জসীমউদ্দীন (পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের জীবনকথা বইয়ের থিয়েটার অংশ থেকে নেয়া) পরলোকগত
কংগ্রেস
সভাপতি
অম্বিকাচরণ মজুমদারের সময় হইতে আমাদের ফরিদপুর শহরে প্রতি বছর একটি কৃষি-শিল্প প্রদর্শনী বসিত। এই উপলক্ষ্যে সেখানে নানা রকম গান বাজনা হইত। একবার সেখানে বিল্ব-মঙ্গল অভিনয় দেখিতে আসিলাম। এই আমার প্রথম থিয়েটার দেখা। পরদিন
বিকালে
নদীর
ধারে
কাপড়
টানাইয়া
কৃত্রিম
মঞ্চ
তৈরী
করিয়া
পাড়ার
ছেলেদের
ডাকিয়া
বিল্ব-মঙ্গল ঠাকুরের অভিনয় দেখাইলাম। চিন্তা ধ্যান
চিন্তা জ্ঞান চিন্তামণি কোথা
গেলে তুমি? বলিয়া
আমি যখন অভিনয় করিতেছিলাম, আমার শ্রোতারা সেদিন সত্যকার থিয়েটারের শ্রোতাদের চাইতে আমার কম তারিফ করে নাই। ইহার
পরে বড় হইয়া থিয়েটার দেখার নেশা আমাকে পাইয়া বসিল। ফরিদপুর টাউন-থিয়েটারের অভিনয় হইত টিকেট করিয়া। কিন্তু টিকেট কেনার পয়সা আমি কোথায় পাইব? অভিনয়-ঘরের জানালার পাশে একটি সুপারী গাছ ছিল। সেই সুপারী গাছে উঠিয়া শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে অভিনয় দেখিতাম। শাজাহান, মোগল পাঠান, সোনায় সোহাগা। রাজা হরিশচন্দ্র প্রভৃতি নাটকের অভিয়ন আমি এইভাবে দেখিয়াছিলাম। মাঝে মাঝে চাহিয়া চিন্তিয়া দু’একদিন পাশ সংগ্রহ করিতাম। সেদিন অভিনয়ের সমস্ত কিছু মনে মনে মুখস্ত করিয়া রাখিতে চেষ্টা করিতাম। পয়দিন নদী-তীরে যাইয়া অভিনয়ের চরিত্রগুলির মত বক্তৃতা করিতাম । ফরিদপুরে
ড্রামেটিক ক্লাব নামে আরও একটি থিয়েটারের দল ছিল। এই দলের নায়কের পাঠ করিতেন বাবু বিমলচন্দ্র সেন। একবার স্কুলের রিসাইটেশনের কোন পাঠ লইয়া কিছু নির্দেশ পাইতে আমি বিমল বাবুর কাছে গেলাম। তিনি সস্নেহে আমার পাঠটি আমাকে শিখাইয়া দিলেন। সেই হইতে তাহার সহিত আমার খুব ভাব হইয়া গেল। থিয়েটারে প্রায়ই তিনি আদর্শ চরিত্রের অভিনয় করিতেন। আমার মনে হইত তিনি যেন সেই সব চরিত্রের সমস্ত সদ্গুণেরই অধিকারী। তাই তিনি আমার বালক বয়সের কল্পনায় একটি ছোটখাট দেবতা ছিলেন। একবার থিয়েটারের বড় বড় ভক্ত তার অনুকরণে কল্পিত কোন কাহিনীর পাঠ খাতা ভরিয়া লিখিয়া তাহার নামে উৎসর্গ করিয়া তাহাকে পড়িতে দিলাম। তিনি পড়িয়া বলিলেন, ‘বেশ মিষ্টি লাগিতেছে।’ মাতৃদুগ্ধের মত এরূপ স্বীকৃতি নূতন সাহিত্যিকদের পক্ষে বড়ই উপকারী। তখনকার লেখায় কত যে ভুল-ত্রুটি আর উচ্ছ্বাস থাকিত; কিন্তু কোনদিনের জন্যও তিনি আমার লেখার সমালোচনা করেন নাই। তিনি শুধু প্রশংসাই করিতেন। বিমলবাবু
ভাল অভিনেতা ছিলেন। তাহার মত এমন মিষ্টি কণ্ঠস্বর খুব কম লোকেরই দেখিয়াছি। রাজা হরিশচন্দ্রের পাঠ বলিয়া তিনি তাহার দর্শকদিগকে কাঁদাইয়া আকুল করিতেন। তখনকার দিনে মফঃস্বলের রঙ্গমঞ্চগুলিতে অমরেন্দ্র নাথের যুগ চলিতেছে, থিয়েটারের মূক-অভিনয়ের দিন তখনো আসে নাই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার আত্মজীবনী নীরবিন্দু শুরু করেছেন ফরিদপুরের স্মৃতি থেকে) কলকাতায়
থাকি
বটে, কিন্তু জন্মসূত্রে আমি বাঙাল। পুব-বাংলার যে গ্রামে আমার জন্ম, সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের রেল-ইস্টিশানটিও ছিল চব্বিশ মাইল দূরে। জেলার নাম ফরিদপুর, গ্রামের নাম চান্দ্রা। বড়দের কাছে শুনেছি, নামটা আগে চন্দ্রা ছিল। পরে সেটাই চান্দ্রা হয়ে যায়। বিকৃত উচ্চারণে অনেকে আবার চাঁদরাও বলতেন। এতে অবাক হবার কিছু নেই। উচ্চারণের ঝোঁক সর্বদাই বিকারমুখী। নামের বিকার অতএব ঘটতেই পারে। নৃপেন্দ্র যখন নেপেন্দর হয়ে যায়, কিংবা নবকৃষ্ণ হয়ে যায় লবকেষ্টো, চন্দ্রা তখন চাঁদরা হবে, এ আর বিচিত্র কী। তার উপরে আবার ফরিদপুর জেলার নিজের বলতে কোনো উচ্চারণও নেই। কী করে থাকবে। খুব বনেদি জেলা তো নয়, বয়সে অতি অর্বাচীন। আর-পাঁচটা জেলা থেকে খানিক খানিক এলাকা খাবলে নিয়ে এটা তৈরি হয়েছিল। ফলে যে এলাকার জায়গাজমি যে-জেলা থেকে খাবলে নেওয়া হয়, সেখানে চলত সেই জেলার উচ্চারণ। আমার
মামাবাড়ি
ফরিদপুর
জেলার
গোয়ালন্দ
মহকুমার
রাজবাড়িতে। অথচ একই জেলার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মামাবাড়ির লোকজনেরা আমাদের বাঙাল বলে ঠাট্টা করতেন। করতেই পারেন। কেননা, তারা যে এলাকার বাসিন্দা, সেটা যে আগে নদে জেলার মধ্যে ছিল, এটা তারা কখনও ভুলতে পারেননি। ওদিকে আবার নদীর খাত পালটে যাওয়ায় ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল, আর তার পশ্চিম-দিককার ভাগটা এসে গিয়েছিল ফরিদপুর জেলার মধ্যে। গ্রামের লোকেদের
প্রায় সবারই
কিছু-না-কিছু
জমি-জিরেত
ছিল। কারো
বেশি, কারো
কম। বেশি
বলতে অবশ্য
মেরেকেটে পঞ্চাশ-বটি
বিশ্বে, তার
বেশি নয়।
কম বলতে
বিঘে দশেক,
কী তারও
কম। দুটি
পরিবারের আদৌ
আমি ছিল
না। এককালে
ছিল হয়তো,
কিন্তু অভাবে
পড়ে বেচে
দিতে বাধ্য
হয়েছে। তার
মধ্যে একটি
পরিবারের কর্তা
বাইরে চাকরি
করতেন। বড়
কিছু চাকরি
নয়। কথাটা
এজন্যে বলছি,
বাড়ির লোকেদের
খাই-খরচার
জন্যে মানি
অর্ডার করে
মাঝেমধ্যে তিনি
যে টাকা
পাঠাতেন, তাতে
সংসার চলত
না। ফলে
তার বউকে
অন্যের বাড়িতে
এসে চিড়ে
কোটা কী
এ রকমের
কিছু কাজ
করে দিতে
হতো। তার
জন্যে তিনি
কিছু চাল
পেতেন। ... আগে যা
ছিল মহকুমা,
বাংলাদেশে এখন
সেগুলোকে জেলা
বানিয়ে দেয়া
হয়েছে। আমাদের
ফরিদপুর জেলার
মধ্যে ছিল
চারটি মহকুমা।
গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর,
গোয়ালন্দ আর
সদর। আমরা
সদর-মহকুমার
মানুষ। মৃণাল
সেন (কিংবদন্তি
চলচ্চিত্র নির্মাতা
মৃণাল সেনের
জন্ম ফরিদপুরে।
তিনি দীর্ঘ
সময় সেখানে
ছিলেন এবং
এরপর পশ্চিমবঙ্গে
বসবাস করেন।
ভিটা ত্যাগ
করার দীর্ঘকাল
পর তিনি
সেখানে ফিরেছিলেন।
প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিচারণ
করেছেন তার
তৃতীয়
ভুবন বইয়ে) বেশ একটা
দীর্ঘ সময়
কেটে গেল,
যে সময়ের
কোনো শেষ
নেই, কোনো
সীমারেখা নেই।
ইতিমধ্যে ১৯৯০
সালে সাতচল্লিশ
বছর বাদে
আমি ও
আমার স্ত্রী
সেই ফরিদপুর
শহরের সেই
বাড়িটার সামনে
গিয়ে দাঁড়ালাম,
বাড়িটাকে দেখলাম।
সাতচল্লিশ বছর
আগে আমি
এ দেশ
ছাড়ি। এখন
এই আমার
নিজের মাতৃভূমি
যে দেশে
সেই দেশটার
নাম বাংলাদেশ।
একটি সার্বভৌম
রাষ্ট্র। এ বাড়িটিতেই
আমার শৈশব
ও কৈশোর
কেটেছে। এই
সাতচল্লিশ বছরে
এই বাড়িটার
মালিকানা একবারই
বদলেছে। আমার বাবার
কাছ থেকে
যে ভদ্রলোক
বাড়িটি কিনেছিলেন
তিনি কথা
রেখেছিলেন। সেই
পুকুরপাড়ে রেবার
স্মৃতিসৌধ সযত্নে
রক্ষা করেছিলেন।
তিনি আবার
বাড়িটাকে অন্য
একজনকে বিক্রি
করে দিয়ে
করাচি চলে
যান। সাতচল্লিশ বছর
পরে বিস্ময়ের
সঙ্গে ভাবি—আমি
আমার সেই
দূরের ফেলে
আসা অতীতকে
একটিবারের জন্যও
ভাবিনি, পেছন
ফিরে তাকাইনি।
একবারও ভাবিনি
দেশভাগের কথা।
কিন্তু এখন
কেন ভাবছি! ...সাতচল্লিশ
বছর বাদে
নিজেকে প্রশ্ন
করি কেন
এমন হলো,
কেন আমি
আমন্ত্রণ পেয়েও
সেই শৈশবের
কৈশোরের বাসভূমিতে
গেলাম না।
তখন ঢাকা
থেকে ফরিদপুরে
যাওয়ার পথটা
ভারী সুন্দর
ছিল, পুরো
একদিন সময়
চলে যেত
নদীতে জাহাজে,
যে জাহাজে
ওপরে নিচে
শোয়ার জায়গা
থাকত। সেই
জাহাজ আসত
নারায়ণগঞ্জ থেকে।
জাহাজগুলোর নাম
ছিল এমু
অথবা অস্ট্রিচ
এ রকম
ধরনের। নদী
তখন বর্ষায়
ভয়ংকর। সে
নদী হলো
পদ্মা। তারপর
ছোট্ট ডিঙির
আমার মতো
নৌকায় চড়ে,
ফেরিতে চড়ে,
যার নাম
ছিল ডামডিম,
সরু খালের
ভেতর দিয়ে
যেতে হতো
খালের দুপাশে
ধান আর
পাটের খেত
শেষ করে
সোজা ফরিদপুর। ...আমরা
যখন সেই
ফরিদপুর শহরের
কাছাকাছি এসে
গেছি তখন
আমি খুব
উত্তেজিত, উত্তেজনার
আগুন পোহাচ্ছি। ‘সামনে
কী?’ যেন
অনেকটা পড়া
ধরার ভঙ্গিতে
আমাকে জিজ্ঞেস
করলেন খয়ের
সাহেব। ‘কেন,
সেই খালটা!’
আমি দৃঢ়তার
সঙ্গে বললাম।
অবাক করে
দেওয়ার জন্য
বললাম, ‘কেন,
সামনেই সেই
কাঠের পোল।’ ‘কাঠের
সেই সেতুটা
আর নেই।’ ...আমার
মনের ভেতরে
একটার পর
একটা স্মৃতি—সেই
মনের গোপন
কোণে সেসব
পুরনো কথা
উঁকি মারছিল।
প্রায় এক
দেড়শো লোক
আমাদের পেছন
থেকে খেয়াল
করছিল। ওরা
আমাকে চিনতে
পেরেছিল। ওদের
কয়েকজন পেছন
পেছন এল,
আমরা সেই
বাড়িটার সামনে
এসে দাঁড়ালাম।
প্রতিটি পদক্ষেপেই
উত্তেজনা। আমি
নিজের সঙ্গে
নিজে লড়াই
করছিলাম, একটা
অনিশ্চয়তা যেন
আমাকে চেপে
ধরেছিল। সেই
স্মৃতির উন্মোচন
যেন ‘লস্ট
হরাইজন’-এর
হারিয়ে যাওয়া
নায়ক রোনাল্ড
কোলম্যান-এর
মতো। ...সে এক
অভিজ্ঞতা। আমি
নিজেই সব
জায়গা খুঁজে
পেলাম সাতচল্লিশ
বছর পরেও।
কিছু মানুষ
ছড়িয়ে ছিটিয়ে
আমার দেশের
বাড়ির সামনে।
কেউ একটি
কথাও বলল
না। এক
অখণ্ড অপূর্ব
নীরবতা। গীতা
কানের কাছে
ফিসফিস করে
বলল, ‘তুমি
সব জায়গা
চিনতে পেরেছ।
এদেরও চিনতে
পেরেছ।’ আমি
মুখ ঘুরিয়ে
নিলাম। কিছু
বললাম না।
গীতা আমার
হাতটা চেপে
ধরল। আমার
কান্না পেল।
কিন্তু কাঁদতে
পারলাম না।
রমেশচন্দ্র
মজুমদার (ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
ও প্রখ্যাত
ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র
মজুমদারও ফরিদপুরের
সন্তান। জীবনের স্মৃতিদীপে নামে
স্মৃতিকথায় সেকালের
ফরিদপুরের চিত্র
পাওয়া যায়) বর্তমান বাংলা
দেশের অন্তর্গত
ফরিদপুর জেলার
খান্দারপাড়া গ্রামে
১৮৮৮ খৃষ্টাব্দের
৪ ডিসেম্বর
এক বৈদ্যবংশে
আমার জন্ম।
আমাদের বংশ
কুলীন হিসেবে
এক সময়
অনেক সম্মান
ও মর্যাদার
অধিকারী ছিল;
এখন আর
সেসব কিছুই
নেই। বৈদ্য
কুলপঞ্জিকায় আমাদের
বংশ ও
পূর্বপুরুষদের অনেক
উল্লেখ আছে।
বাল্যকালে আমার
এক বৃদ্ধ
জ্যাঠামশাইয়ের কাছে
আমাদের পূর্বপুরুষদের
অনেক কাহিনী
বহুবার শুনেছি।
এইসব কাহিনী
কতদূর সত্য
বলতে পারি
না। তকে
ঐতিহাসিক কিংবদন্তি
হিসেবে এর
কিছু মূল্য
আছে এবং
বিভিন্ন প্রাচীন
পরিবারের এরূপ
কাহিনী একত্র
করলে মধ্যযুগের
ইতিহাসের কিছু
উপকরণ সংগৃহীত
হতে পারে। ...আমার
পিতামহ রতনমণি
মজুমদার এক
জমিদারি সেরেস্তায়
কাজ করতেন।
তার মাহিনা
ছিল মাসিক
মাত্র পাঁচ
টাকা। তবে
তহুরী প্রভৃতি
বাবদ আরো
কিছু উপরি
পেতেন এবং
সামান্য কিছু
জমিজমাও ছিল।
এর দ্বারাই
সেকালে তার
নাতিবৃহৎ সংসার
চালিয়েছেন। ইতিপূর্বে উল্লেখ
করা হয়েছে
যে বর্তমান
বাংলা দেশের
ফরিদপুর জেলার
খান্দারপাড়া নামে
একটি ছোট
গ্রামে ১৮৮৮
খৃষ্টাব্দের ৪
ডিসেম্বর আমার
জন্ম হয়।
এই গ্রাম
তখন মাদারীপুর
মহকুমার অন্তর্ভুক্ত
ছিল, পরে
গোপালগঞ্জ মহকুমার
অধীনে আসে।
আমার পিতা
হলধর মজুমদার
আগরতলার ত্রিপুরা
এস্টেটের রাজার
উকিল ছিলেন।
...গ্রামে
আর একটি
বড় অসুবিধা
ছিল—যাতায়াতের
কষ্ট। পাকা
রাস্তা তো
ছিলই না,
কাঁচা রাস্তারও
অস্তিত্ব বিশেষ
ছিল না।
কলকাতা থেকে
আমাদের গ্রামে
যেতে হলে
প্রথমে রেলপথে
খুলনা এবং
খুলনা থেকে
স্টিমার। স্টিমারে
যেখানে নামতে
হতো সেখান
থেকে আমাদের
গ্রাম দশ
বারো মাইল
দূরে। নদী
থেকে গ্রাম
পর্যন্ত কোনো
বাঁধা সড়ক
নেই, কেবল
মাঠ। দুই
জমির মধ্যে
যে আঁকাবাঁকা
আল থাকে,
তার উপর
দিয়ে হেঁটে
যাওয়া ছাড়া
উপায় ছিল
না। এই
পথে গোরুর
গাড়ি যেতে
পারত না।
ছেলেবেলায় আমি
গোরুর গাড়ি
দেখিনি। মেয়েরা
সাধারণতঃ ডুলিতে
স্টেশনে যাতায়াত
করত। বর্ষাকালে
সব অঞ্চলটিই
জলে ডুবে
যেত। গ্রাম
মাঠ সবই
জলে জলে
ডুবে যেত।
জলের মধ্যে
কেবল মাঝে
মাঝে কয়েকটি
বাড়ি মাথা
তুলে থাকত।
খুব ছেলেবেলার
কথা মনে
আছে, তখন
বাড়ির উঠানেও
বর্ষায় জল
উঠত। এক
ঘর থেকে
অন্য ঘরে
যেতে হলেও
সেই জল
ভেঙে যেতে
হতো। কাঠের
নৌকা, তালগাছের
ডোঙা এবং
কলাগাছের ভেলা
ছাড়া এ
বাড়ি ও
বাড়ি যাওয়া-আসার
উপায় ছিল
না। কার্তিক
অঘ্রাণ মাসে
এই জল
সরে গেলে
নানা রকম
রোগ দেখা
দিত। গ্রামে
একজন হোমিওপ্যাথিক
ডাক্তার এবং
দু-একজন
কবিরাজ ছিলেন।
চৈত্র মাসে
পুকুর শুকিয়ে
গেলে গ্রামে
পানীয় জলের
খুব কষ্ট
হতো। গ্রামে
একটি মাইনর
স্কুল ছিল,
সেখানেই আমার
প্রথম বিদ্যাশিক্ষা।
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় (বিখ্যাত
ও জনপ্রিয়
সাহিত্যিক সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়েরও জন্ম
অবিভক্ত বাংলার
বৃহত্তর ফরিদপুর
জেলার তত্কালীন
মাদারীপুর মহকুমায়।
তার আত্মজীবনীতে
এসেছে ফরিদপুরের
স্মৃতি। অর্ধেক জীবন
বই
থেকে সে
স্মৃতি তুলে
ধরা হলো) অবিভক্ত বাংলার
ফরিদপুর জেলার
মহকুমা শহর
মাদারীপুর, সেই
শহর থেকেও
বেশ দূরে
মাইজপাড়া একটি
অতি সাধারণ
গ্রাম। মাইয
বা মাইজ
মানে খুব
সম্ভবত মধ্যম,
বাঙাল ভাষায়
মেজো ভাইকে
বলে মাইজাভাই।
আঞ্চলিক অভিধানে
মাইজের অন্য
অর্থও আছে,
মাইজপাতা মানে
গাছের কটি
পাতা। শুধু মাইজপাড়া
নয়, পূর্ব
মাইজপাড়া। তার
মানে নিশ্চয়ই
একটা পশ্চিম
মাইজপাড়াও ছিল
বা আছে।
অবশ্য এ
নিয়মের ব্যতিক্রমও
হয়। যেমন
এখন পশ্চিমবঙ্গ
নামে একটি
রাজ্য আছে,
(আগে যাকে
প্রদেশ বলা
হতো) কিন্তু
পূর্ববঙ্গ বলে
এখন আর
পৃথিবীতে কিছু
নেই। এই
পশ্চিমবঙ্গের আবার
উত্তর ও
দক্ষিণবঙ্গ হিসেবেও
ভাগ করা
হয়, কিন্তু
পূর্ববঙ্গ অদৃশ্য। ওই পুব
মাইজপাড়া গ্রামের
এক প্রান্তে
ছিল একটি
ব্রাহ্মণ পল্লী।
একটি বেশ
বড় আকারের
চৌকো উঠোনের
চারদিকে চারটি
বাড়ি। পঞ্চম
একটি বাড়ি
এক কোণের
দিকে, বোঝা
যায় পরের
দিকে উড়ে
এসে জুড়ে
বসেছে, তাই
বর্গক্ষেত্রটির পাশে
জায়গা পায়নি।
সেই পঞ্চম
বাড়িটি আকারেও
ছোট, চেহারায়
মলিন, তাতে
অন্যদের তুলনায়
এক দরিদ্র
ব্রাহ্মণ পরিবারের
বাস। সেই
পরিবারের কর্তার
নাম অবিনাশচন্দ্র
গঙ্গোপাধ্যায়, আমার
পিতামহ। তিনি
ছিলেন সামান্য
এক টোলের
পণ্ডিত।
...ফরিদপুর জেলাতেই সেই মামার বাড়ির গ্রামের নাম আমগ্রাম বা আমগাঁ, লোকে অবশ্য বলত আমগা; পূর্ববঙ্গের লোকদের কেন যেন চন্দ্রবিন্দুর প্রতি বড়ই অভক্তি। পশ্চিমবঙ্গে আবার বেশি বেশি চন্দ্রবিন্দু। ওরা চাঁদ ও ফাঁদকে বলে চাদ ও ফাদ, এদিকে এরা হাসি ও হাসপাতালের বদলে হাঁসি ও হাঁসপাতাল। আমাদের মাইজপাড়ার তুলনায় আমগাঁ বেশ বর্ধিষ্ণু, অনেক সচ্ছল লোকের বাস, বেশকিছু পাকা বাড়ি, এমনকি দোতলা-তিনতলা, যা ওই ধরনের গ্রামে তখনকার দিনে খুবই দুর্লভ ছিল।