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের হুগলির অদূরে রূপনারায়ণ জংশন থেকে ১২ মাইল দূরে মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত তামলুকই মূলত তাম্রলিপ্তি। রূপনারায়ণ নদী ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলেই বন্দরটির অবস্থান ছিল বলে অধিকাংশ পণ্ডিতের অভিমত। অবস্থানগত এ বৈশিষ্ট্যের জন্য একে দ্রোণমুখী বন্দর রূপে চিহ্নিত করা হয়। সম্মুখে অবারিত সমুদ্রপথ, সমৃদ্ধ গাঙ্গেয় বদ্বীপ, নদীজ অন্তর্জাল, উর্বর পশ্চাদভূমি বাংলা থেকে সিংহল, সুবর্ণভূমি অথবা দূরপ্রাচ্যের মতো দূরবর্তী ভূখণ্ডের সঙ্গে তাম্রলিপ্তির অনুকূল মেরিটাইম ট্রাফিক তৈরিতে সহায়তা করেছিল। ফলে বিভিন্ন যুগে (মৌর্য থেকে গুপ্ত-পরবর্তী) এ বন্দর পণ্য আমদানি-রফতানির উত্সভূমি রূপে স্বমহিমায় আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৫৪-৫৫ ও ১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক উত্খননের ভিত্তিতে এ অঞ্চলে তাম্রলিপ্তি নাম সমন্বিত লেখার আবিষ্কার হয়। কেএন দীক্ষিত, টিএন রামচন্দন পৃথকভাবে এখানে খননকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরেশচন্দ্র দাস গুপ্তের নেতৃত্বে ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ খননকার্য পরিচালিত হয়। বিভিন্ন সময়ের উত্খননের ফলে এখানে অনেক অমূল্য প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্তিম ও কৃষ্ণ মৃত্পাত্র, ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা, রুলেটেড মৃত্পাত্র, কাচের পুঁতি, জেসপার, অ্যাগেট, কার্নেলিয়ান, অ্যামেথিস্ট, ইচড় পুঁতিসহ বিভিন্ন মূল্যবান পুঁতি, পোড়ামাটির ফলক, খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী লেখসংবলিত পোড়ামাটির সিলের ভগ্নাংশ ইত্যাদি। উল্লিখিত প্রত্ন নিদর্শনগুলো তত্সংলগ্ন স্থানে একটি গুরুত্বপূর্ণ নগর সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে। শুধু তা-ই নয়, একই রকম নিদর্শন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন প্রত্নস্থলেও পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ার কুয়ালা সেলিসিং, তাঞ্জোর রাওয়া, কেদা, বুকিট তেংগু লেম্বু, ইন্দোনেশিয়ার কোবাক কেণ্ডাল, খিয়ান লুক পাত, থাইল্যান্ডের ইউ-থং, বান-ডোন-তা-ফেট, ভিয়েতনামের ওকি-ইও প্রভৃতি স্থানে একই ধরনের প্রত্ন-নিদর্শনের সন্ধান মিলেছে। সাদৃশ্যপূর্ণ এ নিদর্শনগুলো বা প্রাচীনকালের বাংলা অঞ্চলের সঙ্গে স্বর্ণের ভূমিরূপে স্বীকৃত সুবর্ণদ্বীপ বা সুবর্ণভূমির বাণিজ্যিক যোগাযোগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যেরই দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। ইউরোপের
সমৃদ্ধ অঞ্চল গ্রিস ও রোমের সঙ্গেও তাম্রলিপ্তি বন্দরের মাধ্যমেই ভারতের যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বজায় ছিল। এ সমুদ্রপথ আফ্রিকা ও আরবের অন্যান্য সমুদ্রপথের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কারণ ওইসব দেশ থেকে ভারতে আসতে গেলে পরিব্রাজকদের লোহিত সাগর ও আরব সাগরের নানা বন্দর পাড়ি দিতে হতো। এভাবে তারা ভারতের উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থিত ভরুকচ্ছ বন্দর অতিক্রম করে পূর্ব ভারতের তাম্রলিপ্ত বন্দরে যেত। এভাবেই বাংলা অঞ্চল ইন্দো-রোমান বাণিজ্য সংযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বন্দরটির ব্যবসায়িক যোগ ছিল অতি নিবিড়। অবশ্য খননকার্যের ফলে উদ্ঘাটিত নানা প্রত্ন নিদর্শন অপেক্ষা গবেষকদের কাছে প্রাচীন গ্রন্থে লিখিত তাম্রলিপ্তির তথ্যবহুল বর্ণনা বেশি পাওয়া যায়। আর এজন্যই বাংলার অতীত গৌরবের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাম্রলিপ্তির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হওয়া অতীব জরুরি। খ্রিস্টপূর্ব
যুগে তাম্রলিপ্তি বন্দরটি মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য তখন এটি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর হিসেবে পরিগণিত হয়। অর্থশাস্ত্রের তথ্য অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এ বন্দরের মাধ্যমে সুবর্ণভূমির সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য পরিচালিত হতো। মৌর্য সম্রাট অশোক তার সাম্রাজ্যকে গঙ্গার মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন এবং সে সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধিতে তাম্রলিপ্তি প্রধানতম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এছাড়া
জৈনদের গ্রন্থ বৃহত্কল্পসূত্রভাষ্যে উল্লেখ আছে যে তাম্রলিপ্তি ছিল বঙ্গ জনপদের রাজধানী। জাতকের নানা গল্পে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও বাণিজ্যের প্রসারে তাম্রলিপ্তি থেকে নানা গন্তব্যে ধর্মপ্রচারক ও বণিকদের যাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায়। এভাবে মৌর্য ও পরে কুশান যুগে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বন্দরটি আত্মপ্রকাশ করে। মৌর্য
সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলিপুত্রের সঙ্গে সড়কপথে তাম্রলিপ্তির সরাসরি সংযুক্তি ছিল। প্রথম শতাব্দীর রোমান দার্শনিক ও পরিব্রাজক প্লিনি তার Natural History গ্রন্থে Taluctae নামে স্থানটির উল্লেখ করেছেন। একইভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর সিংহলি মহাকাব্য মহাবংশে তাম্রলিপ্তির প্রসঙ্গ এসেছে, যেখানে বর্ণিত হয়েছে যে সম্রাট অশোক তার দূত মারফত একটি বোধিবৃক্ষ তাম্রলিপ্তি বন্দর থেকে সিংহলে পাঠিয়েছিলেন, যেটি সমুদ্রপথে ১৪ দিন ভ্রমণ করে সেখানে পৌঁছে। জাতকের গল্পগুলোতে বারাণস, চম্পা, পাটলিপুত্র প্রভৃতি নগরের সঙ্গে নৌকা করে এ বন্দরের বাণিজ্য চালু ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এভাবে নদীপথে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বিকাশেও এ বন্দরের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। গুপ্তযুগেও
বঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার অব্যাহত ছিল। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পরে মহান সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত বাংলাসহ প্রায় পুরো ভারতবর্ষ অধিকার করেছিলেন। সুতরাং এ সময়ে বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তির গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। কালিদাসের রঘুবংশ ও বরাহমিহিরের বৃহত্সংহিতায় গুপ্তযুগের একটি উল্লেখযোগ্য বন্দর হিসেবে এর প্রসঙ্গ এসেছে। চতুর্থ শতকে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তার ভারত অভিমুখে যাত্রার জন্য একটি অন্যতম বন্দর হিসেবে এর উল্লেখ করেন। বস্তুত গুপ্ত যুগেই চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এখান থেকে একটি বাণিজ্য জাহাজে করে ফা-হিয়েন চীনে গিয়েছিলেন। তাম্রলিপ্তি থেকে রফতানিজাত পণ্যের তালিকায় ছিল উঁচু দরের সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র, মসলিন, গাঙ্গেয় সুগন্ধি তেল, রেশমপণ্য, হিমালয় অঞ্চলজাত তেজপাতা, মুক্তা প্রভৃতি। এভাবে ধাপে ধাপে বন্দরটি চতুর্থ শতাব্দীর দিকে ভারতের পূর্বাংশের একটি প্রভাবশালী বন্দরে পরিণত হয়। এ
সময় বাংলার বণিক সম্প্রদায় পূর্ব ও দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপ ও দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্বন্ধ সম্প্রসারণের মাধ্যমে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা শক্তিশালী করে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে মালয় উপদ্বীপে প্রাপ্ত মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের শিলালিপি যেন এ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডেরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এই নাবিক তাম্রলিপ্তি থেকে মালয় উপদ্বীপে গিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক সম্বন্ধের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে তাম্রলিপ্তিকেন্দ্রিক ধর্ম সাধনা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। বহু চৈনিক শ্রমণ বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের জন্য এখানে এসেছিলেন। পরিব্রাজক ফা-হিয়েন পঞ্চম শতাব্দীতে তাম্রলিপ্তিতে আসেন এবং প্রায় দুই বছর এ বন্দরে অবস্থান করেন। গুপ্তযুগে বাংলায় প্রচুর অর্থাগম হতো। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ব্যাপক ব্যবহারও এ যুগে পরিলক্ষিত হয়। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত স্বর্ণ সমুদ্রপথে এ বন্দর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতে আসত। এ সময় বাংলায় ভূমি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গুপ্ত-পরবর্তী সময়ে (৫২০ খ্রিস্টাব্দের পর) বাংলার রাজনীতি ও ক্ষমতার রদবদল সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। সে সময়ে রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে বাংলা অঞ্চল ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন ছিল না এবং মৌর্য বা গুপ্ত শাসনামলের মতো এ সময়ে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও স্থিতিশীল ছিল না। ফলে পরবর্তী যুগে মুদ্রারীতি তার পুরনো গৌরব হারাতে শুরু করে। ৬০৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাম্রলিপ্তিসহ বাংলা শশাঙ্কের অধীনে আসে এবং এ সময়কালে মধ্য ও উত্তর ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং বাংলা ভ্রমণ করেন এবং তিনি উল্লেখ করেন যে সপ্তম শতাব্দীর বাংলায় কজঙ্গল, পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্তি ও সমতট ছিল বাংলার স্বতন্ত্র রাজ্য (বিল ২০০৩, ২০৩)। ধারণা করা যায়, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এ রাজ্যগুলো স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল (রায় ১৯৯৩, ৪৮২)। ইৎ সিংয়ের বর্ণনায়ও তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ৬৭৩-৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ সময়ে ভারতে ভ্রমণকালে তাম্রলিপ্তিতে পাঁচ মাস অবস্থান করে শব্দবিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি তাম্রলিপ্তিকে একটি প্রধান বন্দর ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন। তার বর্ণনায় চীন থেকে ভারতে আসার দুটো পথের বিষয়ে জানা যায়। একটি খোটান থেকে উত্তর ভারতের মধ্য দিয়ে এবং অন্যটি দক্ষিণে সমুদ্রপথে মালাক্কা, কাথাহা (পুরনো কেদা), পেগু
ও তাম্রলিপ্তি হয়ে ক্যান্টন থেকে কোন্দর
(কুনলুন) পর্যন্ত। এখানে নিকোবর থেকে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত ৯০০ থেকে ৯৬০ কিলোমিটার দূরত্ব, যা জাহাজে পাড়ি দিতে ১৫ দিনের মতো সময় লাগে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে বাংলার গৌরব হ্রাস পেতে শুরু করে। গুপ্তযুগের পর বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। সর্বক্ষেত্রে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। অরাজকতার এ কাল বাংলার ইতিহাসে মাত্সন্যায়ম হিসেবে পরিচিত। এ সময় বাজার থেকে রৌপ্য মুদ্রা উঠে যেতে শুরু করে এবং সপ্তম শতাব্দীর পর স্বর্ণমুদ্রা বা দিনারের কোনো উল্লেখই পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক
অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দা তাম্রলিপ্তি নগরীর দুরবস্থা বয়ে আনে। এছাড়া আবহাওয়ার ও নদীর গতি পরিবর্তনের এই বাণিজ্যিক বন্দর তার হূত গৌরব হারাতে থাকে। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, সপ্তম শতাব্দীর পর তাম্রলিপ্তির জৌলুস কমতে শুরু করে (রায় ১৯৯৩, ১৬০-১৬১, ৩৬১)। তাম্রলিপ্তি
বন্দরের উত্থান ও সমৃদ্ধির ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অষ্টম শতাব্দীর আগে এ অঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করেছে। পঞ্চম শতাব্দীতে ফা-হিয়েন এ অঞ্চল ভ্রমণ করে তাম্রলিপ্তিকে বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এখানে শ্রমণসহ ২২টি আবাসিক বিহার দেখেছিলেন এবং দুই বছর এখানে অবস্থান করেছেন। তা চেং-তেং নামে এক তীর্থযাত্রী ১২ বছর তাম্রলিপ্তিতে অবস্থান করেছেন এবং ইৎ সিংয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি সংস্কৃত-বৌদ্ধ সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং তাম্রলিপ্তি ভ্রমণ করেন। তার তথ্যমতে এখানে ১০টি বিহার এবং বিহারে প্রায় ১০০০ শিক্ষার্থী বসবাস করত (মজুমদার ১৯৭১, ৫২৪)। দশকুমারচরিত অনুসারে তাম্রলিপ্তিতে বিন্দুবাসিনী নামক একটি মন্দির রয়েছে (রায় ১৯৯৩, ২৯৬)। ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাং যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম শতাব্দীতে এ মন্দির পরিদর্শন করেন (ল ১৯৫৪, ২৬৩)। রূপনারায়ণ নদীর সীমা পরিবর্তনের কারণে মন্দিরটি ধ্বংস হয়। রায়ের
মতানুসারে তাম্রলিপ্তিতে প্রথমে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন এবং তাদের হাত ধরে আসে ধর্ম। এরপর পুরোহিত বা যাজকরা ধর্ম প্রচার শুরু করেন (রায় ১৯৯৩, ১৫৭)। ক্রমে ক্রমে সাধারণ নিয়মানুসারেই ধর্ম প্রসারিত হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মের তীর্থস্থানে পরিণত হয় তাম্রলিপ্তি। খ্রিস্টপূর্ব
২০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতির পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল তাম্রলিপ্তি বন্দর। বহিরাগত ব্যবসায়ী পরিবারদের বসতি স্থাপন, বাংলার বাইরের মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয় জনগণের পরিচিতি, বন্দরনগরীকে কেন্দ্র করে শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ নামক বণিক গোষ্ঠীর ক্রমবিকাশে তাম্রলিপ্তির প্রভার ছিল সুদূরপ্রসারী। সাধারণত
প্রাকৃতিক কারণেই নদী তার গতিপথ বদলায়। তবে এর সঙ্গে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ থাকতে পারে। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে তাম্রলিপ্তি তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। সরস্বতী ও ভাগীরথীর খাত শুকিয়ে যাওয়া এর অন্যতম নেপথ্য কারণ। এ সময়ে ভাগীরথী নিম্নগামী হয়ে যায় ও সরস্বতী পূর্ববর্তী পথ থেকে সরে সরাসরি দক্ষিণে বইতে শুরু করে। এসব প্রাকৃতিক কারণে বাণিজ্যের গতিপথও বদলে যায়। এ
প্রেক্ষাপটে তাম্রলিপ্তির পতনের কারণ হিসেবে হাইড্রোগ্রাফির কথা বলা চলে (চক্রবর্তী ২০০২, ১৬৫)। যে চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে তমলুকের নদী ব্যবস্থা চলত তা পলি পড়ে শুকিয়ে যায় (মুখার্জি ২০০৯, ১৮৫)। একসময় কালের বিবর্তনে সমুদ্রের তীরঘেঁষা শহরটি পশ্চাত্ভূমি থেকে ৫০ মাইল দূরে সরে যায় এবং সমুদ্রতীর থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ নদীপথটি তখন সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁওয়ের কাছে চলে যায় (জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ১৯৯২, ৭-১১)। নতুন ভূমি তৈরি হওয়ার মতো প্রাকৃতিক কারণে এবং নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ার ফলে বিশ্বখ্যাত এ বন্দরের আগের সুনাম ও জৌলুস বিলুপ্ত হতে থাকে। এর পরবর্তী সময়ের সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ একটি সাধারণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পাওয়া যায়। এছাড়া,
রাজনৈতিক অস্থিরতা তাম্রলিপ্তির গৌরব হারানোর অন্যতম কারণ। মূলত শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকেই পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। এ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে। উল্লেখ্য যে, বাংলায় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদ্যমান এ অবস্থা মাৎস্যন্যায়ম হিসেবে পরিচিত । মূলত এ সময়েই তাম্রলিপ্তির গৌরব লুপ্ত হয়। প্রাচীনকালে
বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তাম্রলিপ্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও রোমান সাম্রাজ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা অঞ্চল থেকে এখানে এসে বাণিজ্য করার চিন্তা করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এর মাধ্যমে বাংলায় সে সময়েই একটি ব্যবসায়ী অভিজাত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীতে তাম্রলিপ্তির পতনের পাশাপাশি সার্থবাহ, শ্রেষ্ঠীদের সুসময়ও শেষ হয়ে আসে। আন্তর্জাতিক
বাণিজ্য কমে যেতে শুরু করলে সমাজ কৃষিনির্ভর হতে শুরু করে। বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেই স্বর্ণ ও রৌপ্য আমদানি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি মজুদ কমে যায়। এতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীর মতো করে অষ্টম শতাব্দীতে স্বর্ণের ব্যবহার দেখা যায়নি। নীহাররঞ্জন রায়ের মত অনুসারে বলা যায়, সপ্তম শতাব্দীর পর বাংলার সমুদ্রবাণিজ্যের গৌরবময় কালপর্ব আর আসেনি। খ্রিস্টপূর্ব
কাল থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার সমুদ্রবাণিজ্যের স্বর্ণযুগে তাম্রলিপ্তি বন্দরনগরী ছিল একটি মুখ্য অনুষঙ্গ। এর পতনের মাধ্যমে বাংলার বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি বিলীন হতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন বন্দরের উদ্ভব হলেও তাম্রলিপ্তিকেন্দ্রিক বাংলার সমুদ্রবাণিজ্যের গৌরবময় অধ্যায় বহুকাল আর ফিরে আসেনি। পরবর্তী ৫০০ বছরে বাংলার অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণও আদি পর্বের এ বিলুপ্ত নগরীর ইতিহাসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। তথ্যসূত্র ১. শারমীন
আখতার
অ্যান্ড
হানিজা
ইদ্রিস,
২০২২,
এশিয়ান ট্রেড
করিডোর তাম্রলিপ্তি অ্যান্ড বেঙ্গল’স গ্লোরি (২০০
খ্রিস্টপূর্ব-৭০০
খ্রিস্টাব্দ), কেমানুসিয়ান দি
এশিয়ান
জার্নাল
অব
হিউম্যানিটিস,
২৯
(১):১-২২। ২. এস
ত্রিপাঠি
অ্যান্ড
এসআর
রাও,
১৯৯৪,
তাম্রলিপ্তি; দি
এনশিয়েন্ট পোর্ট
অব ইন্ডিয়া; স্টাডিজ ইন
হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার,
২(১):
৩৩-৩৮। ৩. টিএন
রামচন্দন,
১৯৫১,
তাম্রলিপ্তি (তামলুক),
এট্রিবিউস
এশিয়া,
১৪(৩):
২২৬-২৩৯। ৪. পিসি
দাশগুপ্তা,
১৯৫২-৫৩,
রিসেন্ট আর্কিওলজিক্যাল এক্সপ্লোরেশন টু
তাম্রলিপ্তি,
মডার্ন
রিভিউ,
৯২:৩৯২-৩৯৭। ৫. এস
বিল.
২০০৩,
সি-ইউ-কি বুড্ডিস্ট রেকর্ডস অব দ্য
ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ট্রান্সলেটেড ফ্রম
চাইনিজ অব
হিউয়েন সাং (৬২৯),
ভলিউম
২,
নিউ
দিল্লি,
এশিয়ান
এডুকেশনাল
সার্ভিসেস। ৬. নীহাররঞ্জন
রায়,
আষাঢ়
১৪১১,
(চতুর্থ সংস্করণ)
বাঙ্গালীর ইতিহাস
(আদি পর্ব),
দে’জ পাবলিশিং। শারমীন আখতার:
সহযোগী
অধ্যাপক,
ইতিহাস
বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়